লাল
“দেখিয়ে
মৃণালবাবু, আপনি ঠিক ধরতে পারছেন না আমার চয়েস’টা!
স্কেচ, ফেস্যিয়াল এক্সপ্রেশন য়োহ সব তো ঠিক আছে, মগর সিন্দুরের এই লাল রংটা হামার
পসন্দ হোল না! ইউ নো... প্রপার ইম্প্রেশন আসছে না ফোটোটা থেকে। আপনি বুঝতে পারছেন,
হামি কি বলছি? এই পোট্রেটটা রিসোর্টের মেন লবিতে থাকবে, রিসেপশন ডেস্কের পাশে হামি
ছবিটা টাঙ্গাবো। সো, ইট মাস্ট হ্যাভ দ্যাট অ্যাপিল... কাস্টমাররা ঢুকেই যাতে একটা
পসিটিভ ভাইব পায়। আপনি যে’কোনো কালার মিডিয়াম ইউস করুন, হামার প্রবলেম নেই, বাট
দিস রেড কালার মাস্ট বি ভেরি এক্সক্লুসিভ, ভেরি ইন্টারেস্টিং। যান, আর একবার
চেস্টা করে দেখুন... নেক্সট উইকে বসি... না হলে অউর কোনো আর্টিস্টকে দিয়ে হামায়
আঁকাতে হবে...”
“হারামজাদা...
এই নিয়ে চার চারবার আমার ছবিখানা রিজেক্ট করলো! ঢ্যামনা লোক একখানা, আর্টের বোঝে
কিস্যু! নেহাত টাকার খুব দরকার, নইলে কবে
শালা লাথি মেরে চলে আসতাম!” বাড়ি ফিরে গজগজ করতে করতে মৃণাল ক্যানভাস নিয়ে বসল। চারফুট বাই ছ’ফুটের একচিলতে ঘর... কাগজ, রং, তুলি, পেন্সিল,
ইসেল ছড়ানো। পাশের ঘরটা মা’র... কবেকার পুরনো একখানা সেলাই মেশিন, ছুঁচ-সুতো,
স্তূপাকৃতি শাড়ি-জামাকাপড়, শায়া-ব্লাউজের মাঝে মৃণালের মা
থাকেন। মাস দুয়েক ধরে ভুগছেন বড্ড। কেমন একটা ঘুসঘুসে কাশি, কমতে চায় না, সন্ধ্যের
দিকে জ্বর আসে, কাজে বসতে পারেন না বেশিক্ষণ। ওষুধে তেমন কাজ হলো না দেখে ডাক্তার ক’টা টেস্ট লিখে দিয়েছিলেন... সে’ও প্রায় হপ্তা
দুই হতে চলল। মৃণাল খোঁজ নিয়ে দেখেছে, প্রায় হাজার চারেকের
ধাক্কা... এতগুলো টাকা এখন সে পাবে কোথায়? তাও যদি ছবিখানা বেচতে পারত! ... “নাহ,
যেভাবেই হোক এ কাজটা ওকে করতেই হবে। শুধু তো টেস্ট না... তারপর ওষুধ আছে...
ডাক্তার আছে... কদিন একটু যত্ন... ভালো খাওয়া দাওয়া... অনেকটা খরচ... অনেকগুলো
টাকা লাগবে”... মৃণাল ক্যানভাসে মন দিল।
রাত্রি
কত হয়েছে, খেয়াল নেই, ঘঙ-ঘঙে কাশির আওয়াজে মৃণাল ধড়ফড় করে উঠে পাশের ঘরে ঢুকে দেখে,
মায়ের সে এক ভয়ানক চেহারা... হাপরের মতো ফুলে ফুলে উঠছে রোগা শরীরখানা... দু’গালের
কষ বেয়ে রক্ত... গলা বুক চাপ চাপ রক্তে ভেসে গিয়েছে একেবারে... তাকানো যায় না! ছুটে
কোনোরকমে একখানা কলাইয়ের বাটি মা’র মুখের কাছে ধরতে কাশির দমকে আবার কয়েক দলা রক্ত উঠে এলো। কীরকম একটা
অদ্ভুত গাঢ় লাল রং... আঁশটে গন্ধ... কষ কষ
লালা মেশানো... এ ক’বছরে কত রকমের রং ঘেঁটেছে মৃণাল, কিন্তু
কই এমন একটা লাল, চোখে পড়েনি তো কখনো! কেমন একটা নেশা আছে এই লাল রংটায়... একটা আশ্চর্য
রকমের ঘোর লাগানো...
***
“এক্সেলেন্ট
মৃণালবাবু... এক্সেলেন্ট... আরে এক্স্যাক্টলি
এই রংটা... এই লাল রংটাই হামি চাইছিলাম! কোত্থেকে পেলেন বলুন তো কালারটা?
এক্কেবারে ইউনিক! বহড়িয়া লাগছে এবার... বহুত বহড়িয়া”।
“টাকাটা
কি আজকে দেবেন তাহলে? আমার একটু লাগতো”। – কিছুটা স্বস্তি মেশানো গলায় মৃণাল জিজ্ঞেস করল।
“হাঁ,
হাঁ... আজ হি পেয়ে যাবেন। টেন থাউসেন্ড অ্যাডভান্স। তবে এই একখানা ছবিতে তো হবে
না, আরো সিক্স পিস ছবি হামাকে বানিয়ে দিতে হবে। তাড়া নেই, এই মান্থটা সময় লিন। তবে
মোটিফটা সেম রাখবেন। ব্ল্যাক এন্ড ওয়াইটে উইমেন ফিগার, উইথ রেড সিন্দুর, বিন্দি,
আলতা, শাঁখা পলা... ওই টিপিক্যাল বেঙ্গলি ব্রাইড আর কি। পার পিকচার ফিফটিন
থাউসেন্ড করে দোবো। তবে আমার ওই একটাই কন্ডিশন আছে, লাল রংটা যেন সেম-টু-সেম হয় মৃণালবাবু... ওটা লিয়ে কিন্তু বিলকুল কম্প্রোমাইজ চলবে না”।
কড়কড়ে
পাঁচখানা দু’হাজার টাকার নোট নিয়ে মৃণাল বাড়ি ফিরছিল যখন, তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। সামনে অনেক কাজ... ছ’টা
ছবি... প্রায় লাখ খানেক মতো টাকা পাওয়া যাবে। গলির মুখে পলিক্লিনিকের সামনে এসে
মা’র প্রেসক্রিপশনটা পাঞ্জাবীর পকেট থেকে বার করেও কী ভেবে আবার সেটা ঢুকিয়ে রাখল। এতগুলো দিন গেলই যখন, তখন আর
মাস খানেক... ছবিগুলো আঁকা হোক... তারপর’ই না হয়...
রেসর্ট
মালিকের শেষ কথাগুলো মনে পড়ে গেল মৃণালের -- “লাল রংটা যেন সেম-টু-সেম হয় মৃণালবাবু... ওটা
লিয়ে কিন্তু বিলকুল কম্প্রোমাইজ চলবে না!”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন