শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

কালিমাটি অনলাইন / ৪৭


বিষয়টা এখন নিতান্তই ক্লিশে হয়ে গেছে, তবে আমার ইস্কুল জীবনে বাংলা পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে রচনা লেখার জন্য এই বিষয়টা ঘুরে ফিরে প্রায় প্রতি বছরই আসত – ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপতা বিষয়টা নিতান্তই কমনহওয়ার দরুন আমরা ছাত্র ছাত্রীরা মোটামুটি প্রস্তুতই থাকতাম। এবং যদিও সেই নিছক  ছেলেবেলায় আজকের যুগের ছেলেমেয়েদের মতো তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণস্পর্শ বিন্দুমাত্র পাইনি, কিন্তু তাসত্ত্বেও রীতিমতোই বিশেষজ্ঞের মতো বিজ্ঞানের  আশীর্বাদের বিশদ বর্ণনা উপস্থিত করে মন্তব্য করতাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে অ্যাটম বোমা বর্ষণ কিন্তু বিজ্ঞানের অভিশাপকেই প্রমাণ করে। বস্তুতপক্ষে এই ধরনের আরও অনেক তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরতাম সেই রচনায়, যা বিজ্ঞানের আশীর্বাদের পাল্লা থেকে অভিশাপের পাল্লাটাই ভারি করে তুলত। কিন্তু সেইসঙ্গে একথাও উল্লেখ করতাম যে, দোষটা আদৌ বিজ্ঞানের নয়, বরং বিজ্ঞানকে যারা যে কৌশলে ধ্বংসাত্বক কাজে প্রয়োগ করে তাদের। অর্থাৎ প্রযুক্তিবিদদের। এই সরল কথাটা তো আমরা সবাই জানি যে, বিজ্ঞানের কোনো গুণ বা দোষ থাকার প্রশ্নই অবান্তর। বিজ্ঞান হচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়ম, যে নিয়মে বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ড সৃষ্ট ও পরিচালিত হচ্ছে। এই নিয়মে কোনো বেনিয়ম নেই। আর যদি কোনো বেনিয়ম ঘটে, তা প্রাকৃতিক কারণেই ঘটে, এবং তার পেছনে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণই থাকে, অন্য কোনো কারণ নয়। কিন্তু বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে যে প্রযুক্তি গড়ে উঠেছে, তা একান্ত ভাবেই এই পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষেরই কৃতিত্ব। এবং নৈতিকতা বলে, সেই প্রযুক্তি এই গ্রহের কল্যাণেই ব্যবহার করা উচিৎ। আর গণ্ডগোলটা এখানেই। বিজ্ঞান যেহেতু মানুষের অধীন নয়, তাই বিজ্ঞান তথাকথিত আশীর্বাদ এবং অভিশাপের উর্ধে। কিন্তু প্রযুক্তি মানুষেরই সৃষ্টি এবং তার পরিচালনার চাবিকাঠিও মানুষেরই হাতে। আর তাই সেই প্রযুক্তিকে আশীর্বাদ অথবা অভিশাপ কীরূপে প্রয়োগ করা হবে, তার নির্ণায়কও মানুষ। যেমন হয়তো অনেকেই শুনেছেন, আমিও শুনেছি, এই বিশ্বের এক বিশাল শক্তিশালী দেশের অন্যতম প্রধান উৎপাদন হচ্ছে সমরাস্ত্র। এবং এই সমরাস্ত্রকে কেন্দ্র করে সেই দেশের অর্থনীতিও আবর্তিত হয়। সুতরাং দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে সেইসব সমরাস্ত্রের কেনাবেচা খুব জরুরী। আবার কেনাবেচাকে সচল রাখতে যুদ্ধও খুব জরুরী। আর তাই মাভৈ! সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দাও যুদ্ধের উন্মাদনা! লড়িয়ে দাও এক দেশের বিরুদ্ধে আর এক দেশকে! লড়াইয়ের জন্য অস্ত্রের অভাব হবে না! আমরা তো দোকান খুলেই বসে আছি!  তোমরা তোমাদের দেশের জনসাধারণের টাকায় সেইসব অস্ত্র কিনে নিয়ে যাও! তোমরা বাঁচো অথবা মরে যাও, কিন্তু যুদ্ধটা জারি রাখো!

সম্প্রতি প্রযুক্তির তথাকথিত অভিশাপের একটা ছোট্ট নমুনা পাওয়া গেল পশ্চিমবাংলাতেও। নিতান্তই কম বয়সী একটা ছেলে, তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে আদৌ কোনো জ্ঞান আছে কিনা জানি না; কিন্তু তা বলে তো ব্যবহারে কোনো বাধা নেই!  আর সে সেটাই করে বসল। ছেলেটা হয়তো নেহাতই গাড়ল, অথবা নিতান্তই বদ, অথবা এমনও হতে পারে তার পেছনে কিছু অমানুষের মদত ছিল, যে জন্য তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে এমন একটি কার্টুনচিত্র ইন্টারনেটে উপহার দিল, যা অত্যন্ত ঘৃণ্য, আপত্তিজনক ও ক্ষমার অযোগ্য। ছেলেটি নিঃসন্দেহে অপরাধী এবং তার শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তার থেকেও বেশি অপরাধী তারা, যারা এই অবাঞ্ছনীয় ঘটনার সুযোগ লুফে নিয়ে পরবর্তী অসামাজিক কাজকর্মে লিপ্ত হলো। আমরা আর কবে আমাদের সমাজ ও জীবন পর্যায়ে সচেতন হব? কবে বিজ্ঞানের যাবতীয় সত্যের সঙ্গে পরিচিত হব? কবে উপলব্ধি করব যে, এই বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ডে আমাদের কারও একক অস্তিত্ব নেই, বরং আমরা জড়িয়ে আছি প্রকৃতির অস্তিত্বের  সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে। প্রতিটি জড় ও অজড় উপাদানের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তার শেকড়বাকড় আছে জড়িয়ে। বলা বাহুল্য, জীবন ও জগতের এই সার সত্যটা বুঝে নেওয়া একান্তই জরুরী। আর তখনই একমাত্র সম্ভব হবে প্রযুক্তিকে শুধুমাত্র  আশীর্বাদ রূপে গ্রহণ করে তার কল্যাণস্পর্শ লাভ করা। 

পরিশেষে একটি বিনীত অনুরোধ কালিমাটি অনলাইনব্লগজিনের লেখক ও পাঠকদের কাছে। আমরা লক্ষ্য করেছি, কোনো কোনো লেখক তাঁদের লেখা কালিমাটি অনলাইনএ প্রকাশিত হবার পর সেই লেখাটি সরাসরি পোস্ট করেন ফেসবুকের পাতায়। এটা তাঁরা করেন, হয়তো আরও বেশি পাঠকের কাছে লেখাটি  পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমাদের অনুরোধ, লেখাট এভাবে পুনঃপ্রকাশ না করে বরং লেখাটির অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করে লেখাটির লিংক শেয়ার করুন। তাতে আগ্রহী পাঠকেরা অনলাইনে প্রবেশ করে লেখাটি পড়ার সুযোগ পাবেন। আবার একই সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, আগ্রহী পাঠকেরা তাঁদের  প্রিয় লেখকদের লেখা পড়ে ফেসবুকের পাতায় তাঁদের অভিমত লিপিবদ্ধ করেন। অথচ কালিমাটি অনলাইনএর প্রতিটি বিভাগে প্রতিটি লেখার নিচে কমেন্টবক্সআছে। কিন্তু সেখানে তাঁরা তাঁদের অভিমত লিপিবদ্ধ করেন না। এবং আরও দুঃখের ব্যাপার, লেখকরাও পাঠকদের উৎসাহিত করেন না ব্লগজিনের কমেন্টবক্সে অভিমত লিপিবদ্ধ করার জন্য। আসলে, ফেসবুকের পাতায় পাঠকদের অভিমত লিপিবদ্ধ হলে লেখকেরা যেমন তাৎক্ষণিক তাঁদের লেখা সম্পর্কে পাঠকদের প্রতিক্রিয়া জানতে পারেন, তেমনি  পাঠকরাও নিজেদের অভিমত ফেসবুকের  পাতায় দেখে খুশি হন। কিন্তু কেউ কি একবারও  ভেবে দেখেছেন, কিছু  সময়ের পরে সেইসব অভিমত ফেসবুকের বহমান স্রোতে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছেইচ্ছে করলেই কি তা আবার দেখার বা পড়ার সুযোগ ঘটে? ধরাযাক ২০১৬ সালের  জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত কোনো এক লেখকের কোনো একটি লেখা পড়ে পাঠকদের মধ্যে আলোড়ন পড়ে গেছিল। এবং পাঠকেরা সেই লেখাটি সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা সমালোচনা তর্ক বিতর্ক লিপিবদ্ধ করেছিলেন ফেসবুকের পাতায়। এখন এই ২০১৭ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে যদি কেউ সেইসব অভিমত খোঁজেন ফেসবুকের পাতায়, তা কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে?  আমি সত্যিই জানি না, সেই সব অভিমত পুনরুদ্ধার কীভাবে সম্ভব! কিন্তু  যদি সেইসব আলোচনা ব্লগজিনের কমেন্টবক্সে লিপিবদ্ধ থাকে, তাহলে অনায়াসে তা পাওয়া যায় ব্লগজিনের আর্কাইভে (মণিভান্ডার)। আশাকরি আমাদের প্রিয় লেখকেরা ও  পাঠকেরা এই ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন।

সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করি। সবাই ভালো থাকবেন।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :          
08789040217 / 09835544675
                                                        
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India



অদ্বয় চৌধুরী

ফ্রম জেমস বন্ড, উইথ ইডিওলজি



(সপ্তম পর্ব)  

কম্যুনিজম ও জেমস বন্ড

Listening to the news led easily into a pleasant discussion on the horrors of atomic warfare. Colonel Easterbrook said that the real menace to civilisation was undoubtedly Russia, and Edmund said that he had several charming Russian friends— which announcement was coldly received.”

 

            ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছে। একা রাশিয়া। ইতালি এবং কিছুটা জার্মানি বাদে সমস্ত পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ একত্রে তার বিরুদ্ধে। সঙ্গে তাদের দোসর আমেরিকা। এই লড়াই মূলত আদর্শগত। ক্যাপিটালিজম আর কম্যুনিজম-এর লড়াই। রাশিয়ার শক্তিবৃদ্ধি অর্থাৎ কম্যুনিজমের শক্তিবৃদ্ধি। ক্যাপিটালিস্ট বিরুদ্ধ-গোষ্ঠীর রাতের ঘুম ছুটে যাওয়া। তাদের অস্তিত্ব সংকট। সাধারণ মানুষকে কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে ক্ষেপীয়ে তুলতে জনপ্রিয় সাহিত্যকে ব্যবহার। এই সময় রাশিয়া-বিরোধী ও কম্যুনিজম-বিরোধী প্রচারের বহু উদাহরণ পাওয়া যায় ইউরোপীয় জনপ্রিয় সাহিত্যে। এগুলো অবশ্য রাষ্ট্রীয় ইডিওলজির পাশাপাশি ঠাণ্ডা যুদ্ধের প্রতি আপামর ব্রিটিশ জনসাধারণের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির উদাহরণও বটে। যেমন উপরের ওই উদ্ধৃতিটি। আর একজন বিখ্যাত ‘জনপ্রিয় সাহিত্যিক’ আগাথা ক্রিস্টির ‘আ মার্ডার ইজ অ্যানাউন্সড’ গল্প। ১৯৫০ সালে লেখা। সাধারণ মানুষের রাশিয়া-বিরোধী একপেশে মানসিকতার উদাহরণ। এরকম আরও বহু আছে। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সব প্রচারগুলো ছিল শুধুমাত্র সামান্য উল্লেখ হিসেবে। গল্পের গঠনে সেইভাবে কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব এই প্রচারগুলো বিস্তার করত না। পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটল ফ্লেমিং-এর মাধ্যমে।

ক্রিস্টির মতো ছোটো রেফারেন্স দেওয়ার বদলে ফ্লেমিং তার গল্পের ইমারতগুলিকেই তৈরি করে মূলত রাশিয়া-বিরোধী ও কম্যুনিজম-বিরোধী মানসিকতার ভীতের উপরে। পরোক্ষভাবে রাশিয়ার সমালোচনা এবং বিরুদ্ধ-প্রচার; মার্ক্সীয় তত্ত্বের একেবারে উলটো পথে হেঁটে পরোক্ষভাবে বুর্জোয়া ভোগবাদের প্রচার এবং উপাসনা— বন্ডের গল্পের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে। আগেই সেই গোপন ইস্তাহারগুলিকে সর্বসমক্ষে পড়ে ফেলা হয়েছে এই ধারাবাহিক প্রবন্ধের আগের কিস্তিগুলোতেতবে এই পরোক্ষ-ইডিওলজি, এই ‘হিডেন এজেন্ডা’ বাদ দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে কম্যুনিস্ট শাসনাধীন রাশিয়াকে নঞর্থক রূপে পরিবেশনের ‘ব্ল্যাক প্রোপাগান্ডা’ ফ্লেমিং-এর গল্পে, বিশেষত ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ গল্পে, ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে। ফ্লেমিং-এর দু’টি উপন্যাসে যথাক্রমে কাস্ত্রো এবং ফ্যাসিস্ট জার্মানিকে শত্রুপক্ষ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর বাকি সমস্ত কাহিনীতে সরাসরি রাশিয়া, অথবা রাশিয়ার মদত-পুষ্ট কোনো সংস্থা গোপন ও ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে নেমেছে “to shake the governments of the Western World”

ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ গল্পের প্রথম দিকের চ্যাপ্টারগুলোতে রাশিয়ার যে চিত্র আঁকা হয়েছে তা এক ভয়ঙ্কর রাশিয়াকে তুলে ধরে। রেড গ্রান্ট, গল্পের দানবীয় ও মানসিক বিকারগ্রস্ত খুনে খলনায়ক, এবং রুশ সরকারের মধ্যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগত সমান্তরাল টানা হয়েছে। গ্রান্ট নিজেই এই সামঞ্জস্য চিহ্নিত করে:

“He liked all he heard about the Russians, their brutality, their carelessness of human life, and their guile…”

বিপরীতে রাশিয়াও তাদের নিজেদের মতে ‘ম্যাড’ এবং ‘আনপ্লেজ্যান্ট’ গ্রান্টকে চরম স্বার্থপরের মতো নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন হিংস্র ও কুৎসিত কাজে লাগায়। গ্রান্ট এবং রাশিয়া দুই’ই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রকারী, শক্তিশালী খুনি, ক্ষমতালোভী উন্মাদ এবং বিষাক্ত স্বভাববিশিষ্ট হিসেবে একই বন্ধনীতে আবদ্ধ। শুধুমাত্র গ্রান্ট নয়, বেশিরভাগ রুশ ব্যক্তিকেই অত্যন্ত অস্বাভাবিক, ঘৃণ্য স্বভাববিশিষ্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে। যেমন দেখানো হয়েছে দাবা চ্যাম্পিয়ন এবং রুশ গুপ্ত ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাকারী ক্রন্সটীনকে একজন যন্ত্রবৎ, ভালো-মন্দের ঊর্ধ্বে, একজন সামাজিক ডারউইনবাদী ব্যক্তি যে একেবারেই আগ্রহী নয় “in human beings— not even in his own children. এমনকি, তার কাছে ভালো-মন্দের কোনো বিভেদ নেই: “Nor did the categories of ‘good’ and ‘bad’ have a place in his vocabulary” ক্রন্সটীনের সহযোগী রোজা ক্লাবও শয়তানের আর এক রূপ:

“In her, the herd instinct would also be dead. Her urge for power demanded that she should be a wolf and not a sheep”

এদের পাশে অবশ্য টাটিয়ানা রুশদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা ‘guile’-এর কবল থেকে মুক্ত, এবং বন্ড তা সহজেই উপলব্ধি করে:

“Bond meant that she didn’t look to him like a Russian spy. None of the coldness, none of the calculation. She gave the impression of warmth of heart and gaiety. These things shown out through the eyes.”

              রুশ সরকারের জটিল, বিশ্বাসঘাতকতা ও তঞ্চকতাপূর্ণ সরকারী নীতি হচ্ছে— যাকে মার্ক্সীয় প্রোপাগান্ডারই অন্য রূপ বলে ধরে নেওয়া যায় কারণ রাশিয়া মার্ক্সীয় শাসনাধীন রাষ্ট্র— তাদের ‘হার্ড-সফট’ নীতি। তথাকথিত এই দ্বিচারী নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই কপট নীতি প্রয়োগের ফলে গর্বিত ও আনন্দিত জেনারেল ‘জি’-এর কথায়:

“We open our frontiers to a lot of newspaper men and actors and artists although we know many of them to be spies. Our leaders laugh and make jokes at receptions in Moscow. In the middle of the jokes we drop the biggest test bomb of all time. Comrades Bulganin and Krushchev and Comrade General Serov [General G. carefully included the names for the ears of the tape-recorder] visit India and the East and blackguard the English. When they get back, they have friendly discussions with the British Ambassador about their forthcoming goodwill visit to London. And so it goes on— the stick and then the carrot, the smile and then the frown. And the West is confused. Tensions are relaxed before they have time to harden. The reactions of our enemies are clumsy, their strategy disorganized. Meanwhile the common people laugh at our jokes, cheer our football teams and slobber with delight when we release a few prisoners of war whom we wish to feed no longer!”

এহেন ঢঙে কম্যুনিস্ট শাসিত রাশিয়া ও তার রাষ্ট্রনীতিকে পরিবেশন করা হয়। এর মাধ্যমে ফ্লেমিং রাশিয়াকে “the real menace to civilization” রূপেই প্রতিষ্ঠা করে। এবং এহেন রুশদের বিপরীতে জেমস বন্ড হচ্ছে টোটালিট্যারিয়ানিজম-এর বিরুদ্ধে ঘোষিত ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ণ একা মহাবীর:

“In thus embodying an ideal blend of trained programming and improvisation…Bond constitutes an exemplary hero of capitalist individualism constructed in opposition to the rigidities of communist totalitarianism.”

বন্ডের ইডিওলজি হচ্ছে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। অবশ্যই বুর্জোয়াতান্ত্রিক গণতন্ত্র। এই প্রেক্ষিতে বন্ডও, বা ফ্লেমিং-ও, দ্বিচারীতার দোষে দুষ্ট। বহু ক্ষেত্রেই বন্ড গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেয়ে গণতন্ত্র লাভের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে নামে। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ক্ষেত্রে:

More often than not, however, Bond was fighting to keep the world free not for, but from democracy. If Bond manifested nothing but disdain at social-democracy at home, democracy as such was discarded when turning to the so-called Third World...”

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ তথাকথিত ‘ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ নীতির পরিপন্থী। ফলস্বরূপ, ফ্লেমিং-এর মতে, এই জাতীয় গণতন্ত্র সাধারণ মানুষের, অর্থাৎ নিম্নবর্গ এবং নিম্নবিত্ত মানুষের প্রকৃত উন্নতির পরিপন্থী কারণ একমাত্র হেজিমোনিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থাই এদের জন্যে উপযুক্ত। উদাহরণ হিসেবে তুর্কীর কথা বলা হয়েছে, যদিও বন্ডের নিজের মুখে নয়, বরং তুর্কীর ঘরের ছেলে ডার্কো কেরিমের মাধ্যমে:

Kerim harangued the waiter. He sat back smiling at Bond. “That is the only way to treat these damned people. They love to be cursed and kicked. It is all they understand. It is in the blood. All this pretence of democracy is killing them. They want some sultans and wars and rape and fun. Poor brutes, in their striped suits and bowler hats. They are miserable. You’ve only got to look at them.”

এখানেও ফ্লেমিং, এবং তার সৃষ্ট চরিত্র বন্ড এক বৃহত্তর ইডিওলজির ধারক, বাহক, প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাতা হয়ে ওঠে; এবং সরাসরি, প্রত্যক্ষ ভাবে।

              বিভিন্ন পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ঘটনা, বিভিন্ন অন্তর্নিহিত মাত্রা। ইয়ান ফ্লেমিং-এর নিজের চোখে জেমস বন্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী এবং ঠাণ্ডা যুদ্ধ সময়কালীন এক চরিত্র। সেই ঐতিহাসিক পটভূমিতে সে বন্ডকে দেখে ও সৃজন করে তাকে, রূপ দেয়, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তোলেবন্ড কিছু নির্দিষ্ট ইডিওলজির দ্বারা চালিত হয়ে, এবং কিছু নির্দিষ্ট ইডিওলজির ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে: কম্যুনিজম-বিরোধী বুর্জোয়া ইডিওলজি, টোটালিট্যারিয়ানিজম-বিরোধী মুক্ত-বিশ্বের ইডিওলজি, সাম্যবাদ বিরোধী ভোগবাদ ও কনজিউমারিজম-এর ইডিওলজিএবং, ওই নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পটভূমিতে, বৃহত্তর সমাজ বা সভ্যতার অংশ হিসেবে এই ইডিওলজিগুলিই বন্ডের জনপ্রিয়তার মূল কারণ। এখানেই ফ্লেমিং নিজে প্রত্যক্ষ ভাবে রাষ্ট্রীয় ইডিওলজির ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে। বন্ডের এই বিপুল জনপ্রিয়তা এবং বন্ডের মাধ্যমে প্রচারিত রাষ্ট্রীয় ইডিওলজির প্রভাব এতোই সুদূরপ্রসারী ছিল যে বন্ডের জনপ্রিয়তার কাউন্টার হিসেবে রাশিয়ার মতো সম্পূর্ণ কম্যুনিস্ট শাসনাধীন রাষ্ট্রও মার্ক্সীয় মতাদর্শ ও বিশ্বাসের কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে এসে জাকভ নামে অন্য এক কাউন্টার-স্পাই চরিত্রের সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়েছিল যে একটি গল্পে জেমস বন্ডের সঙ্গে সম্মুখ সমরে নামে এবং তাকে পরাজিত করে ‘রাশিয়ান সুপ্রিমেসি’কে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে:

“...USSR (actually, the KGB) [who] persuaded the Bulgarian writer Andrei Gulyashki to write the book Zakhov Mission (1966; originally ‘Avakum Zakhov versus 07’, serialized in the Soviet youth paper Kosomolskya Pravda) in which Zakhov sets out to destroy James Bond, the ‘supreme example of imperialist espionage’.”

এই ঘটনাটিই ইয়ান ফ্লেমিং-এর এবং জেমস বন্ডের সর্ববৃহৎ সাফল্যএমনকি, পশ্চিমী দেশগুলির রাষ্ট্রীয় ইডিওলজিরও— বুর্জোয়া তন্ত্রেরও। এই সাফল্যের রেশ বজায় রেখে, এই সাফল্যের সূত্র ধরে, আবার একবার একদম শুরুর ইমেজটিতে ফেরা যাক। লেখক, রাষ্ট্রীয় ইডিওলজি, চরিত্র, ঐতিহাসিক পটভূমি। এক কাল্পনিক চতুর্ভুজঘটনাস্থলের বাইরে থেকে, উপর থেকে, অথবা পিছন থেকে, দূরবীনের নাবিক বিন্দুতে চোখ রেখে দেখলে আতস কাচের উলটো পিঠে এই কাল্পনিক চতুর্ভুজের অস্তিত্ব স্পষ্ট আকার ধারণ করেইয়ান ফ্লেমিং, বুর্জোয়া তন্ত্র, জেমস বন্ড, ঠাণ্ডা যুদ্ধ। এক সম্পূর্ণ চতুষ্কৌণীক মানচিত্র।




সূত্র ও ঋণ

1)  Ishay Landa. ‘James Bond: A Nietzschean for the Cold War’.
2)  Dilip Kumar Basu. ‘Introduction’. From Russia, with Love.


সমগ্র ধারাবাহিক প্রবন্ধটির প্রধান গ্রন্থঋণ

1)   Ian Fleming. From Russia, with Love. Dilip Kumar Basu. ed. Worldview. 2001.

v ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ গল্পের সমস্ত উদ্ধৃতি এই গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত।

2)   Tony Bennet. ‘Marxism and Popular Fiction’. Literature and History. 7, Autumn 1981.

3)   Michael Denning. ‘Licensed to Look’. Cover Stories: Narrative and Ideology in the British Spy Thriller. Routledge & Kegan Paul. London and New York, 1987.

4)  James Bond and Philosophy: Questions Are Forever. ed. Jacob M. Held and James B. South. Open Court. Chicago and La Salle, Illinois, 2006.


সম্রাট সেনগুপ্ত

ভাইরাস মতাদর্শের সন্ধানে…




প্রথমত আমি ঝাঁকিদর্শনে অভ্যস্ত নই, দ্বিতীয়ত মতাদর্শগতভাবে রিভিউ নামক ক্রিয়ার বিপরীতে অবস্থিত এই বই।  রিভিউয়ে যে পুনরাবৃত্তির সম্ভবনা থাকে, যে ‘রি’ নামক পূর্বযোজনটি অনুষ্ঠিত হতে চায়, তাকে ব্যাহত করে এই বইয়ের মুল সুরটি। অতীতের আবর্তন নয়, বরং তাকে মুছে ফেলা, সাজানো ফাইল সমূহের কোরাপ্ট হয়ে যাওয়া, সভ্যতার ফরম্যাটিং-এর আশু প্রয়োজন এই গপ্পের আধার। জঁর সমালোচনায় না গিয়েও একে প্রচলিত সার্বিক জীবনের এক দীর্ঘ ছবির অঙ্কে নভেল বলতে দ্বিধা হয়, তবে প্রয়াস হিসেবে বেশ নতুন তো বটেই — সেই অর্থে নভেল।

এই গপ্পে নতুন কী? নতুন কী মানে নতুনের কী নতুন ধারণা আছে? নতুনের ধারণা  এখানে প্রচলিত যে অতীত তাকে হারিয়ে ফেলা, পৃথিবীকে অপার্থিব করে তোলা, তাই এর নাম হয়তো বা ‘অপার্থিব’। অ-পার্থিব। পৃথিবীর যে ধারণা আমাদের স্মৃতি  জুড়ে, যে ভূত ও ভবিষ্যৎ আমাদের সমস্ত স্বপ্নকে হানা দেয় তাকে মুছে ফেলাই তো আসলে অ-পার্থিবকে আহ্বান — তাই তো এক নতুন পৃথিবী। এই বইয়ের সব থেকে দৃঢ় প্রত্যয় — অপার্থিব আসলে অপার্থিব নয়, বহিরাগত নয়; সভ্যতার,  সমাজের, সংস্কৃতির, জাতির অস্তিত্বের কাছে ত্রাসের নয়। হয়তো বা যাদবপুরের ক্যাম্পাসে ছাত্র আন্দোলনের মুহুর্মুহু তরঙ্গ চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক — ‘অপার্থিব’ বইয়ের লেখক অনিন্দ্য সেনগুপ্তকে ভাবিয়েছে ছাত্র-শিক্ষকের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর-বাহিরের বিভাজনগুলিকে। শাসকের, প্রশাসকের ভাষা যখন বহিরাগতর ভয়ে ত্রস্ত, নিজের ইহকাল বাঁচাতে মরিয়া — শাসনতান্ত্রিকতার কাঠামোয় যাদের খাপ খাওয়ানো যায় না, সেইসব খাপছাড়া বিপজ্জনক ভাইরাসদের ক্লিন করতে যখন  সিস্টেম বদ্ধপরিকর, তখন অনিন্দ্যর বই আমদানী করে এক ভাইরাস  আইডিওলজি। শাসকের তাসের দেশে নিয়মের বিপরীতে নয়া ভাবাদর্শ স্থাপন যদি নাই বা করা যায়, তবে প্রয়োজনে নিজেদের মস্তিস্কের ময়লা পরিশুদ্ধ করতে লিখনের মুছে দেয়া। জেনে শুনে জরদ্গবে পরিণ হওয়ার এক ভিন্ন রাজনীতির পথ বাতলায় এই বই।

গল্পের নায়ক দারিয়াস মজুমদার একজন এথিকাল হ্যাকার, একজন রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলতায় বিশ্বাসী। তাকে পাঠানো হয় করোনা নামক পৃথিবীর সমতুল গ্রহে। রহস্য দানা বাঁধে। স্পষ্ট হয় না, সেই গ্রহ ঠিক কত দূরে, সত্যই সেখানে যেতে গেলে ওয়ার্মহোলের মধ্যে প্রবেশ করতে হয় কি না মহাকাশযানকে। দারিয়াস নির্বাসন দণ্ড পেতে পারত, পরিবর্তে তাকে পাঠানো হয় করোনা গ্রহে একটি মিশনে। সেখানে কর্মরত বিজ্ঞানীরা একে একে জরদ্গবে পরিণত হচ্ছিলেন। মানব  নির্মিত নিয়মের নেটওয়ার্কগুলিকে জঁরে পরিত করা যার নেশা ও পেশা তার ওপর  দায়িত্ব পরে জরদ্গবে পরিত হওয়া বিজ্ঞানীদের আসন্ন শূন্যতার হাত থেকে রক্ষা  করার। সাথিহারা দারিয়াস সেখানে সম্পর্ক স্থাপন করে বিজ্ঞানী ইকিরার সাথে। রহস্যের সমাধানে ব্যর্থ দারিয়াস সব কজন বিজ্ঞানীকেই ফেরাতে চায় পৃথিবীতে, শুধু একা থেকে যেতে চায় করোনায় — রহস্য সমাধানে অথবা অসমাধানে। ইকিরা আত্মহত্যা করে। আত্মহননের দর্শন ছড়িয়ে এই বইয়ে। দারিয়াসের পূর্বতন প্রেমিকাও ধরা না দিয়ে আত্মাহুতি দেয়। মানুষের ভবিতব্যও কি এমনি আত্মহনন, সভ্যতার সংকটের মুখে? ভাইরাস আসলে কী? ভাইরাস কি প্রোগ্রামের আকারে  আসলে সিস্টেমের মধ্যেই গোপন অন্তর্ঘাতের বীজ নয় যা আবার সিস্টেমেরই অঙ্গ হয়ে ওঠে? অনেক সময় ভাইরাস মুক্ত করতে সিস্টেমকে আত্মধ্বংসের দিকে যেতে হয় ফরম্যাটিং-এর মাধ্যমে। মুছে যায় জমা তথ্যভান্ডার, স্মৃতি। অনিন্দ্য এই বইয়ে এক অন্য আত্মহত্যা আঁকেন। আত্মত্যাগ সেখানে বীরত্বের চিহ্ন নয়, আত্মবিসর্জন আসলে সেখানে স্মৃতির ক্ষয়। জাতীয়তাবাদ, মার্ক্সবাদ, আত্মপরিচয়ের রাজনীতিতে যে বীরত্বের গাথা বারংবার রচিত, সেখানে নূতনের আহ্বান উপর্যুপরি গতিরুদ্ধ হয় অতীতের কাছে। যে স্মৃতি প্রতিরোধের চালিকাশক্তি, সেই অতীতই স্থবির করে মানুষের মুক্তির, এবং সভ্যতার যাবতীয় জঞ্জালমুক্তির স্বপ্নকে। স্মৃতির জন্য নয়, বরং স্মৃতির থেকে আত্মহননের ছক কষেন অনিন্দ্য। দারিয়াসের ভাইরাস মতাদর্শ আসলে সিস্টেমের ভিতরেই সিস্টেমকে জরদ্গবে পরিত করার ভাবকল্প। এমনকি  দারিয়াস এখানে এক ব্যর্থ নায়ক, বিজ্ঞানীদের জরদ্গবে পরিণত হওয়ায় তার কিছু  করার থাকে না। শেষপর্যন্ত সে এই আত্মহননের প্রক্রিয়ায় নীরব দর্শক ও সমর্থক হয়। মানুষের স্মৃতির রোম্যান্টিক মেদুরতা ও অটোনমির দুটি প্রকাণ্ড মিথকে এই ভবিষ্য-কাহিনিতে সমূলে আঘাত করতে চেয়েছেন অনিন্দ্য। করোনা আসলে পৃথিবীর অতীত অবস্থা শুধু নয়, তা ভবিষ্যৎ সম্ভবনাও। এভাবেই শূন্য থেকে শূন্যে ছুটে চলার মাঝে যে সব কথকতা জমে ওঠে তার মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে এক মিথিক দুনিয়ায় কাল অতিবাহিত করি আমরা। শূন্যতা তো দার্শনিকভাবে আমাদের বেঁচে থাকার নিয়মের ও দৈনন্দিনতার ছকগুলিকে সমস্যায়িত করে।

অনিন্দ্যর লেখাকে অনেকে পলিটিকাল সায়েন্স ফিকশন বলছেন। আমি এর নাম দিলাম ভবিষ্য-কাহিনি। It takes us back to the future। করোনা আমাদের অতীত। করোনা আমাদের ভবিষ্যৎ। শেষে  দারিয়াস করোনার জরদ্গব বিজ্ঞানীদের মহাকাশযানে পাঠিয়ে দেয় পৃথিবীতে। এই কি অপার্থিবের সুচনা? এই কি তবে পৃথিবীর যাবতীয় বানানো মূল্যগুলি জলাঞ্জলি দিয়ে, অতীতকে মুছে ফেলে পৃথিবীর অ-পার্থিবায়ন? প্রসঙ্গত যে কোনো সাইফাই গল্পে আমরা দুধরনের এলিয়েন মূলত পাই — এক, শত্রুভাবাপন্ন যারা মানব সভ্যতাকে আক্রমণ করে; দুই, বন্ধুভাবাপন্ন যারা মানুষের উপকার করতে আসে। এই ব্যবধান অনিন্দ্য মিলিয়ে দিয়েছেন, ঠিক যেমন বেঁচে থাকার প্রকাণ্ড পরিকল্পনায় যন্ত্রবৎ মানুষের মাথার ভিতরের সব তথ্য মুছে মৃত্যু ও জীবনের ভেদগুলিকে প্রশ্ন করেছেন তিনি। করোনার মূক ভাইরাস সদৃশ ভীনগ্রহীদের বহন করে পৃথিবীর মানুষ কি শাপমূক্ত হবে তার যাবতীয় স্মৃতি বিসর্জন দিয়ে? করোনা থেকে জরদ্গব বিজ্ঞানীদের নিয়ে যন্ত্রযানের উত্তরণের মূহূর্তটিই সেই অনাগত ভবিষ্যৎকে নির্দিষ্ট করে। বইটা ওখানেও শেষ হলে পারত।  এরপর আলাদা করে দারিয়াসের একাকিত্বময় নির্বাসনের রোম্যান্টিকতার আর কি কোনো প্রয়োজন ছিল? অধ্যাপক অনির্বাণ দাশের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় উঠে এসেছিল এই প্রশ্ন। ব্যক্তির সমাজ ও সভ্যতাকে ছুঁড়ে ফেলার রোম্যান্টিক কল্পনা তো বহু পুরাতন। আমরা বরং ভাবতে চাইব অনিন্দ্যর বইয়ে সেই অনাগত গোষ্ঠিকে যারা ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে ভুলতে চায় অতীতের যাবতীয় আকর। আমরা কি চেয়ে থাকব না এমন এক পোস্ট-কমিউনিটির দিকে যা স্মৃতি নির্ভর নয় বরং জাতি, ধর্ম, বর্ণ, অঞ্চল ও বিবিধ পরিচয়ের শানতান্ত্রিক ছক-অতিক্রান্ত? আমরা  কি অপেক্ষা করবো না সেই নয়া ইন্টারন্যাশেনালের?


অপার্থিব

অনিন্দ্য সেনগুপ্ত

ISBN: 978-81-933877-0-2

প্রথম প্রকাশ : মে, ২০১৭

প্রকাশক : বৈভাষিক প্রকাশনী

প্রচ্ছদ : অভীক কুমার মৈত্র

মূল্য : ১৮০ টাকা


প্রাপ্তিস্থান : দে’জ; ধ্যানবিন্দু; দে বুক স্টোর (দীপু);অভিযান; চক্রবর্তী-চ্যাটার্জী; দে বুক স্টোর (আদি); কাফে কবীরা; ‘স্টাডি’ (যাদবপুর কফি হাউসের নিচে); ‘স্টাডি’ (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস বিল্ডিং-এ লিফটের পাশে); অক্সফোর্ড বুক স্টোর; স্টোরি (এলগিন রোড); দিল্লি: মুক্তধারা; বেঙ্গালুরু: ফেভারিট বুক স্টোর; বাংলাদেশ: বাতিঘর, তক্ষশীলা, পাঠক সমাবেশ, প্রথমা; উত্তরবঙ্গ: সরাসরি প্রকাশকের মাধ্যমে; অনলাইন: www.dokandar.in ; www.readbengalibooks.com





জিনাত রেহেনা ইসলাম

মেয়েখেলা (পর্ব - ১৪)  






জীবনকে উপভোগ করার জন্য একটি স্বাধীন মন চাই - মল্লিকাদি হষ্টেলে বলত। যদিও নিজের ব্যর্থ প্রেম নিয়ে খুব সেন্সেটিভ ছিল মল্লিকাদি। এক্স কী করে মল্লিকাদিকে ধোকা দিয়ে পালিয়ে গিয়ে আমেরিকায় বিয়ে করেছিল, বর্ণনা করতে  গিয়ে চোখের জলে বিছানা ভিজে যেত মল্লিকাদির। আসল কথা মিথ্যাচার মানুষ প্রেমে নিতেই পারে না। এসম্পর্ক তার কাছে আয়নার মতো যেন প্রতিবিম্বিত হতে  থাকে সারাটি জীবন। হাসি-কান্নায় সেখানেই একদন্ড স্বস্তি। মল্লিকাদির সামনে বসে তখন আমি বুঝতাম না যে বিচ্ছেদের যন্ত্রণাবোধ মানুষকে কতটা অস্বাভাবিক করে তোলে। সেই সময় মনে হতো ভালোবাসার মতো অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে মল্লিকাদি এত গভীর যন্ত্রণায় ডুবে থাকে কেন! আমি ঠিক সমব্যথী হতে পারতাম না। পরে সে ভাবনায় নানা ধরনের পরিমার্জন ও পরিবর্ধন হয়েছে। মল্লিকাদির সারা কান্না আমার চোখে আশ্রয় পেয়েছে এক অসহায়ত্বের সাথে। ফিরে দেখার মুহূর্তে  মনে হয়েছিল মল্লিকাদির ঠিকানা যদি কাছে থাকত! হষ্টেলে সিনিয়রদের প্রেমে ঔদ্ধত্য দেখেছি, স্বপ্নভঙ্গে মানসিক ভারসাম্য হারাতে দেখেছি। প্রেমের ব্যর্থতায় সারা রাত ভিজতে দেখেছি বালিশ, বিছানা। এক বিষণ্ন রাজপুরীতে যেন রাজকন্যারা সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে প্রতিরাত। তবু সকাল, তবু ঝলমলে আকাশের কিরণে কেটেছে দিন।

তখন নিজেকে স্বনির্ভর করে তোলার এক বিষম দায় আমাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াত কোনও কিছু চোখ তুলে দেখার অবকাশ হয়নি। এমন কি বিয়ে করে ফেলেছি সেটাও তেমন সিরিয়াসলি নিইনি। জীবনের প্রকৃত দুর্দশা তখন শুরু হয়  যখন দাম্পত্যজীবন শুরু হয় স্বামীকে পড়ানো, তার হাজার ফরমায়েস পূরণ করা তখন ধ্যান-জ্ঞান। যে মানুষটিকে একদা সন্তানের মতো দায়িত্ব নিয়ে প্রতিপালন করেছিলাম, সে কখনো বদলে যাবে বা তার নিঃশ্বাস কখনো গায়ের কাছে এসে  পড়লে তা বিষের মতো আক্রমণ করবে আমায়, তা বুঝিনি সেদিন। একটু একটু  করে বদলেছে সব বিশ্বাস, চেতনার সব রং। প্রেমিকের আবার গোপন অঙ্গে হাত দিয়ে পরীক্ষা করা যে পুরনো স্বামীর সাথে সহবাস করেছি  কিনা, মদের নেশা ছেড়েছি বলে অভিনয় করা, যাবতীয় তিক্ততা মাথা তুললে নিজেকেই খুব অশুদ্ধ মনে হয়। এ জীবনের প্রতি বিদ্বেষ জাগে। পুরুষ নির্বাচনে আমরা মেয়েরা বুঝি খুব কম সফল হই! তবু পরাস্ত হই না!

এখনো দেখি আমাদের প্রাক্তন আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্লক করে রাখে। কারণটা এত তুচ্ছ যে করুণা হয়। একদা তারা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে সাড়া না পেয়ে এদিকের নমনীয়তার আশা ছাড়ে। বর্তমান সঙ্গিনীকে নিয়ে যাবতীয় ছবি পোষ্ট করে নিজেদের ধোয়া তুলসীপাতা প্রমাণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবচেয়ে মজার কথা একদা কলেজ জীবনে যারা এই প্রেম খেলার বিরোধীতা করেছিল তারা গিয়ে টাইমলাইনে লেখে ‘নাইস জোড়ি’! এই হিপোক্রেসি বন্ধুদের মানায়, জীবন থেকে তাই শিখেছি। কোনো অসৎ লোকের শাস্তি হতে দেখিনি, বরং ভালো মানুষকে পুড়তে দেখেছি চোখের সামনে। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে যে ছেলে সম্পর্ক ভাঙ্গে, মানুষের সাথে প্রতারণা করে, তার পাশে পরিচিতরা কেমন যেন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এদের দ্বিচারিতায় ভাষা হারায়। আজ আর মানুষের সঙ্গ ভালো লাগে না আমার। এমন প্রতারক বুঝি আর কোনও সামাজিক জীব হয় না! মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ, কিন্তু খারাপ মানুষকে ভরসা করাও হয়তো পাপ। হয়তো  আমার দুর্ভাগ্য আমার ললাট লিখন ছিল এই অভিজ্ঞতা। এতটাই ‘আনায়াভোয়ডেবেল’ ছিল তা, যা আমি কিছুতেই পেরোতে পারিনি। পচা শামুকেই পা কেটেছে বারবার।





মন খারাপের ছায়ায় দীর্ঘ জীবনের লালন। কোথাও কোনো রোদের রেখাটুকু নেই। মরুভূমিতে একবিন্দু জলের পিপাসা জীবনভোর, তা অধরাই থাকে। মেয়েরা  পুরুষকে ভালোবেসে পোশাক বদলায়, মার খায়, বোরখা পড়ে, সমঝোতা করে, কিন্তু মরে একবুক নিঃস্বতা নিয়ে। ঘন কালো অন্ধকারের মতো কবরস্থানে প্রেম লুকিয়ে রাখে, দিনরাত মনের গহিনে চলে দেবতার আরাধনা, মূর্তির নিত্য অধিষ্ঠান। কিন্তু আখেরে কিছুই হাতে আসে না তার। এক অলৌকিক সতীত্বের সন্ধানে ও তা প্রাপ্তির এক অমোঘ মহানুভবতার ডুবসাগরে সে একদিন হারিয়ে যায়। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে! 



রোখশানা রফিক

আধুনিকতার রোলার কোষ্টারে প্রাচীন বাঙালিয়ানা (পর্বঃ ৩)  




বিবাহ বৈকুন্ঠের বাসরে

প্রহর শেষের আলোয় রাঙা
 সেদিন চৈত্রমাস,
 তোমার চোখে দেখেছিলেম
 আমার সর্বনাশ!”

তো এই সাড়ে সর্বনাশেরই শেষ সরণী সর্ববিপত্তারিণী বিবাহ বৈতরণী খেলেও পস্তাবেন, না খেলেও তবুও রবি ঠাকুরের ‘দুবেলা মরার আগে মরবো না ভাই মরবো না’ এই নিষেধাজ্ঞা গায়ে না মেখে, প্রায় সকলেই জীবিত বিবাহিত এই দুদলের মধ্যে মৃত হওয়াই মঙ্গলময় বিবেচনা করে, বিবাহমন্ত্রের মৃতসঞ্জীবনী সুধা পান করেন

এক্ষেত্রে একবার বিয়ের পিঁড়িতে বসার পর তা সুখমন্ডিত না হলে, ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার’ নিয়ম খাটে কম সুখী বৈবাহিক জীবনের ফল এক বিয়ের ঢিলেই পেড়ে ফেলতে না পারলে, সমালোচনার তীর যে কাউকে মাটিতে পেড়ে ফেলে অনেকেই তাই ‘ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়’ এই নিয়ম মানেন ছাঁদনাতলার ক্ষেত্রেও দুবার যেতে চান না সহজে মাথায় পড়লে দুটোই কাষ্ঠল বেদনাদায়ক কিনা !

বাঙালী মূলতঃ সংসারপ্রেমী শৈশবের চড়ুইভাতি খেলার কালে হলেও একটিবার বউ-জামাই সেজে নেয় বাঙালী শিশুমন হয়তো তখনো ভবিষ্যত বলে যে একটা কিছু কালের গর্ভে লুকিয়ে আছে, সে বোধই জন্মাবার বয়স হয় না তাদের তবুও সুন্দর সাজানো সংসারের স্বপ্নঅঞ্জন থাকে তাদের দুচোখে আর স্বপ্নকে সত্যি করার চেষ্টাই থাকে আমরণ তবে বাঙালী অভিভাবকুল এক্ষেত্রে সচরাচর দারুণ কড়া ভূমিকায় অবতীর্ণ বাঙালী সমাজব্যবস্থাও তদ্রুপ তাই কোনো সম্ভাব্য পাত্র-পাত্রী বিয়ের বয়সে কড়া নাড়তেই, শুরু হয়ে যায় সংক্রান্ত জল্পনা-কল্পনার কাড়া-নাকাড়া বাছার ধুম আর এই ধূম্রজালের পারিবারিক-সামাজিক চাপে বাছাধন পাত্র-পাত্রীদের প্রাণ হয় ওষ্ঠাগত

কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মধুবালা, কাননবালা, দিলীপকুমার-নার্গিস, সুচিত্রা- উত্তম, ধর্মেন্দ্র-হেমা, রাজেশ-শর্মিলা, কবরী-রাজ্জাক-শাবানা-ববিতা এরকম আরো অনেক চিত্রজগতের জুটির সাড়া জাগানো প্রেমাভিনয়ে গদগদমান্না দে-কিশোরের প্রেমের গানের ভেলায় ভেসে নিজেদের যৌবন নদী পার করা, অনেক প্রাচীনপন্থী বাঙালী অভিভাবকই কিন্তু এই গত দশক পর্যন্ত, তাদের সন্তান-সন্ততিদের প্রেমের ব্যাপারে ছিলেন ঠেলা সামলা টাইপ খড়গহস্ত রণমূর্তি অদ্ভুত এক ত্রিশঙ্কু ধারণা ছিলো বাঙালী পরিবারগুলোর মনে যে, প্রেমের বিয়ে সচরাচর সুখী হয় না, পরিবারের পছন্দে বিয়েই উত্তম

আসলে এক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ের তিক্ত বাস্তবতা এই যে, প্রেমের বিয়েতে নবদম্পতির প্রেমটিকে যাচাই-বাছাই কূটকচালীর যূপকাষ্ঠে ফেলে, পারিপার্শ্বিক অনেকেই আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন ভাবটা এরকম, বাছাধনেরা এবার বোঝো নিজের পছন্দে বিয়ে করার ঠেলা! আবার এসব শুভাকাঙ্ক্ষীরা লুকিয়ে চুরিয়ে  গোপনে নিজেদের প্রেমহীন জীবনের শোকে গোপন দীর্ঘশ্বাসও যে ফেলেন না, তা নয়

আর পারিবারিক পছন্দে বিয়ে হলে, অনেক পরিবারের লোকজনই তাদের  বাছাইকৃত পাত্র-পাত্রীর উপর, সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য বাস্তব-অবাস্তব সবরকম গুণাবলী  আরোপ করে, বিবাহটিকে সফল করতে উঠে-পড়ে লেগে যান কোমর বেঁধে তাই দৃশ্যমান ঝামেলা হয় কম ...তবে আধুনিকতার রোলার কোষ্টারে চেপে বসে অনেক প্রাচীনপন্থী বাঙালীই চক্ষুষ্মান হয়েছেন ব্যাপারে মানে বিয়ের ক্ষেত্রে তাদের সন্তান-সন্ততিকে নিজের জীবনসঙ্গী নিজেই বেছে নেয়ার সুযোগ দিচ্ছেন আজকাল অনেক বাঙালী পরিবারই বিবাহ পরবর্তী সময়ে কোনো মতানৈক্য বা নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে, যেন অভিভাবকের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল না ওঠে ভুল পছন্দের, সেজন্যও অনেক বাঙালী পরিবার পাত্র-পাত্রীর নিজেদের পছন্দের ব্যাপারে নিমসম্মত হচ্ছেন

রোলার কোষ্টারের যুগে প্রজাপতির নিবন্ধনে প্রাণের স্পন্দন জেগে ওঠার চেয়ে, উৎসব আয়োজনের খরচের বাহুল্যে প্রাণস্পন্দন স্তিমিত হয়ে ওঠে অনেক পরিবারেরই হঠাৎ দেখা, কনে দেখা, পানচিনি, হলুদ সন্ধ্যা, মেহেন্দী, আখদ, আইবুড়ো ভাত, বিয়ে, বৌভাত বা রিসেপশন এরকম নানা রাইডে চেপে তবে মধুচন্দ্রিমার জাহাজে চড়ার ছাড়পত্র মেলে নবদম্পতির শুধু অমাবস্যা ঘনায় অভিভাবকের পকেটের ছাঁদে, চাঁদের আলোয় সন্তান-সন্ততির জোছোনা হাসির আশায় হয়তো দুঃখে অভিভাককূলের হয়ে কবিগুরুর ভাষায় গাওয়া যেতেই পারে-

যাবো না, যাবো না আজ, যাবো না যে,
রইনু পড়ে ঘরের মাঝে এই নিরালায়,
রবো আপন মনে,
আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে”

তবুও নিজের মেয়ে যদি হয় বিয়ের কনে বা পুত্র যদি বিভোর হয় বিবাহের স্বপ্নে, তখন সাধ্য মতোন সব বাঙালী পরিবারই আয়োজন করে সুচারু বিবাহানুষ্ঠানের তবে স্লিক কাটের পোশাক-আশাক আর স্লিম ফিগারের যুগের বহু পাত্র-পাত্রীই আজকাল, বাহুল্য মেদের মতো বিয়েকেন্দ্রিক অহেতুক বিশাল বাজেট ছেঁটে যথাসম্ভব ছোট করার পক্ষপাতী এজন্য অধুনা দুই পরিবারের অতি আপনজনদের নিয়ে এক্ষেত্রে ঘরোয়া অথবা যৌথ অনুষ্ঠানের আয়োজনও হচ্ছে অহরহ

শুনতে পেলাম কেষ্ট গিয়ে,
তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে?
গঙ্গারামকে পাত্র পেলে,
জানতে চাও সে কেমন ছেলে?
মন্দ নয়, সে পাত্র ভালো,
রঙ যদিও বেজায় কালো
তার উপরে মুখের গঠন,
অনেকটা ঠিক পেঁচার মতোন
ঊনিশটি বার মেট্রিকে সে,
ঘায়েল হয়ে থামলে শেষে

সুকুমার রায়ের লেখা ছড়াটির মতো এরকম ছদ্ম শুভাকাঙ্ক্ষীর সমালোচনার মুখে  যেন মেয়ে-জামাতাকে পড়তে না হয়, সেজন্য কোনো মেয়ের বিবাহ স্থির হওয়া মাত্রই পাত্রীর বাবা-মা কেমন কার্তিকের মতো সুদর্শন আর জ্ঞানী-গুণী-সচ্চরিত্র সর্বগুণে গুণান্বিত পাত্রে মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পেরেছেন, সে প্রশংশায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়েন সবকালেই এটিই চিরকালীন চলমান প্রক্রিয়া, পরিবারের যে কোনো মেয়ের যেমনই বিয়ে হোক না কেন, মেয়েটির বাবা-মা তাদের আত্মীয় পরিজন আশে  পাশের সবাইকে খুব গর্ব করে বলবেন, তাদের মেয়ের কেমন হ্যানো ত্যানো হোমড়া চোমরা ঘরে বিয়ে হয়েছে

অথচ একটি পরিবারের মেয়ে বধূ হয়ে যখন অন্য পরিবারে যায়, তখন কম করে হলেও এক/দেড় বছর সময় লেগে যায় নতুন পরিবারটির সাথে এডজাষ্ট করতে বা বুঝতে কোনো কোনো হীন মানসিকতার পরিবারে নতুন বধূটি শারীরিক/মানসিক নির্যাতনেরও শিকার হয়... সেক্ষেত্রে একদিকে মেয়েটি নির্যাতিতা হচ্ছে, অন্যদিকে তার বাবা-মা সবাইকে বলছে, খুব ভালো বিয়ে হয়েছে তাদের মেয়ের চরম দোটানা এক পরিস্থিতি মেয়েটির জন্য দূর্ভাগ্যক্রমে তার ফিরে আসতে গেলে এই প্রিটেন্ডিং বা ভান ব্যাপারটা মূল বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সামনেআর কোনো কোনো বাবা-মা একেবারে রাজা-রাজড়ার ঘরে মেয়ের বিয়ে হয়েছে বলে যে ভাব দেখাতে শুরু  করেন, এত রাজা-রাজড়াই বা দেশে এলো কোথা থেকে, তাও আমার বুদ্ধিতে কুলায় না! ফলশ্রুতিতে কোনো খারাপ পরিস্থিতিতে নিজেদের কল্পিত গল্পের জালে নিজেরাই আটকে পড়ে বাঙালী এক্ষেত্রে, বেরুতে গেলে মানসম্মানের প্রশ্ন

এবার আসি বিবাহ অনুষ্ঠান আয়োজন প্রসঙ্গে আধুনিক বিবাহ মানেই প্রফেশনালিজম-এর ছোঁয়া পুরাকালে একটি বিবাহকে ঘিরে যেসব আয়োজন সাজসজ্জা ঘরোয়া মানুষজনই করতো, এখন সেসব প্রফেশনালি করাতে না পারলে, ইমোশনালি খাটো মনে করেন বাঙালী নিজেকে, ইকোনোমিকালি সাশ্রয়ী না হলেও কনের মেনিকিউর, পেডিকিউর, ফেসিয়াল, খোঁপা, শাড়ি পড়ানো, মালা-চন্দনে  সাজানো থেকে শুরু করে বরের ধুতি, শেরোয়ানী, পাঞ্জাবী হলুদের স্টেজ, তত্ত্ব, ভিডিও, স্টিল ফটোগ্রাফ, খানাপিনা - সব কিছুতেই চাই স্পেশাল টাচ এতে ভেরী মাচ লাভবান হয় এসব পরিষেবা প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। বর-কনের মধ্যে Love হলো কিনা সেটা পরের আখ্যান তবু তো মেলে অভিজাত হিসেবে সমাজ মন্দিরে অধিষ্ঠান!

এত আয়োজন সত্ত্বেও সাবেকী আমলে একটি বিবাহ অনুষ্ঠানে যে প্রাণবন্ততা দেখা যেতো, আধুনিক কেতায় তা যেন একটু শৃঙ্খলিত পুরাতন জামানায় একটি বিবাহ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে হাস্য-রস-কৌতুকের বন্যা বয়ে যেত বহুবিধ সম্পর্কিত  আত্মীয়দের মধ্যে এখনকার ভাড়া করা কমিউনিটি সেন্টারগুলোয় সবকিছু যেন অতি ফর্মাল যেন নরমাল দিনের চেয়ে একটু বেশি সেজে রেস্টুরেন্টে গেলুম, খেলুম, চলে এলুম জাতীয় ব্যাপার এমনকি কোনো কোনো কমিউনিটি সেন্টারে নারী-পুরুষের বসার কামরা আলাদা হওয়ায়, বিবাহ আসরে ঢুকেই আলাদা হয়ে যেতে হয় একই পরিবারভুক্ত নারী-পুরুষকে আগেকার সেই হাতা-চামচ পরিবাশনার ধরনও বদলে গিয়ে হয়েছে ক্যাটারার মেন্যুতে সাজানো কাটলারিজ আর খাবারের কারণে


সাবেকী ভারী গয়নার ফ্যাশন আউট ডেটেড হয়ে, যেমন চলে এসেছে হালকা গহনার প্যাটার্ন তেমনি যেন আধুনিক বাঙালী বিবাহ অনুষ্ঠানআন্তরিকতার চেয়ে আড়ম্বরে উপচানো, ভারী মডার্ণ, ফেডেড জিন্সের মতো হাল ফ্যাশান, বাঙালীর  পুরাতন বিবাহাচারের নতুন হালচাল সন্ধান  তবু সব বাঙালীর জীবনে আজো সকল অনুষ্ঠানের সেরা অনুষ্ঠান হিসেবেই বর্তমান... বিবাহ বাসরের জয়গান