মিকিমিনি
তেত্রিশ বছর আগে এক বিকেলে ওরা নেই হয়ে গিয়েছিল। সুদীপের
নাগাল থেকে দূরে রাখার জন্যে ঠাম্মার দেরাজে তুলে রাখতাম ওদের। সুদীপের এত খেলনা
তাও বেছে বেছে এই মিকিমিনিটাই পছন্দের
ছিল। একবার হাতে পেলে আর দিতে চাইতো না।
বেঞ্চটার নিচে যেখানে শার্পেনারটা আঁটকানো ঠিক সেইখানটায় বাঁ
দিকে একটু ভাঙা। শার্পেনারটা আমার জন্মদিনে সিরাজকাকু দিয়েছিলেন। প্রথম দিনই
আস্ত একটা পেন্সিল খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে প্রায় এক কড়ের কাছাকাছি করে ফেলেছিলাম। তাও নিব
বেরোয়নি। সিরাজ
কাকুও চেষ্টা করেছিলেন। ভোঁতা
শার্পেনার। আমাদের
কসরত দেখে মা বলেছিলেন, ‘এত সুন্দর! নাই বা কাটলে পেন্সিল’। পেন্সিলের খোসাগুলো ভেতর
থেকে বেরোচ্ছিল না। মাটিতে ঠুকেছিলাম আমি। শার্পেনারের বাঁ পাশে তাতেই ছড়ে
গিয়েছিল।
এত দেশ ঘুরেছি কোথাও এমন নিখুঁত মিকিমিনি চোখে পড়েনি। কেউ ব’লে না
দিলে বোঝার উপায় নেই যে এটা একটা শার্পেনার। মিনির মাথায় ইয়াব্বড় সেই লাল-শাদা
পোল্কা ডট রিবন আর মিকির পরনে লাল শর্টস তাতে দুটো শাদা বোতাম। মিকির চোখ
মিনির দিকে আর মিনি সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে; ঠিক তেত্রিশ বছর আগের মতোই! কাকি বলে
যাচ্ছেন কাকুর শেষ সময়ের ঘটনা আর আমি
ক্রমশ খেই হারাচ্ছি। গরম দুধ জ্বাল দিয়ে উথলে পড়ার মতো হুড়মুড়িয়ে সব দৃশ্য উপচে
উঠছে চোখের সামনে!
দু’বিনুনী করা আট বছরের মেয়েটা বুক ভেঙে কাঁদছে। বাড়ির সবাই
আতিপাতি খুঁজছে। সাত
বছরের সুদীপকে মা ধমকাচ্ছে, ‘তুই নিয়েছিস?’ ঠাম্মা জেরা করছে সোনার মাকে, ‘তুই
লইইয়স নি খনো?’
সিরাজকাকুর সাইকেলের দোকানের নাম ছিল ‘হিস অ্যান্ড হারস’। সাইনবোর্ডের
নিচে একটা ঝকমকে মেয়ে আর ছেলে। পাশেই ইংরেজিতে পেঁচিয়ে লোগো, ‘এইচ এ্যান্ড এইচ’। একবার আমেরিকায় টাইম স্কোয়ারে ‘এইচ এ্যান্ড এম’ এর সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ কাকুকে
মনে পড়েছিল সাথে মিকিমিনিকে।
সিরাজকাকু নেই। মা বাবাও চলে গেছেন জীবনের ওপারে! দেশে এলে
এখন আর তিন সপ্তাহর বেশি থাকা হয় না আমার। এর মধ্যে অনেকটা সময় চলে যায় আরোপিত সম্পর্কগুলোর দায়
মেটাতে। একসময়ে যারা কাছের ছিলেন তারা এই দায়ের টানাপড়েনের কারণে বৃত্তের বাইরেই
রয়ে যান।
দুদিন পরেই ফিরছি। কিছু শপিং বাকি ছিল। আজ নাসিরাবাদের ‘আফমি প্লাজা’য়
গিয়েছিলাম দীপার সাথে। দীপা
সুদীপের বউ। জিনিসপত্রের সেকি দাম! কেনাকাটার চেয়ে দেখাই হলো বেশি! কখন যে দুপুর
পেরিয়ে গেছে খেয়াল করিনি। ট্যাক্সির জন্যে
অপেক্ষা করছিলাম রাস্তায়। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরলো। আঁতকে উঠেছিলাম। দীপাই চেনালো। মিতু! কত বছর
পরে দেখা! জোর করে নিয়ে গেল রনির বাড়িতে। কাছেই বাড়ি। মেহেদীবাগে। ‘এত কাছে এসে
আম্মিকে না দেখে ফিরে যাবে?’ মিতুর গলায় অভিমান। কাকি রনির
সাথেই থাকেন। ভর দুপুরে কারো বাড়িতে খবর না দিয়ে যাওয়াটা ঠিক? মিতু ম্লান হাসে,
‘রূম্পা দি আগে আম্মি কিংবা কাকিমা কেউই সময় মেপে এবাড়ি ওবাড়ি যেতো না। মনে আছে রনির
প্রিয় কোকোলা নুডলস জমা থাকতো কাকিমার জাল আলমারিতে?’। মায়ের রান্নাঘরের সেই ভাড়ারকে আমরা ‘জালালমারি’ বলতাম। মিতুর মনে আছে!
কাকিকে দেখে মা’র জন্যে মনটা হুহু করে উঠলো। রোদে পিঠ দিয়ে ব্যালকনিতে বসে
চুষি-সেমাই কাটছিলেন। আমাকে দেখে কী যে খুশি হলেন! রনি অফিসে। ওর সাথেও ফোনে কথা
হলো। ও
জানালো ফিরছে তাড়াতাড়ি।
ফ্ল্যাটটা বেশ বড়। আমজাম গাছে ছাওয়া দামপাড়ার সেই বাড়িটা নাকি
সিরাজকাকু থাকাকালীনই বিক্রি হয়ে গেছে। সাইকেলের দোকানটাও নেই আর।
রনির বউ সীমাকে এই প্রথম দেখলাম আমি। বেশ মিশুকে। অল্প
সময়েই টেবিল ভরিয়ে আয়োজন করে ফেললো।
খাওয়া শেষে সবাই বসেছিলাম ড্রইংরুমে। কাকুর অন্তিম সময়ের কথা বলছিলেন কাকি, ‘পেপার পড়তেছিলেন। বাথরুমে গেলো এসেই বলেন পানি
দাও। পানির গ্লাস হাতে রুমে ঢুকসি, দেখি টেবিলের উপ্রে মাথা এলায় রাখসে’। আমি মা’র মুখে
শুনেছিলাম এই ঘটনা। ভালো মানুষ। জ্বরজারি নেই। ফট করে চলে গেলেন! কাকির কথা শুনতে
শুনতে আমি চোখ বোলাচ্ছিলাম ড্রইংরুমের সজ্জায়।
যে সোফাটায় আমি বসেছি ঠিক তার সামনে
নান্দনিক তাকের বিভাজনে ড্রইং ডাইনিং আলাদা করা হয়েছে। বাঁ দিকে দুটো পুরনো
ডিজাইনের শোকেইস। একটাতে
বিভিন্ন দেশের শোপিস। আরেকটাতে ক্লাসিক সব বই। ছেলেবেলায় রনি, মিতুর হাতে গল্পবই
দেখেছি মনে পড়ে না। রনি
ছিল গাড়ির পাগল। কত যে
খেলনা গাড়ি ছিল ওর! হঠাৎ চোখ থমকালো! আমার দু’হাত দূরে মার্কেজের ‘লাভ ইন দ্য টাইম
ওফ কলেরা’র গায়ে ঠেস দিয়ে তাকিয়ে আছে মিকিমিনি!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন