চারণকাব্য
জোনাকির সাথে ‘পোকা’
শব্দটি সুখন সরকার একদম সইতে
পারেন না। শুনলেই শ্বাসকষ্ট। ফুসফুস নয়, স্নায়ুর ভেতর শ্বাসের বাতাস টের পান। সেখানে একটানা
শোঁ শোঁ শব্দ। তাঁর বাতিক বলা যেতে পারে। ঠিক পাগলামী নয়।
ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি। প্রলম্বিত বর্ষা। বৃষ্টির কান্না থামিয়ে সন্ধ্যার হু হু বাতাস বইছে। পদ্মগন্ধী।
আলো নিভে গেলে ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি উড়ছে বিলের ওপর। সেদিকে
তাকিয়ে সুখন সরকার। ভাবছেন কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় বসে পিয়ারীর মেহেদী দেয়ার দৃশ্য। এত কিছু কী আর
বুঝেছিল মন! উথাল পাথালের
ব্যাখ্যা জানার বয়স তো তখন নয়।
মুগ্ধতার আড়ালে হৃদয়ের ক্ষত গাঢ়তর লাল তারপর কিছুটা ফিকে। বুঝতে বহু
বছর গড়িয়েছে। মন পুরনো জাল ফেলে নদীতে। সে নদীর নাম দিই জীবন। ভাটার টান ধরেছে অস্তমিত সূর্যের
ইশারায়। মৃত মাছদের সাথে কিছু জীবন্ত চিতল বোয়াল ভুস করে। জল আর জল
তবুও খাবি খায় আর সুখন সরকারের মনডিঙ্গি ঘুরে ঘুরে ঘাই মারে। কত কালের
বন্ধুতার খবর নিয়ে যায়।
এ যদি
কল্পমায়া হয় তবে অনেকটাই সরল। কায়ার রূপ ধরে যা কিছু হয়ে উঠতে চেয়েছিল তাকে বলি বাল্যের খেলা। সুখন সরকার ঠাণ্ডা, পুরনো, ঝিম ধরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই কৃষ্ণচূড়ার
ছায়াঘোর খুলে যায়। নির্জনে মেহেদীর
নকশা আঁকছে পিয়ারী। মোমের মতো স্নিগ্ধ
দুহাতের পাতা। শবে
বরাতের রাতে বলেছিল- মেহেদীর রঙ জিলহজ্ব মাসের চাঁদকে দেখাবে। তবে নাকি মনস্কামনা পূর্ণ হয়। সে হবে প্রায় তিন
মাসের ব্যাপার। এত দিন কি রঙ
থাকবে? পিয়ারী হেসেছিল। হাতে না থাকুক নখে তো থাকবে!
পিয়ারীর মন বড় অদ্ভুত। সুখন চোখ ভরে দেখে সে মন। পাটখড়ির বেড়ার ফাঁক দিয়ে। কী আছে মনে, সবটুকু কি আর দেখা যায়? কিছু তার অনিশ্চিতের স্তরে
থমথম করে। বাকিটুকু অস্থিরতার রোদে। রোদের পর কুয়াশা ঘন হয়ে জমেছে সুখনদের পুকুর পাড়ে। একটি
দ্রুত চুমু। এর বেশি নয়। ততদিনে মাঘের সন্ন্যাস নিয়ে শীত চলে গেছে গারো পাহাড়ের
পেছনে। উত্তরের হাওয়া দিক বদলে দখিন দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে।
ফাল্গুনের পূর্ণিমায় দোর খুলে
দেয় পিয়ারী আর মাটির হাঁড়িতে গাইয়ের দুধ রাখে ঝোপের ভেতর। শঙ্খচূড় সাপ
দেখার আশায়। ডাকাবুকো মেয়ে। সুখনের কি ভয় তখন! পূর্ণিমার আলোয় সব কেমন ধোঁয়া-ধোঁয়া। রাত্রির অচেনা আলোয় কাঁপে পিয়ারীর মুখ। সে আলোয় সম্মোহিত হয়ে শঙ্খচূড় যদি ছোবল দেয়! পিয়ারী হাসে। বলে- গলা শুকাইয়া গেসে? পানি খাইবা না জল?
কী যে খেলো
সুখন, জল না পানি, কে তার হদিস রেখেছে? ঝিমধরা নীরব দুপুর, সুখন তাকিয়ে দেখে তালপুকুর দাপিয়ে কেমন সাঁতরায় পিয়ারী আর ভেজা গামছা
গায়ে জড়িয়ে হাঁসগুলোকে ডাকে আয়-আয়-চই-চই। সরকার বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে কয়েক ধাপ উঠে গেলে, ছাদ থেকে
কারো ঘুড়ি মেঘ ছাপিয়ে ওই আশ্চর্য উঁচুতে। তার হাতের লাটাইয়ে পিয়ারীর বুকে বিষম টান লাগে। ধারাল সুতায়
জড়িয়ে মড়িয়ে একাকার। রক্তিমাভ দুটো চোখে দুফোঁটা জল টলমল করে। কিন্তু ঝরে না। কচি লাল শাকের ওপর যেমন দুলছে
শিশির। জানেই না মনকেমনের যাপন শুরু হলো। সমস্ত জীবন সে তালিকায়
যোগ হবে আরও কষ্টব্যাকুল উদযাপন। অবশেষে ভোঁ-কাট্টা।
থৈ থৈ জলে সুতা বদলে যায়। বারোয়ারী সংসারে
ঘুড়ির সুতা লাটাই ছেড়ে সেলাইয়ের সুঁচে ঢুকে যায়। বর্ষায়
গেরস্ত বাড়ি জলমগ্ন হয়ে ঝিমায়। উদাস প্রতিটি ফোঁড়ে
পিয়ারী আঁকে আনন্দ-বেদনা, মনের অলিগলির দিন-রাত্রির চিত্র। কুটুমপুরেও হয়তো জিলহজ্ব মাসে চাঁদ ওঠে। পিয়ারী সে খবর রাখে না।
সেকাল গিয়ে একাল এলে ওরা ভুলে যায় বাল্যের খেলা। হয়তো মাঝে মাঝে ঢেউ ওঠে। ঢেউয়ে কারও মুখশ্রী, জীবিত এবং মৃত মাছদের সাথে ভাসে অথবা ডুবে যায়। জন্ম হয় কাব্যগাথার অসংখ্য কারুকাজ। পদাবলীর যে বেদনাটুকু আজ আব্দি লেখা হয়নি তার কারণ
হতে পারে ভাষার সামর্থ্যের অভাব। হৃদয়ের অক্ষমতা কোনোদিন নয়। অদৃশ্যত, হৃদয় অবিরাম ধোঁয়া
উড়িয়েছে দহনবাতাসে। তবুও অনিঃশেষের অংশ হয়ে রয়েছে। পোড়-খাওয়া টুকরো
কিছু জুড়োয় পূবালী বাতাসে যখন বিলের ধারে
বসেন সুখন সরকার।
একটি অভিনব দৃশ্য দেখছেন। জোনাকিগুলো
জলের ওপর উড়ছে। একেকটি জোনাকি একবার দুটি হয়ে যায়। আবার একটি। পরক্ষণেই দুটি। বিলের জলে জোনাকির ছায়া পড়েছে। ছায়ার আর বাস্তবের দুটো জোনাকি। জল আর হাওয়ায় এক
সাথে চলছে। কচুরিপানার ওপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় দুটি জোনাকি একটা হয়ে যায়। আবার জলের ওপরে এলে একটি জোনাকি দুটি
হয়ে যায়।
একক যা, মুহূর্তেই দ্বৈত। দ্বৈততার পর একাকীত্ব। জীবনে, কখনো কখনো, জোনাকিরা আমাদের
এভাবে বিভ্রান্ত করে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন