পিতৃপুরুষ
যাদবপুর
স্টেশন রোড ছাড়িয়ে, গড়ফা থার্ড লেনে ঢুকতেই বাঁ হাতের প্রথম তিনতলা বাড়িটা জটিলেশ্বরবাবুর।
বাড়ির সামনে একফালি বাগান, ছোট কলতলা, পাশে গ্যারাজ, ঝুল বারান্দা, জানালায় খড়খড়ি, ছাদে ওঠার আধ-ভাঙ্গা মরচে ধরা ঘোরানো সিঁড়ি। বাড়ির পিছনে এক ছটাক জমি, তাতে
হাবিজাবি ঝোপঝাড়ের
মধ্যে জটিলেশ্বরবাবুর স্বর্গতা স্ত্রী’র কোনোকালে লাগানো আম, পেয়ারা,
আর কাঁঠাল গাছ। জটিলেশ্বরবাবুর বয়েস নব্বই ছুঁই ছুঁই। একমাত্র ছেলে
কমলেশ্বর কলেজে অধ্যাপনা করেন। স্ত্রী নবনীতা শিক্ষিকা, স্কুলে পড়ান। নিঃসন্তান।
জটিলেশ্বরবাবু
তিনতলার বড় একখানা ঘরে একা থাকেন। কানে ভালো শোনেন না, চোখেও দেখেন কম, ডিমেনশিয়ার
রুগী... মনে রাখতে পারেন না বিশেষ কিছু। জটিলেশ্বরবাবুর ফাইফরমাশ খাটার জন্য হারান
রয়েছে। অনেক কালের লোক। স্নান, খাওয়ানো, পেচ্ছাপ-পায়খানা পরিষ্কার, কাপড় চোপড় কাচা...
সব ওই করে। সে বাদে, বহু বছর হয়ে গেল খুব প্রয়োজন না হলে ওনার ঘরে বড় একটা কেউ ঢোকে
না।
***
- “হারাআআআন”...
- “আজ্ঞে যাইইই...
উফফ... যাচ্ছিইইইই।”-- ষাটের কোঠায় বয়েস, এলোমেলো কাঁচাপাকা চুল-দাড়ি, খেটো ধুতি আর ফতুয়া গায়ে হারান
তিন তলায় উঠে এল।
-“তখন থিকে
চেল্লামেল্লি করতিছেন কেনে? বলছি তো যাচ্ছি! নিচে মেলা কাজ। বলেন, কী বলবেন, তাড়াতাড়ি বলেন!”
-“লুচিইই?
ঘি এর লুচিইইই?” জটিলেশ্বরবাবুর চোখ দুটো চকচক
করছিল।
-“ইইইশ...
বুড়োর নোলা দেখ না, ঠিক গন্দ পেয়েছে!... হ্যাঁ, হচ্ছে তো, নুচি হচ্ছে ... কেনে? আপনি এখন খাবেন? এইমাত্তর তো খাইয়ে দে গেলুম!” হারান খেঁকিয়ে উঠল।
-“কদ্দিন
খাই না!” জটিলেশ্বরবাবু ক্লান্ত ফিসফিসে গলায় বললেন।
-“কত্তা,
আপনার পেরান চাইছে ওই নুচি কয়খান খেতি? ও আপনি হজম করতি পারবেন? গলা দে নামবে আপনার?? আপনারে যে সেদিন অত করে বোঝালুম!! উফফ ভগবান, এ লোক যে কবে
সগ্গে যাবে!” হারান মাথা চাপড়ালো।
- জটিলেশ্বরবাবু
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন, মনে করতে পারলেন না কিছু। বিড়বিড় করে কী একটা বলে উঠলেন যেন... ঠিক বোঝা গেল না।
***
রাত্রি
এগারোটা নাগাদ বাড়ি ফাঁকা হলো। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা
ততক্ষণে চলে গিয়েছেন।
কেটারিং আর ডেকরেশনের পয়সা মিটিয়ে হাতের কাজ সেরে নবনীতা প্রায় এক যুগ
পর শ্বশুরমশাইয়ের তিনতলার
ঘরের দরজায় আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ালেন।
- “আসেন,
আসেন বউদিমনি... কত্তাকে এই শুইয়ে দোবো এবার।” হারান ব্যাস্ত-সমস্ত
হয়ে উঠল।
- “কেএএএ?”
- “আজ্ঞে,
বউদিমনি ... কত্তা। আপনার পোলার বউ, আমাদের বউমা গো? মনে করতে পারছেন? ও কত্তা?”
- “বউদিমনিইইই...
বউদিমনিইই...” বিড়বিড় করতে করতে জটিলেশ্বরবাবু অল্প মাথা নাড়লেন, চিনতে পারলেন না!
- নবনীতা ধরা গলায় ডাকলেন -- “বাবা”
বহুবছর
... বহুকাল পর চেনা ডাকখানা শুনে জটিলেশ্বরবাবুর ছাল ওঠা শুকনো ঠোঁট দুটো আবছা হেসে আপন মনে আউড়ে উঠল -- “বাবাআআআ”!
- “আপনার
ছেলে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন বাবা ... আপনার একমাত্র ছেলে... সে আর নেই... ওও বাবাআআ...
আপনি বুঝতে পারছেন কিছু?
আমার যে আর কেউ রইল না বাবাআআআ”-- ক্লান্ত, চোখের কোলে কালি, উস্কো খুস্কো চুল, সাদা খোলের কাপড়
পরা নবনীতা, ডুকরে কেঁদে শ্বশুরমশাইয়ের পায়ের কাছে বসে পড়লেন।
-- জটিলেশ্বরবাবু
কী শুনলেন, কী বুঝলেন, তেমন একটা বোঝা গেল না। শুধু শিরা ওঠা,
আঙ্গুল বেঁকে যাওয়া কাঁপা কাঁপা হাতখানা নবনীতার মাথায় ছুঁইয়ে,
নুয়ে পড়া ভাঙাচোরা শরীর, মুখে অজস্র আঁকিবুঁকি কাটা,
ছলছলে ঘোলাটে চোখ, নব্বই ছুঁই ছুঁই জটিলেশ্বরবাবু, সর্দি বসা ভাঙা গলায় ফিসফিস করে বলে
উঠলেন -- “লুচিইইই! ... লুচি খাবোওও ... কদ্দিইইইন খাই না”...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন