শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭

সুনীতি দেবনাথ

মসলিনের সাতকাহন




একটি বহুল প্রচলিত গল্প আছে মুঘল সম্রাট ঔরঙজেবের দরবারে একদিন তাঁর এক কন্যা এলে ঔরঙজেব কন্যাকে স্বল্প বস্ত্র পরে আসার জন্য তিরস্কার করেনবিস্মিত কন্যা জানান তিনি আব-ই -রওয়ানের (এক বিশেষ প্রকারের মসলিন) সাতটি জামা পরে আছেন। বিস্ময়! আরো বিস্ময় চল্লিশ হাত লম্বা আর দুই হাত চওড়া সূক্ষ্ম এই শ্রেণীর  মসলিন কাপড় একটা আংটির ছিদ্র দিয়ে পার করা যেতমাত্র এক পাউন্ড সুতোর দৈর্ঘ্য হতো প্রায় আড়াই ‘শ মাইল! ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিন কাপড় একটা দেশলাই বাক্সে জায়গা হতো। ১৭৫ গজ মসলিন কাপড় একসঙ্গে গুটিয়ে নিলে একটি পায়রার ছোট্ট ডিমের সাইজ হতো। বিস্ময়ের ব্যাপার, কতটা সূক্ষ্ম বস্ত্র ছিলো এই পুরনো কালের মসলিন।

পুরনো কালের বস্ত্র মানে কতটা পুরনো কালের? নামটাই বা মসলিন কেন? কোন  স্থানে তৈরি হতো এমন জাদুকরী বস্ত্র, প্রাসঙ্গিকভাবে এসব প্রশ্ন আসে। বিশেষ এক প্রকার তুলোর আঁশ থেকে প্রস্তুত সুতো দিয়ে বয়ন করা এক প্রকারের অতি সূক্ষ্ম বস্ত্র বিশেষ মসলিন।  এটি ঢাকাই মসলিন নামেই অধিক পরিচিত। ফুটি কার্পাস নামের তুলো থেকে প্রস্তুত অতি চিক্কণ সুতো দিয়ে মসলিন তৈরি করা হতো। চরকা  দিয়ে কাটা, হাতে বোনা মসলিনের জন্য সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের সুতো লাগতো। সুতোর কাউন্ট চার পাঁচশোও হতো।  যার জন্য মসলিন হতো কাচের মতো স্বচ্ছ। এই মসলিন রাজকীয় পোশাক নির্মাণে ব্যবহার করা হতো। মসলিন প্রায় ২৮ রকম হয়ে থাকে যার মধ্যে এখনও জামদানি নামক একপ্রকার মসলিন বিপুলভাবে প্রচলিত। নানা কারণে আঠারো শতকের শেষার্ধে বাংলায় মসলিন বয়ন বন্ধ হয়ে যায়।

সম্পাদনা প্রচলিত বাংলা শব্দ মসলিনের মূল আরবি, ফারসি বা সংস্কৃত শব্দ নয়। এস. সি. বার্নেল ও হেনরি ইউল নামের দুজন ইংরেজ দ্বারা প্রকাশিত  অভিধান ‘হবসন জবসন '-এ উল্লেখ করা হয়েছে মসলিন শব্দটি এসেছে 'মসুল' থেকে।  ইরাকের এক বিখ্যাত বাণিজ্যনগরী হলো মসুল। এই মসুলেও অতি সূক্ষ্ম কাপড় প্রস্তুত হতো। এই 'মসুল' এবং 'সূক্ষ্ম কাপড়' এ দুয়ের যোগসূত্র মিলিয়ে ইংরেজরা অতি সূক্ষ্ম কাপড়ের নাম দেয় 'মসলিন' অবশ্য  'মসলিন' বলতে বাংলার ইতিহাসে বোঝানো হয় তৎকালীন ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে উৎপাদিত অতি সূক্ষ্ম একপ্রকার কাপড়কে। কেউ কেউ বলেন ইংরেজরা মসলিপত্তনমে বাণিজ্য ঘাঁটি গেঁড়েছিলো বলে মসলিন নাম হয়।

মসলিন তৈরির জন্য যে বিশেষ প্রকারের কার্পাস ফুটি কার্পাস দরকার হতো তা মেঘনা নদীর তীরে ভালো জন্মাতো। বিশেষ করে মেঘনার পশ্চিম তীরে তা খুব ভালো জন্মাতো। ঢাকা জেলার কয়েকটি জায়গায় তা ভালো জন্মাতো। শ্রীরামপুর, কেদারপুর, বিক্রমপুর, অধুনা কাপাসিয়া বলে খ্যাত অঞ্চলে ফুটি কার্পাস ভালো জন্মাতো। মেঘনা এমনিতে বড় নদী, সমুদ্রের কাছাকাছি, দুকূলপ্লাবী বন্যায় পলি জমতো। এই পলিতে ভালো চাষ হলেও এক বিঘা জমিতে ভালো মসলিনের জন্য ছয় কেজির বেশি কার্পাস হতো না। মসলিনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় গুজরাট থেকে তুলো আনা হতো। কিন্তু এ তুলোয় ভালো মানের মসলিন হতো না।

 নানা সূত্রে জানা যায় ১৮৫১সালে লণ্ডনে এক প্রদর্শনীতে ঢাকা থেকে যে মসলিন যায় তার এক পাউণ্ড সুতোর দৈর্ঘ্য আড়াই মাইল হয়। 'লণ্ডন ক্রনিকলে' বলা হয় হাবিব্বুল্লাহ তাঁতির বোনা একখণ্ড দশ গজ মসলিনের ওজন মাত্র তিন আউন্স হয়। রূপসী বাংলার রূপ বৈচিত্র্যের মতো বাংলার এই মসলিন জাঁকালো সৌন্দর্যের  ঝলসানিতে মন বিমোহিত করেছিল সেকালের মিশরের ফারাও, গ্রীক থেকে শুরু করে মোগল সম্রাটদের।  ইংরেজরা এর লোভে পাড়ি দেয় হাজার হাজার মাইল। হাতে কাটা এই মসলিনের এক একটা সুতোর ব্যাস ছিলো ১/১০০০ ইঞ্চি থেকে ১/ ১৫০০ ইঞ্চি। অত্যন্ত মিহি সূক্ষ্ম সুতোয় তৈরি মোহনীয় মসলিনের সুতোর কাউন্ট ৪০০ থেকে ৫৫০ বা তারও বেশি হতো।

বাংলার মসলিনের ইতিহাস হাজার বছরের। আশ্চর্য হতে হয়, মিশরের ফারাওরা  মমিকে সমাধিস্থ করার সময় লিনেনের মসলিন জড়িয়ে দিতো বলে জানা যায়। ফারাওদের ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। গ্রীক, আর্মেনীয়ান, আরবীয়রা মসলিনের ব্যবসা করতো। মসলিন চালান যেত গ্রীসে। গ্রীকরা পাথরের দেবী মূর্তিকে মসলিন পরাতো।

আরবীয় বণিক ও ঐতিহাসিক সোলায়মান তাঁর নবম শতাব্দীতে লেখা বই 'সিলসিলাতি-তাওয়ারিখ'-এ বাংলার মসলিনের নান্দনিকতার উল্লেখ করায় বোঝা যায় হাজার বছর আগেই আরব দুনিয়ায় মসলিন বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল। সে সময় জেদ্দা, মসুল, বসেরা বন্দরেও বাংলার মসলিন গৌরবের সাথে পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিল। প্রাচীনকালে মসলিনকে বলা হতো 'গঙ্গাবস্ত্র', 'গঙ্গাপট্টহি'সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলার এই অতুলনীয় বস্ত্রের নামকরণ ইংরেজরা করে মসলিন।

ঢাকা, ধামরাই, জঙ্গলবাড়ি, টিটবাদি, সোনারগাঁ, বাজিতপুর মসলিন তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিলো। জঙ্গলবাড়ির বেশিরভাগ লোকের পেশা ছিলো মসলিন বোনা। উনিশ শতকের প্রথমদিকে একশো ঘর তাঁতি পরিবার ওখানে মসলিন বুনতো। বাজিতপুরে উন্নত মানের কার্পাস উৎপাদন হতো বলে ওখানে উচ্চমানের মসলিন তৈরি হতো। মসলিন তৈরির কাজ ছিলো প্রচণ্ড কঠিন ও জটিল। এছাড়া অসামান্য নৈপুণ্য, শ্রম  ও ধৈর্যের প্রয়োজন হতো। সুতো কাটা থেকে শুরু করে মসলিন বুনতে দুজন সহযোগী সহ একজন তাঁতির কমপক্ষে দু'তিন মাস সময় লাগতো। সাধারণত মেয়েরাই প্রচণ্ড পরিশ্রম ও ধৈর্যের কাজ সুতো কাটা ও তোলার কাজ করতেন। সুতো তোলার সময় কম তাপ ও আর্দ্রতার প্রয়োজন হতো বলে সকাল ও বিকেলে এ কাজ করতে হতো। আর্দ্রতার জন্য অনেক সময় নদীতে নৌকোয় বসে এ কাজ করতে হতো। এত পরিশ্রমসাধ্য কাজের পর একজন মহিলা মাসে আধা তুলা সুতো তুলতে পারতেন। অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ ছিলো বলে ধীরে ধীরে সুতো কাটুনির সংখ্যা কমে আসতে থাকেউনিশ শতকের শুরুতেই দক্ষ মহিলার সংখ্যা কমতে থাকে। জানতে পারা যায় সুতো কাটার কাজ বিশেষ অঞ্চল ছাড়া অন্যত্র হতো না। এর বিশেষ কারণ ঢাকার ফুটি কার্পাস এবং সুদক্ষ, পরিশ্রমী ও অভিজ্ঞ শ্রমিক।

সুতো তৈরির পর তাঁতিরা তাঁতে মসলিন বুনতো, এ কাজও অত্যন্ত সতর্কতা ও ধৈর্য্য সহকারে করতে হতো। মসলিন তৈরির পর সেটা ধোয়ার কাজ। সোনারগাঁও- এর কাছে এগারোসিন্ধুর জল মসলিন ধোয়ার জন্য খুব ভালো ছিলো। আসলে জল ভালো হওয়াই বড় কথা ছিলো না। দরকার পড়তো ধোপার দক্ষতা আর ক্ষার বা সাবান সঠিকভাবে ব্যবহার। আঠারো শতকের গোড়ায় এক টুকরো মসলিন ধোয়ার খরচ পড়তো দশ টাকা। ধোয়ার জন্য একটা বিশেষ শ্রেণী তৈরি হয়েছিলো, সবাই সেটা পারতো না। ধোয়ার সময় নানাপ্রকার ফলের রস দিয়ে কাপড়ের দাগ ওঠাতে হতো। আবার নারোদিয়া নামের একশ্রেণীর লোক যারা ধোয়ার সময় কাপড়ে কোথাও সুতো সরে গিয়ে থাকলে তা রিফু করতো। এরপর কুণ্ডুগার নামের আরেক  শ্রেণীর লোক চালধোয়া জল ছিটিয়ে শঙ্খ বা ছোট মুগুর দিয়ে কাপড় ইস্ত্রি করতো। সেও অত্যন্ত সতর্কতার কাজ। কোনো কো্নো মসলিনে সুঁচের কাজ বা চিকনের কাজ করা হতো। ঢাকার চিকনের কাজের সুনাম ছিলো। কোনো কোনো কাপড়ে রঙ করা হতোএরপর কাপড় প্যাক করা হতো। এই কাজ যারা করতো, তাদের বলা হতো বস্তাবন্দ। ইংরেজদের কারখানা ছিলো তেজগাঁও -এ, ওখানে সব কাজ শেষে প্যাকিং হলে কলকাতা পাঠানো হতো। সেখান থেকে ইউরোপে পাঠানো হতো।

সুতোর সূক্ষ্মতা, বুনন শৈলী ও নকশার পার্থক্য অনুযায়ী আলাদা করা হতো বিভিন্ন ধরনের মসলিনকে। আলাদা আলাদা নাম থেকে সহজেই মসলিন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়।

ঝুনা : ঝুনাশব্দটি, জেমস টেইলরের মতে, এসেছে হিন্দী ঝিনা থেকে, যার অর্থ হলো সূক্ষ্ম। ঝুনা মসলিনও সূক্ষ্ম সুতো দিয়ে তৈরি হতো, তবে সুতোর পরিমাণ থাকতো কম। তাই এ জাতীয় মসলিন হালকা জালের মতো হতো দেখতে। একেক টুকরা ঝুনা মসলিন লম্বায় ২০ গজ, প্রস্থে ১ গজ হতো। ওজন হতো মাত্র ২০ তোলা। এই মসলিন বিদেশে রপ্তানি করা হতো না, পাঠানো হতো মোঘল রাজ দরবারে। সেখানে দরবারের বা হারেমের মহিলারা গরমকালে এ মসলিনের তৈরি জামা গায়ে দিতেন।

আব-ই-রওয়ান : আব-ই-রওয়ান ফারসি শব্দ, অর্থ প্রবাহিত জল। এই মসলিনের সূক্ষ্মতা বোঝাতে প্রবাহিত জলের  মতো টলটলে উপমা থেকে এর নামই হয়ে যায়। লম্বায় হতো ২০ গজ, চওড়ায় ১ গজ, আর ওজন হতো ২০ তোলা। আব-ই-রওয়ান সম্পর্কে প্রচলিত গল্পগুলোর সত্যতা নিরূপণ করা না গেলেও উদাহরণ হিসেবে বেশ চমৎকার।

খাসসা : ফারসি শব্দ খাসসা। এই মসলিন ছিলো মিহি আর সূক্ষ্ম, অবশ্য বুনন ছিলো ঘন। ১৭ শতকে সোনারগাঁ বিখ্যাত ছিলো খাসসার জন্য। ১৮-১৯ শতকে আবার জঙ্গলবাড়ি বিখ্যাত ছিলো এ মসলিনের জন্য। তখন একে জঙ্গল খাসসাবলা হতো। অবশ্য ইংরেজরা একে বলতো কুষা

শবনম : শবনমকথাটার অর্থ হলো ভোরের শিশির। ভোরে শবনম মসলিন শিশির ভেজা ঘাসে শুকোতে দেয়া হলে শবনম দেখাই যেত না, এতটাই মিহি আর সূক্ষ্ম ছিলো এই মসলিন। ২০ গজ লম্বা আর ১ গজ প্রস্থের শবনমের ওজন হতো ২০ থেকে ২২ তোলা। তাছাড়া ডোরিয়া, নয়নসুখ, বদনখাস, সর-বন্ধ, রঙ্, আলিবালি, তরাদ্দাম, তনজেব, সরবুটি, চারকোনার কথাও জানা যায়।

মসলিন তৈরির  জন্য দরকার হতো বিশেষ ধরনের তুলা, ফুটি কার্পাস। এ বিশেষ ধরনের কার্পাসটি জন্মাতো মেঘনা নদীর তীরে ঢাকা জেলার কয়েকটি স্থানে। একদম ভালো মানের কার্পাস উৎপন্ন হতো মেঘনার পশ্চিম তীরে। যে কধাপ  পেরিয়ে তৈরি হতো মসলিন সেগুলো হলো; সুতো নাটানো, টানা হোতান, সান বাঁধা, নারদ বাঁধা, বু-বাঁধা, আর সবশেষে কাপড় বোনা। এসব শেষ করতে একজন তাঁতি আর তার দুজন সহকারীর লাগতো কমপক্ষে দুতিন মাস।

মসলিন ছিল নানা রকমের। এর পার্থক্য নির্ণীত হতো সুতার সূক্ষ্মতা, বুনন আর  নকশার বিচারে। সবচেয়ে সূক্ষ্ম সুতার তৈরি, সবচেয়ে কম ওজনের মসলিনের কদর ছিল সবার চেয়ে বেশি, দামটাও ছিল সবচেয়ে চড়া। ‘মলবুস খাস’ ছিল সবচেয়ে নামী, সেরা মসলিন। সম্রাটের জন্য তৈরি হতো এই মসলিন।

“চরকায়  সম্পদ, চরকায় অন্ন
বাংলার চরকায় ঝলকায় স্বর্ণ
বাংলার মসলিন
বোগদাদ রোম চীন
কাঞ্চন  তৈলে কিনতেন একদিন”


 মসলিন তার সূক্ষ্মতা ও রমণীয়তা পেলবতার জন্য জয় করে নিয়েছিল সম্রাট, সম্রাজ্ঞী, নায়েবে নাজিম, শাহজাদা-শাহজাদীদের হৃদয়।  ত্রয়োদশ শতকে বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা যখন সোনারগাঁও আসেন তখন তিনি সোনারগাঁওয়ের মুসলিম তাঁতিদের বয়নকৃত সূক্ষ্ম বস্ত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। চতুর্দশ শতকে গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে চৈনিক পরিব্রাজকরা কংসুলোর নেতৃত্বে সোনারগাঁও, পাণ্ডুয়া ভ্রমণ করেছিলেন। চীনা দূতদের মালদহের আম খাওয়ানোর পাশাপাশি সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্র উপহার দেওয়া হয়েছিল।

চীনাদের ইতিহাস মিশরে বাংলার মসলিনের কথা উল্লেখ আছে। চীনা দূতরা বাংলার মুসলিম কারিগরদের বয়নকৃত কয়েক পদের বস্ত্রের কথা উল্লেখ করেছিলেন। সে সময় জেদ্দা, বসরা, মসুল বন্দরেও ব্যবসায়ীদের আরাধ্য বস্ত্র হিসেবে পরিচিতি পায় বাংলার মসলিন। তবে ঢাকাই মসলিন তার খ্যাতি এবং মনোযোগের শীর্ষে পৌঁছায় মূলত মোঘল শাসন আমলেই।

১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে জেমস টেলর ঢাকাই মসলিম রপ্তানি সংক্রান্ত যে হিসেব দিয়েছেন তাতে দেখা যায় ঢাকা জেলার আড়ত থেকে বছরে প্রায় ২৮ লক্ষ টাকার মসলিন বিদেশে রপ্তানি হতো। তারমধ্যে সোনারগাঁও-এর আড়ত থেকেই উৎপাদিত হতো প্রায় ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার মসলিন। ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজরা যখন বাংলার কর্তা  হয়ে ওঠে তখন তারা বছরে আট লাখ টাকার মসলিন রপ্তানি  করতো। সেই সময়ে ফরাসিরা কিনেছিলো প্রায় তিন লাখ টাকার মসলিন। এরা ছাড়াও ইরানি, তুরানি, আর্মেনীয়দের পাশাপাশি দেশী ব্যবসায়ীরাও এ নিয়ে ব্যবসা করতেন। সব মিলিয়ে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সে আমলে ঢাকা আর বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির জন্য কেনা হয়েছিল প্রায় ঊনত্রিশ কোটি টাকার মসলিন।

চার পাঁচশো বছর আগে যে মসলিন হয়ে উঠেছিল পৃথিবী বিখ্যাত, মাত্র দেড়শো বছরের  মধ্যেই তা হারিয়ে গেল কেন?

পলাশীর যুদ্ধের পর পর মসলিন রপ্তানির ব্যবসা প্রায় পুরোটাই ধীরে ধীরে করায়ত্ত  করে নেয় ইংরেজ কোম্পানি। তাদের রপ্তানি হতো মূলত ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে।  পলাশীর যুদ্ধের আগ পর্যন্ত দালালরা বিভিন্ন জায়গা থেকে দামি মসলিন সংগ্রহ করে কোম্পানিতে সরবরাহ করতো। পলাশীর যুদ্ধের পর মসলিন সংগ্রহের জন্য গোমস্তা নিয়োগ করা হয়, যারা ছিল কোম্পানির বেতনভূক্ত কর্মচারী। এই গোমস্তারা মসলিন সংগ্রহের জন্য হয়ে উঠে নিষ্ঠুর ছিল। চালাতে থাকে অমানুষিক অত্যাচার।  মসলিন তাঁতিরা দিশেহারা হয়ে উঠে এই গোমস্তাদের অত্যাচারে। দেশীয় গোমস্তারাই হয়ে উঠেছিলো দেশের মানুষের শত্রু।

মসলিনের সাথে জড়িত আমাদের দেশের প্রতিটি কৃষক, শ্রমিক, তাঁতিকে নানাভাবে ঠকানো হতো, নির্যাতন করা হতো। গরীব চাষিকে টাকা ধার দিয়ে তার কাছ থেকে খুব কম দামে কার্পাস নিয়ে যেত একশ্রেণীর দেশী মানুষ। দেশী মানুষরা যারা  দালাল-পাইকার হিসেবে কাজ করতো তারাও তাঁতিদেরকে ঠকাতো নানা ভাবে। গোমস্তারা তো রীতিমত অত্যাচার করতো তাঁতিদেরকে। হিসেবে দেখা যায়, আনুমানিক ১৭৪০ সালের দিকে এক টাকায় পাওয়া যেত প্রায় একমণ চাল। আর একজন তাঁতি মসলিনের কাজ করে পেতো মাসে দুই টাকা, অর্থাৎ দুই মণ চালের দাম! যাতে তার পরিবারের খাবারই ঠিকমতো চলতো না, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তো অনেক দূরের কথা।


সরোজিনী নাইড়ুর একটি কবিতায় নির্মম এই দুর্দশার ছবি জীবন্ত হয়ে উঠেছে
“Weavers weaving solemn and still,
Why do you weave in moonlight chill?
White as a feather and white as cloud,
We weave a dead man’s funeral shroud’.

কী ভীষণ ট্রাজেডি, যাঁরা তৈরি করতেন বাংলার গর্ব, যাঁদের তৈরি কাপড় গায়ে  উঠতো সম্রাটের, রপ্তানী হতো বিদেশে, তাঁর গায়েই থাকতো না কাপড়, পেটে  পড়ত না ঠিক মতো খাবার। আর সবচেয়ে  দুঃখজনক বোধহয় এটাই যে, এই  অবিচারের পেছনে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিলো এ দেশেরই দালাল, পাইকার আর গোমস্তারাই।

ইংরেজরা মসলিন তাঁতিদের আঙুল কেটে ফেলতো। আবার এও শোনা যায় যে,  তাঁতিরা নিজেরাই নাকি নিজেদের আঙুল কেটে ফেলতো, যাতে করে এই অমানুষিক পরিশ্রম আর কম পারিশ্রমিকের কাজে তাদের বাধ্য না করা হয়। সোনারগাঁয়ে জনশ্রুতি রয়েছে, সেখানকার একটা পুকুরেই মসলিন শিল্পীদের কাটা আঙুল নিক্ষেপ করা হতোতবে আঙুল কেটে ফেলার ঘটনা কো্নো ইংরেজ ঐতিহাসিক স্বীকার না করলেও কার্পাস কৃষক আর তাঁতিদের উপর কোম্পানী, ব্যবসায়ী, গোমস্তা আর পাইকাররা যে অমানুষিক অত্যাচার চালাত, সেটি জাজ্বল্যমান সত্যি। আমাদের গর্বের এই মসলিনের সঙ্গে কালিমার মতো লেপ্টে আছে এই রূঢ় সত্যটাও।




বিলাতে ঢাকাই মসলিনের উপরে উচ্চহারে কর আরোপ করা হয়, ফলে মসলিনের দাম ওখানে বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। স্বভাবতই বিক্রি কমে যায় মসলিনের।
ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে উনবিংশ শতাব্দীতে তৎকালীন ব্রিটিশরাজ স্থানীয় শিল্পকে ধ্বংস করবার জন্য পরিকল্পিতভাবে দেশীয় বস্ত্রের উপরে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কর আরোপ করে, যেখানে ব্রিটেনে প্রস্তুত করা আমদানীকৃত কাপড়ের উপরে মাত্র ২ থেকে ৪ শতাংশ কর ছিলো। বিলেতের সস্তা সুতো ঢাকায়, ভারতে আসতে থাকে, তা  থেকে তৈরি হতে থাকে কাপড়, হারিয়ে যেতে থাকে মসলিন।

মসলিনের পড়তির সময়টায় পতন ঘটতে থাকে আমাদের নবাব-সম্রাটদেরও। তাঁরা আর বেশি টাকা দিয়ে মসলিন কিনছেন না চাহিদা কম ছিল অভ্যন্তরীণ বাজারেও। তাছাড়া মুঘল সম্রাট, নবাব, ব্যবসায়ী কেউই এ শিল্প রক্ষা কিংবা প্রসারে কোনো সময়ই তেমন কোনো উদ্যোগ নেননি সব সময় চেষ্টা করেছেন কীভাবে কৃষক-তাঁতিদের যতটা সম্ভব শোষণ করে নিজেরা লাভবান হওয়া যায়।  এই সব মিলিয়ে এভাবেই ধীরে ধীরে আমাদের আরও অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মতো হারিয়ে যায় মসলিনের স্বর্ণযুগও।



1 টি মন্তব্য: