ধর্ম
আধো অন্ধকার। গম্বুজাকৃতি ছাদের ঠিক
মাঝ থেকে ঝোলানো পবিত্র মোমবাতির ঝাড়। উপাসনাগারে বড় ছোট
ঘণ্টাগুলি নিশ্চুপ। খোলা জানালা দিয়ে পবিত্র দুধ ও বেলপাতার মিশ্র গন্ধ। গোল
টেবিলের চারপাশে পাঁচ সদস্য। স্বামী পবিত্রানন্দ, পূর্ণানন্দ, অমরানন্দ, পরিত্রানানন্দ ও স্বামী মত্যানন্দ। সবাই
অনেকক্ষণ ধরে মৌন। ধর্ম আলোচনার আগে দুই ভুরুর মাঝে আজ্ঞাচক্রে দেহাত্মা ও
পরমাত্মার যোগে ধ্যানমগ্ন।
এক সদস্য, স্বামী মত্যানন্দ হঠাত্
নড়ে উঠলো। ক্রমে তার জিভ দিয়ে লালা ঝরতে লাগলো। মুখ দিয়ে শব্দ হতে লাগলো হ্যা হ্যা
হ্যা হ্যা হ্যা...
-সকালে আমি বিশেষ কাজে বাইরে গেছিলাম। ওকে প্রাতঃকৃত্য
সারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো কি?
পূর্ণানন্দের অস্বস্তিভরা ও উদ্দেশ্যহীন গলা। স্বামী
পরিত্রানানন্দ বললেন, -‘আ-আমি চেষ্টা
করেছিলাম, পারিনি। আসলে ও আমাকে ঠিক পছন্দ করে না’। স্বামী অমরানন্দ গম্ভীর, -‘যাক গে, যা হবার তা হয়েছে, এখন
গুরু বন্দনা শুরু হোক’।
সবে গুরুবন্দনা সম্মিলিত কন্ঠে শুরু হয়েছে, এমন সময় ‘ভ্যাট’ শব্দ করে
মত্যানন্দ বিষ্ঠা ত্যাগ করে ফেলল। স্বামী
পবিত্রানন্দ উঠে দাঁড়ালেন। নাকে কাপড় দিয়ে বললেন, –‘আপনারা
যাই বলুন,আমার শুরু থেকেই এ ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ নয়। জীবে দয়া আমারও কম নেই, তা বলে এই রকম বিচ্ছিরি অ্যাডাপসন আমার মোটেই বরদাস্ত হয় না। আমি বুঝি,
দু’বেলা খাবার জোটানোর জন্য একটা ট্রাষ্টির উদ্ভট কিছু মিথ্যাচার মেনে চলতে হয়, কিন্তু তা বলে এই! ছিঃ!’
স্বামী পূর্ণানন্দ বিমর্ষ গলায় বললেন, –‘কী রকম মিথ্যাচার?’
-এই মিথ্যাচার যে কুকুরটা পরম ভক্ত, জ্ঞানী। আমিষ ছোঁয় না। সর্বদা পবিত্র থাকে। যত্তসব! একটু যদি হাইজেনিক হন, একটু যদি মনুষ্যত্ব থাকে আপনাদের! ধর্ম তো দূরে থাক।
স্বামী পবিত্রানন্দ চলে গেলেন। স্বামী পূর্ণানন্দ সবার মুখে
চোখ বোলালেন। -‘দেখলেন তো কী বলে গেলেন? ওঃ ভগবান! উপাসনায় বিভ্রাট এই প্রথম। আমার হয়েছে মরণ। ট্রাস্টি ওটার দেখভাল
করার ভার আমাকেই দিয়েছে। গত জন্মে যে কী পাপ করেছিলাম! এখন
কুকুরের গু আমাকেই সাফ করতে হবে!’
অমারানন্দ আবেগহীন গলায় বলে উঠলেন, -‘আমিও কিন্তু ব্যাপারটা পছন্দ করি না। জনগণকে খুশি করতে এসব চলে, আমি জানি। সত্সঙ্গ সেই জনতার সাথে হলে মোতিকে রাখাতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু এই একান্ত সময়ে ওকে কেন রাখা? এ কী ঈশ্বর আরাধনা
না কুত্তা ট্রেনিং প্রোগ্রাম?
পরিত্রানানন্দ বললেন, -‘সত্যিই তো! ঈশ্বর প্রাপ্তির আশায় ঘর ছেড়েছি। জনগণ তুষ্ট করার জন্যে নয়।
অমারানন্দ অস্বস্তিভরে বললেন,- ‘ আর দেখুন স্বামীজি, এই কুকুরটাকে দেখলে কেমন নিজের
কথাই মনে হয় না? কেমন যেন ভয় হয়। মোতির যদি সত্যিই ধর্মে মতি
আছে, যদি সত্যিই ওর আধ্যাত্মিক জ্ঞান আছে, তাহলে তো তার মানে এই দাঁড়ায়, গত জন্মে ও ব্যাটা
মহা সাধু ছিলো, কিন্তু ভন্ড, লোক ঠকাত। এ জন্মে কুকুর
যোনি...। স্বামীজি আ আ আমি কিন্তু
পরজন্মে কুকুরত্ব প্রাপ্ত হতে চাই না।'
স্বামী পূর্ণানন্দের ভয়ার্ত গলা ‘ওঃ ভগবান!আমিও চাইনা কিন্তু জনগণ...’
স্বামী পরিত্রানানন্দ রেগে দাঁত চিপে বললেন ‘জনগণ তো ওই বিচ্ছিরি কুকুরটার পায়ের ধুলো নিচ্ছে,
পাদদক খাচ্ছে। শ্লা মনে হচ্ছে যেন ধর্ম
নিজেই কুকুর যোনি প্রাপ্ত হতে চলেছে’।
স্বামীজির কথা শেষ হতে না হতেই এক অলৌকিক কান্ড ঘটলো।
মত্যানন্দ ভয়ানক কেঁউ কেঁউ মরণ ডাক ডেকে উঠল। চেয়ারের ওপর কালো বিষ্ঠা ধীরে ধীরে
আকারে বাড়তে লাগল। একটি থকথকে জেলির মতো
চলমান বস্তু, ক্রমবর্ধমান। একসময় সেটা নিঃশব্দে ফেটে
গেল। তার ভিতর থেকে পিলপিল করে বেরতে লাগল খুব ছোট ছোট মানুষ। তাদের চোখ নেই। চোখের
বদলে পুরু চামড়া। অন্ধ মানুষেরা হামাগুড়ি দিয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। স্বামীজিরা চার
হাতে পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে জনস্রোত আগলাতে চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু বৃথা। জনস্রোত
তখন দরজা খুলে বাইরে পিলপিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন