বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ২০১৭

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

চেতন ভগৎ : 'আ ভাইরাস ফ্রম আউটার স্পেস'

রাজমোহনের বরাবরি চেতন ভগৎ নিয়ে চাপ ছিল। লেখা খারাপ। রাজনীতি রিগ্রেসিভ। চাপ হবে না কেন? সাহিত্য পরে, ঐরকম ইংরেজি লিখলে ওর বই পড়ে যারা ভাষা শেখার চেষ্টা করবে, তাদেরও হুড়কো হয়ে যাবে। তাও জনপ্রিয় লেখক বলে কথা! রাজমোহন যখন ইংলিশ অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেলো, ওর বাবার বন্ধু  নবেন্দুকাকু ওকে ভগতের একটা উপন্যাস গিফ্ট করলো। নাম, 'রেভোলিউশন ২০২০'সালটা ছিল ২০১১। তার মানে ফিউচারিস্টিক নভেল? রাজমোহনের নবেন্দুকাকুর ওপর মাথাটা হেব্বি গরম হয়ে গেলো। সে কিনা ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। একটা ভালো কলেজে পড়ে। ব্যাগে করে রোজ নবারুণ ভটচাজের 'হারবার্ট' নিয়ে ঘোরে। তাকেই চেতন ভগৎ গিফ্ট করা! যাক কি আর করবে! বই বেচার অভ্যেস নেই রাজমোহনের। তাই বুকশেল্ফের মধ্যে প্রায় লুকিয়ে দিলো লাল কাভারের কুৎসিত ইলাস্ট্রেশনসহ বইটাকে।
এরপর অনেকগুলো বছর কেটে গিয়ে ২০২০ চলে এলো। রাজমোহন তখন কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। সে ভুলেই গিয়েছিল বইটার কথা। ভগৎ বাবাজী বিজেপির সরকারের বাজারে তাঁবেদারিতে ভিড়েছেন। ডান্স রিয়ালিটি শো জাজ করেন আর সোশ্যাল মিডিয়াতে তল্পিবাহনের কাজ করে থাকেন। লেখালিখি থ্যাঙ্কফুলি প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু এক দশক ধরে লেখা বেস্টসেলারগুলো তো রয়েছে! বছরে দু'বছরে বলিউড একটা করে সিনেমাও নামিয়ে দেয় সেইসব ঝাঁটের গল্প নিয়ে। বক্স অফিস খায়। ভগৎ খুশ। একদিন রাজমোহনের এক ছাত্র যখন ওকে ভগৎ পড়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করলো, রাজমোহনের হঠাৎ মনে পড়লো,  'রেভোলিউশন ২০২০'র কথা আর এক মুহূর্তে গোটা ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেলো। 

২০২০র প্রথম থেকেই রাজমোহন কিছুতেই একটা কেস সামাল দিতে পারছিলো না। তার বাড়ির লাইব্রেরিতে একটা ছোটখাটো রায়ট হয়ে চলছিল। দোকানে যতরকম ন্যাপথলিন, ইঁদুর মারার ওষুধ, বইয়ের পোকা মারার ওষুধ পাওয়া যায় সব এনে ট্রাই করেও ৬ মাস ধরে বইয়ের পাতায় পোকা ধরা কিছুতেই থামাতে পারছিল না। প্রত্যেক উইকেন্ডে একেকটা সেট বই বার করে রোদে দিতো, আলমারির দরোজা খুলে হাওয়া খাওয়াতো। কখনো কোনো পোকা ধরাও পড়েনি। একদিন ডিসিনফেক্ট করার জন্য রীতিমত লোক ডেকেছিল। তারাও কিছু সুবিধা করতে পারেনি। আজ ছাত্রের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ গল্পটা ক্লিয়ার হয়ে গেলো। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরেই একেকটা শেল্ফ ধরে তন্ন তন্ন করে বইটা খুঁজলো। কিছুতেই খুঁজে পেলো না। রাজমোহনের ভিশুয়াল মেমারি বলছে, ডানদিকের  আলমারির ওপর থেকে তিন নম্বর তাকে বইটা দেখেছে। পাশে একদিকে ছিল সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের '৫০ টি গল্প' আর অন্যদিকে অনিতা দেসাইয়ের 'জিগজ্যাগ ওয়ে' উপন্যাসটা। মাঝে মাঝে সেগুলো নিতে গিয়ে যেন আড়চোখে দেখেছে বলে মনে হলো। কিন্তু নাহ, ঐ শেল্ফ জুড়ে খানাতল্লাশি করেও কোন লাভ হলো না। ২০২০র বিপ্লব গায়েব! অথচ রাজমোহন ততক্ষণে নিশ্চিত যে এই বইই যত নষ্টের গোড়া। এ বই না সরালে তার লাইব্রেরি ছাড়খাড় হয়ে যাবে। হঠাৎ কি মনে হতে রাজমোহন যে শেল্ফে বইটা মনে করতে পারছিল তার অন্যান্য বইগুলো শাফল করে দেখতে লাগলো। আর তখনি লক্ষ্য করলো আশ্চর্য সেই ঘটনাটা।


রাজমোহন ফ্যালফ্যাল করে দেখলো ওই শেল্ফের প্রত্যেকটা বইয়ে 'রেভোলিউশন ২০২০' র একটা করে পাতা এসে জুড়ে বসেছে। বইটা প্রায় ৩০০ পাতার। ওই শেল্ফ ছাড়িয়ে আগের আর পরের শেল্ফের বইগুলোতেও একই কান্ড। সব বইয়ের শুরুতে অথবা শেষে একটা করে ভবদীয় ভগতের পাতা। ভগতে ভগতে ভুগতে হয়েছে বইগুলোকে। কাফকা, উল্ফ, কোয়েৎজি, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, তুষার রায়, আনা ক্যাভান, স্যামুয়েল বেকেটদের বইগুলোর পাতায় পাতায় পোকার গর্ত, কিন্তু  ভগতের সুবিভক্ত একেকটি পাতায় আঁচড় পর্যন্ত নেই।  রাজমোহনের মাথায় 'ইনফিলট্রেশন' শব্দটা চড়কিপাকে ঘুরে যেতে লাগলো। চেতন ভগতের উপন্যাস এখন দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে 'মডার্নিস্ট ইন্ডিয়ান ইংলিশ রাইটিং' এর পাঠক্রমে ঢুকে পড়েছে। দুদিন বাদে রাজমোহনকেও হয়তো পড়াতে হবে চেতন ভগৎ। রাজমোহন ভাবলো ভগৎ যেভাবে ট্রোজান হয়ে তার সাধের লাইব্রেরিটাকে সংক্রমিত করেছে তা নিয়ে একটা গল্প লিখবে। গল্পটা লিখলে দুঃখ যদি একটু কমে। তবে শুধু দুঃখমোচনের জন্যই লিখবে এমন নয়। গল্পটা নিয়ে সে ক্লাসে যাবে। এই গল্পটা পড়েই সে চেতন ভগৎকে ইন্ট্রোডিউস করবে তার ছাত্রদের কাছে।

৫টি মন্তব্য:

  1. ' সাহিত্য পরে ... ' বানান সামলান ।

    উত্তরমুছুন
  2. আপনি বুঝতে পারেন নি।
    ওটা ঠিকই আছে।
    সাহিত্য পরে ... অর্থাৎ, Literature will be judged later.
    বাংলা বাক্যটির গড়ন খেয়াল করুন।

    উত্তরমুছুন
  3. নামহীন.. নাম পরে, আগে হীনতা সামলান। সাহিত্য পড়তে এসে যদি ভাষার এমন দৈন্যদশা প্রকাশ হয়ে যায়, তবে অপ্রকাশিত থাকা ভাল।

    উত্তরমুছুন
  4. 'সাহিত্য পরে' একদম ঠিক। না বোঝার দায় লেখকের ঘাড়ে চাপানো কেন নামহীন? স্বপন রায়

    উত্তরমুছুন
  5. বামফ্রন্টের আমলে এমন কিছু লেখা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সিলেবাসে ছিল যা অধ্যাপকরা তাদের যৌবনে পড়েননি। এবং দাঁত কেলিয়ে সেই লেখকের সাথে আলাপের গল্প বলতেন। অদ্ভুত সমাপতন

    উত্তরমুছুন