পাঁচ দশে পঞ্চাশ
আমাদের গড় আয়ুটাই কম। ভেবে দেখলাম বাবা পঞ্চাশে, ফুফুআম্মা পঞ্চাশে বড় চাচা পঞ্চাশে এবং শেষে দাদাভাইয়া চলে গেলেন সেও পঞ্চাশে। এভাবে কেনই বা তারা পঞ্চাশের পর এক পাও থাকবেন না এরকম জিদ করে বিদায় হলেন তা জানা গেলো না। কেন না বলার মতো কেউ তো ছিলোও তো না। যে টিমটিম করে মেঝকাকা জ্বলছিলেন কালের নিদর্শন হয়ে , তাকে জিজ্ঞাসিবার সাহস হলো না বৈকি। তাকে জিজ্ঞেস করতে গেলে যদি সেও সকল থুয়ে চলে যায় আমি একলা হয়ে যাবো, এই ভেবে তখন আর কিছুই বলা হয়নি। আমিও বেশ গুছিয়ে অক্কা পাবার জন্য রাত দিন অপেক্ষা করছি, ঠাসবুনটের দোলনায় পেছনে হেলছি, সামনে আসছি। ব্যস্ততার ভঙ্গি দেখাচ্ছি কিম্বা সব কথা কাঁধে মাথা রেখে হেলান দিয়ে বলে চলেছি, সময় এক তুই জানিস। দূর থেকে পঞ্চাশের ক্লান্ত আয়োজন দেখা যায়। এই তো পঞ্চাশ এলো বলে।
এর মধে যে দুই একবার ডাক পাইনি তা কিন্তু না। একবার কি হয়েছে, রোকেয়া হলের সামনেই এক ছাত্রী বাইক থেকে পড়ে গেছিলো একগাদা বৃষ্টি কাদার মধ্যে। বাইক যিনি চালাচ্ছিচ্ছেন তিনি টের পেতে পেতে চলে গেছেন বহূদূর। মেয়েটিকে হিড়হিড় করে টেনে তুললাম রিক্সাতে। আসেপাশের গোল করে দাঁড়িয়ে থাকা আমার ভাই বেরাদারেরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সীমাহীন দায়িত্ব পালন করলেন। কী, নাকি মেয়েমানুষের গায়ে হাত দিতে নেই। উপভোগ করাটাও এক রকমের কর্তব্য বটে। সেই বারই প্রথম মাথা ঘুরে হসপিটালে পড়ে যাই। আমার অসুখটা সেবারই ধরা পড়ে।
আরেকবার ডিঙ্গি করে ঘুরতে গেছিলাম। সারাটা ডিঙ্গি ফুলে সেজেছে। আমার মন উচাটন পাহাড়ের প্রতিবেশী। আর আমি মাঝখানে। কিছু দূর যেতে না যেতেই ডিঙ্গির দোলায় আমার মাথা বোঁ করে পাক খেতে লাগলো। আমি ছেলেবেলার ছায়াছন্দে দেখা অলিভিয়ার মতো করে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে গেলাম পরদেশী মেঘের অপেক্ষায়। আকাশের উপরের দিকে আগ্রহ ভরে চেয়ে রইলাম, ভাবখানা, আমাকে দেখতে পাচ্ছো না এ কথা বলো না প্রভু। এইবার আমাকে নিয়ে মানে মানে নিয়ে কেটে পড়। কিন্তু উপরতলার বাসিন্দা কবেই বা মাঝখানের নগণ্য ডাকে সাড়া দিয়েছে! দুই দুইবার ফিরে এলাম ভুলভুলাইয়া থেকে। বন্ধ হয়ে থাকা ঘড়ির কাটায় দিন মাস ঘন্টা সেকেন্ডগুলো কিন্তু ঠিকই নড়েচড়ে।
এর ঠিক ক’দিন পর এক দুপুরে আমি বায়তুল মোকাররম থেকে ফিরছি, হঠাৎ দেখি রিকশা দিয়ে দাদী অনেকটা গলা বের করে তাকিয়ে আছে। চোখে পুরু লেন্সের চশমা মুখে রিরক্তি, ‘অই মিমি কই যাচ্ছিস?’ আমি সোজা থ’ মেরে গেছি। প্রথমে কিছুক্ষণ না বুঝলেও মিনিট দু’য়েকের মধ্যেই আমি ঘটনা বুঝে গেছি। দাদী আর রিকশা এ তো অসম্ভব! দাদী পা ভেঙ্গে ফেলেছেন মোট চারবার। পা ভেঙ্গে ভেঙ্গে দাদীর সাহস দিন দিন বাড়তেই আছে, বাড়তেই আছে। তাকে পা টিপে টিপে ছাদ থেকে শাকপাতা আনতেই হবে, মেলে দেয়া কাপড় মাঝদুপুরে উলটে দিতে হবে, আচারের বোয়েম ঘুরিয়ে দিতে হবে, হবেই।
এরমধ্যে একদিন দাদী টিভির সাথে ফ্রি পাওয়া রিমোট চেয়ে নিলেন ভালমানুষের মুখ করে। ওমা! তারপর থেকে আর রিমোট দেয় না। কেন? আমি নাকি পড়া বাদ দিয়ে ছায়াছন্দ দেখবো, ছায়াছন্দ দেখে দেখে নাকি আমি পাকা প্যয়রা (পেয়ারা ) হয়ে গেছি।
মাধবকুণ্ডের চাক চাক করে কাটা যে সিঁড়িগুলো ধাপে ধাপে নিচে নেমে গেছে তার শরীরে পা দিয়ে টপকে চলতে চলতেই ফোনটা এলো। দাদী আমার চরকাবুড়ি দ্রুত নিচে নেমে গেছেন পর পর সিড়ি বেয়ে বেয়ে। তার হাতে ক্র্যাচ ছিলো না, লাঠি ছিলো না, কিচ্ছু না। সে আমাদের মঞ্চকে বুড়ো আঙ্গুল নির্দেশ করে রঙহীন বাতাসের দাপটে মিলিয়ে গেলেন। বাতাস আর চরকা আমার হাতেই ঘুরছে, এই দেখ।
ইথার থেকে ভাবনা আসে, কন্ঠ আসে, বইয়ের পাতায় চ্যাপ্টা হয়ে থাকা সঙ্গমের ইচ্ছা আসে চুপচাপ। সারারাত ট্রেনটা ঘন হয়ে কানে কথা বলে। সকালে চোখ মেলে দেখি স্টেশন চিনি না। সেখানে আমাকে কেউ চেনে না, সাথে কেউ নেইও আমার জন্য। ধোঁয়া ওঠা এক কাপ গরম চা গলা বেয়ে নামতে থাকে সন্তর্পণে। আমি জিন্সের প্যান্ট হাঁটুর কাছে উঠিয়ে চা-বাগান ঘুরে বেড়াই ঝাঁসি কী রানী। সব কথার খেই তাঁবুতে রেখে পরের ট্রেনে ফিরে আসি ঊনপঞ্চাশেই। পঞ্চাশ অব্দি আর থাকা হবে না, দেখিস!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন