শিকারনামা
ধনকুবরা পাহাড়ে
মৃগয়ায় বাহির হইয়াছিল, তাহার সঙ্গে ছিল তাহার দিশি গোমস্তা। পাহাড়ের চারপাশে
মনোরম গহীন বন। পাখির কাকলি
মুখর। কুলকুল শব্দে
একটি ঝোরাও বহিয়া নামিতেছিল ক্রমাগত সমতলের
দিকে। হঠাৎ ঝোরার
পাশে ঘোড়া থামাইয়া ধনকুবরা নামিয়া পড়িল।
গোমস্তা বলিল,
আজ দিনটা বড় খারাপ, কুনো শিকার টিকার মিলল নাই। সব শালোরা গভীর বনে গিয়া সিঁধাইছে। একটা খরগোস পর্যন্ত....
ধনকুবরা ঝোরার
পাশে গিয়া কিছু খুঁজিতেছিল, সে গোমস্তার কথার উত্তর দিল না।
- শিকারে এসে খালি হাতে ফিরা কি ভাল দেখায় মহাজন! কথা
শেষ করিয়া গোমস্তা কোনো উত্তর না পাইয়া ধনকুবরাকে লক্ষ করিয়া বলিল, কী খুঁজছেন মহাজন?
- শিকার মিলে গেছে গোমস্তা সাহেব, ইদিক এসো একবার।
ধনকুবরা গোমস্তাকে ঝোরার নুড়ি হাতে তুলিয়া
দেখাইতে গোমস্তার
মুখ চকচক করিয়া উঠিল - এ যে বড় শিকার
মহাজন!
- হ্যাঁ বড় শিকার। এ পাহাড় হামার চাই গোমস্তা সাহেব। রাজাকে বল সে যেন হামাকে ই পাহাড়
লিখে দেয়। ধনকুবরার চোখে
শিকারির হাসি।
রাজার ঢ্যারাদার
সেপাই সহযোগে পাহাড়তলি গ্রামে ঘোষণা দিয়া যাবার পর, গাঁওবুড়া ভগবান মাঝির বাড়িতে কাঁদিয়া
পড়িয়াছিল মানুষ, পাখি, পশু,
এমনকি
গাছেরাও।
ভগবান ভাবিল
ধনের পেয়াদা আসিয়াছে, তাই সে বলিল, কিছু নাই ঘরেক, ধান নাই, চাল নাই, কিছু নাই, হামি
আর কিছু দিতে লারব পেয়াদাসাহেব!
ওরা বলিল, ভগমান
আমরা, তুমার সন্তান, পেয়াদা নই, হামাদের বাঁচাও।
ভগবান বলিল,
ও তুমরা!
- হাঁ হামরা দেওতা! রাজা হুকুম দিছে পাহাড় ছাড়তে হবেক!
- হাঁ, রাজার লোক এসেছিল বটে, বুলেছিল পাহাড় ছাড়তে
হবেক। আমি কিছু বুলতে
পারি নাই। রাজার কাগজে
টিপ দিই নাই। ইখানে হামাদের
হাজার পুরুষের বাস, ছাড়তে হবেক? মুখের কথা নাকি হে! ই ডাহি
ডুংরি ঝোরা ঝরনা লদী পাথর সব তো হামদের রক্তের ভিতরে সিঁধাই আছে! ইসব তো হামদের বাপ পিতামোর হাড়,
পাঁজর। ই অন্যায়, কঠিন অন্যায় হে! আমি টিপ দিই
নাই। উরা লাল চোখ
দিখাই গেছে, আবার আসবে।
কিন্তুক হামি
কী করতে পারি বল তুমরা, বয়স হলো,
আমার
শরীলে যে আর শক্তি নাই! সব ধনকুবরা শুষে লিছে। সেই কবে এক শামুক ধান লিয়েছিলম, শোধ হলো
না
হে!
ওরা বলিল, দেওতা
ধনকুবরার শামুকে ফুটা আছে, ধান শোধ হবেক লাই। হামদের কারো কর্জ শোধ হবেক নাই। হামরা তবে কার কাছে যাব ভগমান? ধনকুবরা আমাদের গাঁও,
জঙ্গল, পাহাড় সব কিনে লিছে রাজার কাছে।
রাজা
হামাদের পাহাড় ছাড়তে বলছে, হামরা কুথায় যাব?
ভগবান মাঝি
চুপচাপ বসিয়া খানিক চিন্তা করিল, তারপর সটান
উঠিয়া দাঁড়াইল। প্রাচীন মেরুদণ্ড ধনুকের ছিলার মতো নতুন বলিয়া মনে হইতেছিল।
- ধনকুবরার মহাল ভাঙতে হবেক। তুমরা সবাই জোট হও হে! হামদের খেয়ে মশার মতো ফুলেছে উ। প্রাসাদ বানাইছে পাহাড়ের তলায়। আবার পাহাড় দখল নিতে চায়! উর অনেক সখ, উর সখে আগুন
দিতে হবেক!
- আমরা জোট আছি ভগমান। ই গোটা পাহাড় আজ তুমার আদেশ লিতে এসেছে।
রাজা বলিল,
খুব মুশকিলের কাজ প্রভু, এত লোককে একসাথে তুলে দেওয়া! এট্টু সময় তো দিন! কথা শুনিয়া প্রচন্ড খেপিয়া গেল
ধনকুবরা, তুমি শালা রাজা সেজে আছ কার পয়সায়? কার পয়সায় তুমার ই সরকারটো
চলে, আঁ? হামার প্রাসাদ
ভেঁঙে গুঁড়াই দিল আর তুমার সেপাই, লাঠিয়াল খৈনি পিয়ে নিদ লাগাল? তুমার সরকার চলবেক
লাই!
ক্ষমা দিন প্রভু,
আজই ফৌজ পাঠাচ্ছি আমি, আজই!
রাজার খুনি
সেপাইরা ঘিরিয়া ফেলিল গ্রাম, পাহাড়।
তারপর
ভগবান মাঝিকে শিকার করিয়া বাঁশে ঝুলাইয়া নিয়া চলিল বনপথে। খবর আগুনের মতো ছড়াইয়া পড়িল। দ্রুত মানুষ, পাখি, জানোয়ার, গাছগাছালি
ফুঁসিয়া উঠিল। তারা জোটবদ্ধ
হইয়া তাদের ঘিরিতে লাগিল।
ক্রমাগত
ঘিরিতে লাগিল।
যুদ্ধ থামিল না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন