মার্বেল
মিমি বাড়ি থেকে বেরুবার আগেই বৃষ্টি ধরে গিয়েছিল। ড্রাইভওয়ের বেশ খানিকটা
দূরেই ট্যাক্সিটা থামাতে হলো। রাস্তার দু’পাশেও গাড়ির ভিড়। ভাবি বাঙালিদের সব্বাইকে ডেকেছেন! তার বোন, বোনের বর এসেছে ট্যাক্সাস থেকে। বোনের বর আবার গায়ক।
সম্প্রতি তাঁর ক্যাসেট বেরিয়েছে। সেই ক্যাসেট বিক্রির জন্যেই আজকের আয়োজন।
জল ছপছপ ঘাসের ওপরেই পা ফেলে আড়াআড়ি এগোলো মিমি। স্লিপারের
ওঠানামার তালে জলের ছিটে সেলোয়ারের পেছনে বাটিক ছাপ দিচ্ছে নির্ঘাত। শাড়ি পরার সময় পায়নি ও।
তাড়াহুড়োতে জুতোটাও ঠিকঠাক মেলানো হয়নি।
দোষটা মিমিরই। কাল রাতে মেইল চেক করেনি। সকালে ল্যাবে ঢুকেই জানলো
পৌনে পাঁচটায় সুপারভাইজারের সাথে মিটিং। একবার ভেবেছিল পাল্টানোর অনুরোধ করবে। দীর্ঘদিন পরে
পড়াশোনায় ফের ফিরলো মিমি।
সুপারভাইজারের কাছে ওর নিষ্ঠার ভিত মজবুত করাটা জরুরি। দ্বিধা ঝেড়ে মিটিংএর কথা জানালো সুভাষকে।
টেলিফোনের ওপ্রান্তে সুভাষ চুপচাপ শুনলো। তারপর
নির্বিকার জানিয়েছিল, ও একাই চলে যাবে, মিমি আসুক মিমির সময়মতো।
ল্যাব থেকে বেরোতেই ঝুম বৃষ্টি। ঘড়িতে তখন সাতটা ছুঁইছুঁই!
বাড়িতে ঢুকতেই চোখ আঁটকালো সিংকে। বাসনকোসন ডাঁই করা। সুভাষ কুটোটি নাড়েনি। মিমি খুব গোছানো
অথচ ইদানিং সব কেমন ল্যাজেগোবরে হয়ে যাচ্ছে। বিনা কারণেই চোখ উপচে জল গড়াতে লাগলো।
দুটো নাম কানের কাছে ঘুরপাক খাচ্ছিলো অবিরাম; অর্চি, শুভম। মেয়ে হলে অর্চি, ছেলে
হলে শুভম। তারস্বরে ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলো, ঘড়িতে তখন সাড়ে আটটা! ফোনের
ওপ্রান্তে সুভাষ। ‘এত দেরির মানে কী?’
মিমি ঝটপট চুড়িদারটা গলিয়েই ট্যাক্সি ডেকেছিল। ইস্ ভাবি পইপই করে বলেছিল
শাড়ি পরতে!
আলতো ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল। বসার ঘরের আলো কমানো। কোণে
কোণে সুগন্ধি মোমবাতি। নকশাদার মোমদানির মায়াবী ছায়ার কোলাজ কাঁপছে দেয়াল জুড়ে!
‘কেউ সুখি হয় কেউ হয় না’ গাইছেন শিল্পী। মিমি চুপচাপ পেছনে বসতেই ধরা খেল।
‘এতক্ষণে এসেছে!’ পিয়ালি ভাবি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। বেচারা শিল্পী গান থামিয়ে
বোঝার চেষ্টা করছেন, কে? কী?
গান শেষ হতেই সবাই ডাইনিংএ। সুভাষ আরও ক’জনের সাথে হুইস্কিতে মগ্ন। ভাবি মাংসের
বাটি বের করতে করতে বললেন, ‘খেয়ে উঠেই একটা শাড়ি পরে নিবি। ছবি তোলা হবে শিল্পীর
সাথে’। মধুবন্তী
ছিল কাছেই। ভাবির কথা শেষ হতেই হইহই করে উঠলো, ‘না না খাওয়ার আগেই ফটোসেশন। নইলে
লিপস্টিক মেইক-আপ সব বসে যাবে’! দুই
বাচ্চার মা। কিন্তু আহ্লাদে ষোড়শী। মিমি ওকে এড়িয়ে চলে। ‘আরে দিদি হলো দীপিকা
পাড়ুকোন। শাড়ি না পরলেও চলবে’। ধাঁ করে মেজাজ চড়ে গেল মিমির। পিয়ালি ভাবিকে বললো, ‘শাড়ি
দাও’।
পিয়ালি ভাবি ক্লজেট মেলে দিয়েছিলেন, ‘যা ইচ্ছে পর্’। ভাবির ব্লাউজ
ওর গায়ে ঢলঢল করছিল। গায়ে আঁচল তুলে মিনিট দশেক পরে যখন ফিরলো সুভাষের চোখেই চোখ
পড়লো প্রথম! শেষ কবে এমন মুগ্ধতায় দেখেছিল সুভাষ!
তিন বছর ধরে ওদের জীবন অন্যরকম। জরুরী অপারেশনটা করতেই
হয়েছিল। বুকের ভেতরে মিমির তখন অবিরাম ঘুঘুর মাতম। ঘুম উধাও। এক সুরে একই
অনুরোধ, ‘একটা বাবু এনে দাও সুভাষ!’ সুভাষ
চুপচাপ উঠে যেত। একদিন বিকেলে আচমকা বললো, ‘বাচ্চাকাচ্চা কেন! তারচে’ বেড়াল পোষো
কিংবা কুকুর’। বাচ্চা
নয় কেন? ‘কাকের বাড়িতে ডিম ফুটলেও কোকিল কখনো কাক হয় না’। মিমির হাহাকার
নিমেষে অলঙ্ঘ্য কাঁটাতারে পাল্টে গিয়েছিল!
ফোটো তোলা শেষে ক্যাসেট বিক্রির পালা। মিমির হাতে ক্যাসেট
দিতে গিয়ে শিল্পীর স্ত্রী বললেন, ‘আপনি দেখতে ঠিক বোম্বের নায়িকাদের মতো!’
মধুবন্তী ফোঁড়ন কাটলো, ‘বাচ্চাকাচ্চা
হওয়ার আগে বোম্বের নায়িকাই থাকে সবাই!’ মিমি চোখের জল সামলাচ্ছিল প্রাণপণে আর তখনই
নজরে এলো মাথাটা। হাঁসের
ডিমের মতো চকচকে মসৃণ! মাথার পেছনে হয়রান
একগোছা চুল। মধুবন্তীর কথাটা একলা মার্বেলের মতো মেঝেতে তখনো গড়াচ্ছে আওয়াজ তুলে।
মিমি হঠাৎ আনমনে বলে উঠলো, ‘বাচ্চা হওয়ার
বাক্সই যে নেই আমার’। আশ্চর্য
সাথে সাথেই মার্বেলটা থেমে গেল। চারপাশে পিনপতন নীরবতা। পিয়ালি ভাবি কী ভেবে ডাইনিঙের
ঝাড়বাতিটা জ্বালালেন তখুনি। অমনি মিমি
দেখলো চকচকে ডিম মাথাটার ওপর আলো পিছলে একটা হাঁসের ছানা উড়াল দিল যেন! কী সুন্দর!
কী এক খুশিতে মন ছেয়ে গেল মিমির। ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো হঠাৎ। হাসি কি সংক্রামক?
সবাই কেমন হাসছে ওর সাথে! বেচারা শিল্পী হাসতে হাসতেই তার ডিম মাথাটায় সেই এক গোছা
চুল লেপ্টাচ্ছেন অদ্ভুত কায়দায়। শুধু সুভাষ হাসছে না। আই ফোনে গুগল সার্চে খুঁজছে
‘ডিরেক্টর ওফ চাইল্ড এডপশনের’ ঠিকানা। মার্বেলটা ওর মগজ ঠুকে গড়াচ্ছে এখন!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন