ফ্রম জেমস বন্ড, উইথ ইডিওলজি
(সপ্তম পর্ব)
কম্যুনিজম ও জেমস বন্ড
“Listening to the news led easily
into a pleasant discussion on the horrors of atomic warfare. Colonel
Easterbrook said that the real menace to civilisation was undoubtedly Russia,
and Edmund said that he had several charming Russian friends— which
announcement was coldly received.”
ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছে। একা রাশিয়া। ইতালি এবং কিছুটা
জার্মানি বাদে সমস্ত পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ একত্রে তার বিরুদ্ধে। সঙ্গে তাদের দোসর
আমেরিকা। এই লড়াই মূলত আদর্শগত। ক্যাপিটালিজম আর কম্যুনিজম-এর লড়াই। রাশিয়ার
শক্তিবৃদ্ধি অর্থাৎ কম্যুনিজমের শক্তিবৃদ্ধি। ক্যাপিটালিস্ট বিরুদ্ধ-গোষ্ঠীর রাতের
ঘুম ছুটে যাওয়া। তাদের অস্তিত্ব সংকট। সাধারণ মানুষকে কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে
ক্ষেপীয়ে তুলতে জনপ্রিয় সাহিত্যকে ব্যবহার। এই সময় রাশিয়া-বিরোধী ও
কম্যুনিজম-বিরোধী প্রচারের বহু উদাহরণ পাওয়া যায় ইউরোপীয় জনপ্রিয় সাহিত্যে। এগুলো
অবশ্য রাষ্ট্রীয় ইডিওলজির পাশাপাশি ঠাণ্ডা যুদ্ধের প্রতি আপামর ব্রিটিশ জনসাধারণের
সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির উদাহরণও বটে। যেমন উপরের ওই উদ্ধৃতিটি। আর একজন বিখ্যাত
‘জনপ্রিয় সাহিত্যিক’ আগাথা ক্রিস্টির ‘আ মার্ডার ইজ অ্যানাউন্সড’ গল্প। ১৯৫০ সালে
লেখা। সাধারণ মানুষের রাশিয়া-বিরোধী একপেশে মানসিকতার উদাহরণ। এরকম আরও বহু আছে।
তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সব প্রচারগুলো ছিল শুধুমাত্র সামান্য উল্লেখ হিসেবে।
গল্পের গঠনে সেইভাবে কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব এই প্রচারগুলো বিস্তার করত না।
পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটল ফ্লেমিং-এর মাধ্যমে।
ক্রিস্টির মতো ছোটো রেফারেন্স
দেওয়ার বদলে ফ্লেমিং তার গল্পের ইমারতগুলিকেই তৈরি করে মূলত রাশিয়া-বিরোধী ও
কম্যুনিজম-বিরোধী মানসিকতার ভীতের উপরে। পরোক্ষভাবে রাশিয়ার সমালোচনা এবং
বিরুদ্ধ-প্রচার; মার্ক্সীয় তত্ত্বের একেবারে উলটো পথে হেঁটে পরোক্ষভাবে বুর্জোয়া
ভোগবাদের প্রচার এবং উপাসনা— বন্ডের গল্পের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে। আগেই সেই গোপন
ইস্তাহারগুলিকে সর্বসমক্ষে পড়ে ফেলা হয়েছে এই ধারাবাহিক প্রবন্ধের আগের
কিস্তিগুলোতে। তবে এই পরোক্ষ-ইডিওলজি, এই ‘হিডেন এজেন্ডা’ বাদ দিয়ে
প্রত্যক্ষভাবে কম্যুনিস্ট শাসনাধীন রাশিয়াকে নঞর্থক রূপে পরিবেশনের ‘ব্ল্যাক
প্রোপাগান্ডা’ ফ্লেমিং-এর গল্পে, বিশেষত ‘ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ’ গল্পে, ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে। ফ্লেমিং-এর দু’টি উপন্যাসে যথাক্রমে
কাস্ত্রো এবং ফ্যাসিস্ট জার্মানিকে শত্রুপক্ষ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর বাকি সমস্ত
কাহিনীতে সরাসরি রাশিয়া, অথবা রাশিয়ার মদত-পুষ্ট কোনো সংস্থা গোপন ও ভয়ঙ্কর
ষড়যন্ত্রে নেমেছে “to shake the governments of the Western World”।
‘ফ্রম রাশিয়া,
উইথ লাভ’ গল্পের প্রথম দিকের চ্যাপ্টারগুলোতে
রাশিয়ার যে চিত্র আঁকা হয়েছে তা এক ভয়ঙ্কর রাশিয়াকে তুলে ধরে। রেড গ্রান্ট, গল্পের
দানবীয় ও মানসিক বিকারগ্রস্ত খুনে খলনায়ক, এবং রুশ সরকারের মধ্যে চারিত্রিক
বৈশিষ্ট্যগত সমান্তরাল টানা হয়েছে। গ্রান্ট নিজেই এই সামঞ্জস্য চিহ্নিত করে:
“He liked all he heard about the Russians, their brutality, their
carelessness of human life, and their guile…”
বিপরীতে রাশিয়াও তাদের নিজেদের মতে
‘ম্যাড’ এবং ‘আনপ্লেজ্যান্ট’ গ্রান্টকে চরম স্বার্থপরের মতো নিজেদের স্বার্থে
বিভিন্ন হিংস্র ও কুৎসিত কাজে লাগায়। গ্রান্ট এবং রাশিয়া দুই’ই ভয়ঙ্কর
ষড়যন্ত্রকারী, শক্তিশালী খুনি, ক্ষমতালোভী উন্মাদ এবং বিষাক্ত স্বভাববিশিষ্ট
হিসেবে একই বন্ধনীতে আবদ্ধ। শুধুমাত্র গ্রান্ট নয়, বেশিরভাগ রুশ ব্যক্তিকেই
অত্যন্ত অস্বাভাবিক, ঘৃণ্য স্বভাববিশিষ্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে। যেমন দেখানো হয়েছে
দাবা চ্যাম্পিয়ন এবং রুশ গুপ্ত ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাকারী ক্রন্সটীনকে একজন
যন্ত্রবৎ, ভালো-মন্দের ঊর্ধ্বে, একজন সামাজিক ডারউইনবাদী ব্যক্তি যে একেবারেই
আগ্রহী নয় “in human
beings— not
even in his own children.” এমনকি, তার কাছে
ভালো-মন্দের কোনো বিভেদ নেই: “Nor
did the categories of ‘good’ and ‘bad’ have a place in his vocabulary”। ক্রন্সটীনের সহযোগী রোজা ক্লাবও শয়তানের আর এক রূপ:
“In her, the herd instinct would also be dead. Her urge for
power demanded that she should be a wolf and not a sheep”
এদের পাশে অবশ্য টাটিয়ানা রুশদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা ‘guile’-এর কবল থেকে মুক্ত, এবং বন্ড তা
সহজেই উপলব্ধি করে:
“Bond meant that she didn’t look
to him like a Russian spy. None of the coldness, none of the calculation. She
gave the impression of warmth of heart and gaiety. These
things shown out through the eyes.”
রুশ সরকারের জটিল,
বিশ্বাসঘাতকতা ও তঞ্চকতাপূর্ণ সরকারী নীতি হচ্ছে— যাকে মার্ক্সীয় প্রোপাগান্ডারই
অন্য রূপ বলে ধরে নেওয়া যায় কারণ রাশিয়া মার্ক্সীয় শাসনাধীন রাষ্ট্র— তাদের
‘হার্ড-সফট’ নীতি। তথাকথিত এই দ্বিচারী নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই কপট নীতি প্রয়োগের
ফলে গর্বিত ও আনন্দিত জেনারেল ‘জি’-এর কথায়:
“We open our frontiers to a lot of newspaper men and actors and artists
although we know many of them to be spies. Our leaders laugh and make jokes at
receptions in Moscow. In the middle of the jokes we drop the biggest test bomb
of all time. Comrades Bulganin and Krushchev and Comrade General Serov [General
G. carefully included the names for the ears of the tape-recorder] visit India
and the East and blackguard the English. When they get back, they have friendly
discussions with the British Ambassador about their forthcoming goodwill visit
to London. And so it goes on— the stick and then the carrot, the smile and then
the frown. And the West is confused. Tensions are relaxed before they have time
to harden. The reactions of our enemies are clumsy, their strategy
disorganized. Meanwhile the common people laugh at our jokes, cheer our
football teams and slobber with delight when we release a few prisoners of war
whom we wish to feed no longer!”
এহেন
ঢঙে কম্যুনিস্ট শাসিত রাশিয়া ও তার রাষ্ট্রনীতিকে পরিবেশন করা হয়। এর মাধ্যমে
ফ্লেমিং রাশিয়াকে “the
real menace to civilization” রূপেই প্রতিষ্ঠা করে। এবং এহেন রুশদের
বিপরীতে জেমস বন্ড হচ্ছে টোটালিট্যারিয়ানিজম-এর বিরুদ্ধে ঘোষিত ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ণ
একা মহাবীর:
“In thus embodying an ideal blend of trained programming and
improvisation…Bond constitutes an exemplary hero of capitalist individualism
constructed in opposition to the rigidities of communist totalitarianism.”
বন্ডের
ইডিওলজি হচ্ছে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। অবশ্যই বুর্জোয়াতান্ত্রিক গণতন্ত্র। এই
প্রেক্ষিতে বন্ডও, বা ফ্লেমিং-ও, দ্বিচারীতার দোষে দুষ্ট। বহু ক্ষেত্রেই বন্ড
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেয়ে গণতন্ত্র লাভের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে নামে।
বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ক্ষেত্রে:
“More often than not, however,
Bond was fighting to keep the world free not for, but from democracy. If Bond manifested
nothing but disdain at social-democracy at home, democracy as such was
discarded when turning to the so-called Third World...”
তৃতীয়
বিশ্বের দেশগুলির রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ তথাকথিত ‘ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ নীতির পরিপন্থী।
ফলস্বরূপ, ফ্লেমিং-এর মতে, এই জাতীয় গণতন্ত্র সাধারণ মানুষের, অর্থাৎ নিম্নবর্গ
এবং নিম্নবিত্ত মানুষের প্রকৃত উন্নতির পরিপন্থী কারণ একমাত্র হেজিমোনিক ও
সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থাই এদের জন্যে উপযুক্ত। উদাহরণ হিসেবে তুর্কীর কথা বলা
হয়েছে, যদিও বন্ডের নিজের মুখে নয়, বরং তুর্কীর ঘরের ছেলে ডার্কো কেরিমের মাধ্যমে:
“Kerim
harangued the waiter. He sat back smiling at Bond. “That is the only way to
treat these damned people. They love to be cursed and kicked. It is all they
understand. It is in the blood. All this pretence of democracy is killing them.
They want some sultans and wars and rape and fun. Poor brutes, in their striped
suits and bowler hats. They are miserable. You’ve only got to look at them.”
এখানেও ফ্লেমিং, এবং তার সৃষ্ট
চরিত্র বন্ড এক বৃহত্তর ইডিওলজির ধারক, বাহক, প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাতা হয়ে ওঠে; এবং
সরাসরি, প্রত্যক্ষ ভাবে।
বিভিন্ন পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ঘটনা,
বিভিন্ন অন্তর্নিহিত মাত্রা। ইয়ান ফ্লেমিং-এর নিজের চোখে জেমস বন্ড দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী এবং ঠাণ্ডা যুদ্ধ সময়কালীন এক চরিত্র। সেই ঐতিহাসিক পটভূমিতে
সে বন্ডকে দেখে ও সৃজন করে তাকে, রূপ দেয়, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে তোলে। বন্ড কিছু
নির্দিষ্ট ইডিওলজির দ্বারা চালিত হয়ে, এবং কিছু নির্দিষ্ট ইডিওলজির ধারক ও বাহক
হয়ে ওঠে: কম্যুনিজম-বিরোধী বুর্জোয়া ইডিওলজি, টোটালিট্যারিয়ানিজম-বিরোধী
মুক্ত-বিশ্বের ইডিওলজি, সাম্যবাদ বিরোধী ভোগবাদ ও কনজিউমারিজম-এর ইডিওলজি। এবং, ওই নির্দিষ্ট
ঐতিহাসিক পটভূমিতে, বৃহত্তর সমাজ বা সভ্যতার অংশ হিসেবে এই ইডিওলজিগুলিই বন্ডের
জনপ্রিয়তার মূল কারণ। এখানেই ফ্লেমিং নিজে প্রত্যক্ষ ভাবে রাষ্ট্রীয় ইডিওলজির ধারক
ও বাহক হয়ে ওঠে। বন্ডের এই বিপুল জনপ্রিয়তা এবং বন্ডের মাধ্যমে প্রচারিত রাষ্ট্রীয়
ইডিওলজির প্রভাব এতোই সুদূরপ্রসারী ছিল যে বন্ডের জনপ্রিয়তার কাউন্টার হিসেবে
রাশিয়ার মতো সম্পূর্ণ কম্যুনিস্ট শাসনাধীন রাষ্ট্রও মার্ক্সীয় মতাদর্শ ও বিশ্বাসের
কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে এসে জাকভ নামে অন্য এক কাউন্টার-স্পাই চরিত্রের সৃষ্টি করতে
বাধ্য হয়েছিল যে একটি গল্পে জেমস বন্ডের সঙ্গে সম্মুখ সমরে নামে এবং তাকে পরাজিত
করে ‘রাশিয়ান সুপ্রিমেসি’কে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে:
“...USSR
(actually, the KGB) [who] persuaded the Bulgarian writer Andrei Gulyashki to
write the book Zakhov Mission (1966;
originally ‘Avakum Zakhov versus 07’, serialized in the Soviet youth paper Kosomolskya Pravda) in which Zakhov sets
out to destroy James Bond, the ‘supreme example of imperialist espionage’.”
এই ঘটনাটিই ইয়ান ফ্লেমিং-এর এবং জেমস বন্ডের সর্ববৃহৎ
সাফল্য। এমনকি, পশ্চিমী
দেশগুলির রাষ্ট্রীয় ইডিওলজিরও— বুর্জোয়া তন্ত্রেরও। এই সাফল্যের রেশ বজায় রেখে, এই
সাফল্যের সূত্র ধরে, আবার একবার একদম শুরুর ইমেজটিতে ফেরা যাক। লেখক, রাষ্ট্রীয়
ইডিওলজি, চরিত্র, ঐতিহাসিক পটভূমি। এক কাল্পনিক চতুর্ভুজ। ঘটনাস্থলের বাইরে থেকে, উপর থেকে, অথবা পিছন থেকে, দূরবীনের
নাবিক বিন্দুতে চোখ রেখে দেখলে আতস কাচের উলটো পিঠে এই কাল্পনিক চতুর্ভুজের
অস্তিত্ব স্পষ্ট আকার ধারণ করে। ইয়ান ফ্লেমিং,
বুর্জোয়া তন্ত্র, জেমস বন্ড, ঠাণ্ডা যুদ্ধ। এক সম্পূর্ণ চতুষ্কৌণীক মানচিত্র।
সূত্র ও ঋণ
1) Ishay Landa. ‘James Bond: A Nietzschean for the Cold War’.
2) Dilip Kumar Basu. ‘Introduction’. From Russia, with Love.
সমগ্র ধারাবাহিক প্রবন্ধটির প্রধান গ্রন্থঋণ
1) Ian
Fleming. From Russia, with Love. Dilip Kumar Basu. ed.
Worldview. 2001.
v ‘ফ্রম রাশিয়া, উইথ লাভ’ গল্পের সমস্ত উদ্ধৃতি এই গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত।
2) Tony Bennet. ‘Marxism and Popular
Fiction’. Literature and History. 7, Autumn 1981.
3) Michael Denning. ‘Licensed to
Look’. Cover Stories: Narrative and Ideology in the British Spy Thriller. Routledge
& Kegan Paul. London and New York, 1987.
4) James Bond and Philosophy: Questions Are Forever. ed. Jacob M. Held and James B. South. Open Court. Chicago and La
Salle, Illinois, 2006.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন