আধুনিকতার রোলার কোষ্টারে প্রাচীন বাঙালিয়ানা (পর্বঃ ৩)
বিবাহ বৈকুন্ঠের বাসরে
“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা
সেদিন চৈত্রমাস,
তোমার চোখে দেখেছিলেম
আমার সর্বনাশ!”
তো এই সাড়ে সর্বনাশেরই শেষ সরণী সর্ববিপত্তারিণী বিবাহ বৈতরণী। খেলেও পস্তাবেন, না খেলেও। তবুও রবি ঠাকুরের ‘দু’বেলা মরার আগে মরবো না ভাই মরবো না’ এই নিষেধাজ্ঞা গায়ে না মেখে, প্রায় সকলেই জীবিত ও বিবাহিত এই দু’দলের মধ্যে — মৃত হওয়াই মঙ্গলময় বিবেচনা করে, বিবাহমন্ত্রের মৃতসঞ্জীবনী সুধা পান করেন।
এক্ষেত্রে একবার বিয়ের পিঁড়িতে বসার পর তা সুখমন্ডিত না হলে, ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার’ নিয়ম খাটে কম। সুখী বৈবাহিক জীবনের ফল এক বিয়ের ঢিলেই পেড়ে ফেলতে না পারলে, সমালোচনার তীর যে কাউকে মাটিতে পেড়ে ফেলে। অনেকেই তাই ‘ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়’ এই নিয়ম মানেন ছাঁদনাতলার ক্ষেত্রেও। দু’বার যেতে চান না সহজে। মাথায় পড়লে দু’টোই কাষ্ঠল বেদনাদায়ক কিনা !
বাঙালী মূলতঃ সংসারপ্রেমী। শৈশবের চড়ুইভাতি খেলার কালে হলেও একটিবার বউ-জামাই সেজে নেয় বাঙালী শিশুমন। হয়তো তখনো ভবিষ্যত বলে যে একটা কিছু কালের গর্ভে লুকিয়ে আছে, সে বোধই জন্মাবার বয়স হয় না তাদের। তবুও সুন্দর সাজানো সংসারের স্বপ্নঅঞ্জন থাকে তাদের দু’চোখে। আর এ স্বপ্নকে সত্যি করার চেষ্টাই থাকে আমরণ। তবে বাঙালী অভিভাবকুল এক্ষেত্রে সচরাচর দারুণ কড়া ভূমিকায় অবতীর্ণ। বাঙালী সমাজব্যবস্থাও তদ্রুপ। তাই কোনো সম্ভাব্য পাত্র-পাত্রী বিয়ের বয়সে কড়া নাড়তেই, শুরু হয়ে যায় এ সংক্রান্ত জল্পনা-কল্পনার কাড়া-নাকাড়া বাছার ধুম। আর এই ধূম্রজালের পারিবারিক-সামাজিক চাপে বাছাধন পাত্র-পাত্রীদের প্রাণ হয় ওষ্ঠাগত।
কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মধুবালা, কাননবালা, দিলীপকুমার-নার্গিস, সুচিত্রা- উত্তম, ধর্মেন্দ্র-হেমা, রাজেশ-শর্মিলা, কবরী-রাজ্জাক-শাবানা-ববিতা এরকম আরো অনেক চিত্রজগতের জুটির সাড়া জাগানো প্রেমাভিনয়ে গদগদ, মান্না দে-কিশোরের প্রেমের গানের ভেলায় ভেসে নিজেদের যৌবন নদী পার করা, অনেক প্রাচীনপন্থী বাঙালী অভিভাবকই কিন্তু এই গত দশক পর্যন্ত, তাদের সন্তান-সন্ততিদের প্রেমের ব্যাপারে ছিলেন ঠেলা সামলা টাইপ খড়গহস্ত রণমূর্তি। অদ্ভুত এক ত্রিশঙ্কু ধারণা ছিলো বাঙালী পরিবারগুলোর মনে যে, প্রেমের বিয়ে সচরাচর সুখী হয় না, পরিবারের পছন্দে বিয়েই উত্তম।
আসলে এক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ের তিক্ত বাস্তবতা এই যে,
প্রেমের বিয়েতে নবদম্পতির প্রেমটিকে যাচাই-বাছাই ও কূটকচালীর যূপকাষ্ঠে ফেলে,
পারিপার্শ্বিক অনেকেই আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন। ভাবটা এরকম, বাছাধনেরা এবার বোঝো নিজের পছন্দে বিয়ে করার ঠেলা! আবার এসব শুভাকাঙ্ক্ষীরা লুকিয়ে চুরিয়ে গোপনে নিজেদের প্রেমহীন জীবনের শোকে গোপন দীর্ঘশ্বাসও যে ফেলেন না, তা নয়।
আর পারিবারিক পছন্দে বিয়ে হলে, অনেক পরিবারের লোকজনই তাদের বাছাইকৃত পাত্র-পাত্রীর উপর, সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য বাস্তব-অবাস্তব সবরকম গুণাবলী আরোপ করে,
বিবাহটিকে সফল করতে উঠে-পড়ে লেগে যান কোমর বেঁধে। তাই দৃশ্যমান ঝামেলা হয় কম। ...তবে আধুনিকতার রোলার কোষ্টারে চেপে বসে অনেক প্রাচীনপন্থী বাঙালীই চক্ষুষ্মান হয়েছেন এ ব্যাপারে। মানে বিয়ের ক্ষেত্রে তাদের সন্তান-সন্ততিকে নিজের জীবনসঙ্গী নিজেই বেছে নেয়ার সুযোগ দিচ্ছেন আজকাল অনেক বাঙালী পরিবারই। বিবাহ পরবর্তী সময়ে কোনো মতানৈক্য বা নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে, যেন অভিভাবকের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল না ওঠে ভুল পছন্দের, সেজন্যও অনেক বাঙালী পরিবার পাত্র-পাত্রীর নিজেদের পছন্দের ব্যাপারে নিমসম্মত হচ্ছেন।
রোলার কোষ্টারের যুগে প্রজাপতির নিবন্ধনে প্রাণের স্পন্দন জেগে ওঠার চেয়ে, উৎসব আয়োজনের খরচের বাহুল্যে প্রাণস্পন্দন স্তিমিত হয়ে ওঠে অনেক পরিবারেরই। হঠাৎ দেখা,
কনে দেখা,
পানচিনি, হলুদ সন্ধ্যা, মেহেন্দী, আখদ, আইবুড়ো ভাত, বিয়ে, বৌভাত বা রিসেপশন… এরকম নানা রাইডে চেপে তবে মধুচন্দ্রিমার জাহাজে চড়ার ছাড়পত্র মেলে নবদম্পতির। শুধু অমাবস্যা ঘনায় অভিভাবকের পকেটের ছাঁদে, চাঁদের আলোয় সন্তান-সন্ততির জোছোনা হাসির আশায়। হয়তো এ দুঃখে অভিভাককূলের হয়ে কবিগুরুর ভাষায় গাওয়া যেতেই পারে-
“যাবো না,
যাবো না আজ, যাবো না যে,
রইনু পড়ে ঘরের মাঝে এই নিরালায়,
রবো আপন মনে,
আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে”।
তবুও নিজের মেয়ে যদি হয় বিয়ের কনে বা পুত্র যদি বিভোর হয় বিবাহের স্বপ্নে, তখন সাধ্য মতোন সব বাঙালী পরিবারই আয়োজন করে সুচারু বিবাহানুষ্ঠানের। তবে স্লিক কাটের পোশাক-আশাক আর স্লিম ফিগারের যুগের বহু পাত্র-পাত্রীই আজকাল, বাহুল্য মেদের মতো বিয়েকেন্দ্রিক অহেতুক বিশাল বাজেট ছেঁটে যথাসম্ভব ছোট করার পক্ষপাতী। এজন্য অধুনা দুই পরিবারের অতি আপনজনদের নিয়ে এক্ষেত্রে ঘরোয়া অথবা যৌথ অনুষ্ঠানের আয়োজনও হচ্ছে অহরহ।
“শুনতে পেলাম কেষ্ট গিয়ে,
তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে?
গঙ্গারামকে পাত্র পেলে,
জানতে চাও সে কেমন ছেলে?
মন্দ নয়,
সে পাত্র ভালো,
রঙ যদিও বেজায় কালো।
তার উপরে মুখের গঠন,
অনেকটা ঠিক পেঁচার মতোন।
ঊনিশটি বার মেট্রিকে সে,
ঘায়েল হয়ে থামলে শেষে”
সুকুমার রায়ের লেখা ছড়াটির মতো এরকম ছদ্ম শুভাকাঙ্ক্ষীর সমালোচনার মুখে যেন মেয়ে-জামাতাকে পড়তে না হয়, সেজন্য কোনো মেয়ের বিবাহ স্থির হওয়া মাত্রই পাত্রীর বাবা-মা কেমন কার্তিকের মতো সুদর্শন আর জ্ঞানী-গুণী-সচ্চরিত্র সর্বগুণে গুণান্বিত পাত্রে মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পেরেছেন, সে প্রশংশায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়েন সবকালেই। এটিই চিরকালীন চলমান প্রক্রিয়া, পরিবারের যে কোনো মেয়ের যেমনই বিয়ে হোক না কেন,
মেয়েটির বাবা-মা তাদের আত্মীয় পরিজন ও আশে পাশের সবাইকে খুব গর্ব করে বলবেন, তাদের মেয়ের কেমন হ্যানো ত্যানো হোমড়া চোমরা ঘরে বিয়ে হয়েছে।
অথচ একটি পরিবারের মেয়ে বধূ হয়ে যখন অন্য পরিবারে যায়, তখন কম করে হলেও এক/দেড় বছর সময় লেগে যায় নতুন পরিবারটির সাথে এডজাষ্ট করতে বা বুঝতে। কোনো কোনো হীন মানসিকতার পরিবারে নতুন বধূটি শারীরিক/মানসিক নির্যাতনেরও শিকার হয়... সেক্ষেত্রে একদিকে মেয়েটি নির্যাতিতা হচ্ছে, অন্যদিকে তার বাবা-মা সবাইকে বলছে, খুব ভালো বিয়ে হয়েছে তাদের মেয়ের। চরম দোটানা এক পরিস্থিতি মেয়েটির জন্য। দূর্ভাগ্যক্রমে তার ফিরে আসতে গেলে এই প্রিটেন্ডিং বা ভান ব্যাপারটা মূল বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সামনে। আর কোনো কোনো বাবা-মা একেবারে রাজা-রাজড়ার ঘরে মেয়ের বিয়ে হয়েছে বলে যে ভাব দেখাতে শুরু করেন, এত রাজা-রাজড়াই বা দেশে এলো কোথা থেকে,
তাও আমার বুদ্ধিতে কুলায় না! ফলশ্রুতিতে কোনো খারাপ পরিস্থিতিতে নিজেদের কল্পিত গল্পের জালে নিজেরাই আটকে পড়ে বাঙালী এক্ষেত্রে, বেরুতে গেলে মানসম্মানের প্রশ্ন।
এবার আসি বিবাহ অনুষ্ঠান আয়োজন প্রসঙ্গে। আধুনিক বিবাহ মানেই প্রফেশনালিজম-এর ছোঁয়া। পুরাকালে একটি বিবাহকে ঘিরে যেসব আয়োজন সাজসজ্জা ঘরোয়া মানুষজনই করতো, এখন সেসব প্রফেশনালি করাতে না পারলে, ইমোশনালি খাটো মনে করেন বাঙালী নিজেকে, ইকোনোমিকালি সাশ্রয়ী না হলেও। কনের মেনিকিউর, পেডিকিউর, ফেসিয়াল, খোঁপা, শাড়ি পড়ানো, মালা-চন্দনে সাজানো থেকে শুরু করে বরের ধুতি,
শেরোয়ানী, পাঞ্জাবী হলুদের স্টেজ, তত্ত্ব, ভিডিও, স্টিল ফটোগ্রাফ, খানাপিনা - সব কিছুতেই চাই স্পেশাল টাচ। এতে ভেরী মাচ লাভবান হয় এসব পরিষেবা প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। বর-কনের মধ্যে Love হলো কিনা সেটা পরের আখ্যান। তবু তো মেলে অভিজাত হিসেবে সমাজ মন্দিরে অধিষ্ঠান!
এত আয়োজন সত্ত্বেও সাবেকী আমলে একটি বিবাহ অনুষ্ঠানে যে প্রাণবন্ততা দেখা যেতো, আধুনিক কেতায় তা যেন একটু শৃঙ্খলিত। পুরাতন জামানায় একটি বিবাহ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে হাস্য-রস-কৌতুকের বন্যা বয়ে যেত বহুবিধ সম্পর্কিত আত্মীয়দের মধ্যে। এখনকার ভাড়া করা কমিউনিটি সেন্টারগুলোয় সবকিছু যেন অতি ফর্মাল। যেন নরমাল দিনের চেয়ে একটু বেশি সেজে রেস্টুরেন্টে গেলুম, খেলুম, চলে এলুম জাতীয় ব্যাপার। এমনকি কোনো কোনো কমিউনিটি সেন্টারে নারী-পুরুষের বসার কামরা আলাদা হওয়ায়, বিবাহ আসরে ঢুকেই আলাদা হয়ে যেতে হয় একই পরিবারভুক্ত নারী-পুরুষকে। আগেকার সেই হাতা-চামচ পরিবাশনার ধরনও বদলে গিয়ে হয়েছে ক্যাটারার মেন্যুতে সাজানো কাটলারিজ আর খাবারের কারণে।
সাবেকী ভারী গয়নার ফ্যাশন আউট ডেটেড হয়ে, যেমন চলে এসেছে হালকা গহনার প্যাটার্ন। তেমনি যেন আধুনিক বাঙালী বিবাহ অনুষ্ঠান, আন্তরিকতার চেয়ে আড়ম্বরে উপচানো, ভারী মডার্ণ, ফেডেড জিন্সের মতো হাল ফ্যাশান, বাঙালীর পুরাতন বিবাহাচারের নতুন হালচাল সন্ধান। তবু সব বাঙালীর জীবনে আজো সকল অনুষ্ঠানের সেরা অনুষ্ঠান হিসেবেই বর্তমান... বিবাহ বাসরের জয়গান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন