সময়
ঘরগুলোতে
বহুদিন রঙের প্রলেপ পড়েনি। দরজা জানালায় রঙচটা পর্দা ঝুলছে। উত্তরে খোলা ছাদ আর দক্ষিণে এক ফালি বারান্দা।
বারান্দা বলতে ধুলোর আস্তর, ঝুলকালি,ডাই করে রাখা পুরোনো হাঁড়ি, কিছু দূরে
দৃশ্যমান কুয়াশা ঝাপসা ব্রহ্মপুত্র এবং দেওয়ালে হেলান দিয়ে
রাখা জীর্ণ এক হুইলচেয়ার। ব্রহ্মপুত্র নদের ধার ঘেঁষে একদা নির্মিত এ বাড়িতে এখন
জয়িতা ও তার পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্বামীর বাস। হুইলচেয়ারের ছেঁড়াফাটা শরীরে আতসকাচ ধরলে দেখা যেত লেখা আছে তাতে ইতিহাস। দুপুরের ফাঁকা রাস্তা ধরে বিকট শব্দে চলে গেল ইটবাহী
লরি। লরির গায়ে লেখা, সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন। জয়িতার মনে পড়ে বাবার হাত
ধরে স্কুলে যাবার পথে বাবা হাসতে হাসতে জয়িতাকে একবার বলেছিল, বল তো বাংলাদেশের
ওজন কত? জয়িতা ভ্যাবাচেকা, বাবা
তখন আঙুল উঠিয়ে বলেছিল আরে দ্যাখ মামণ পড়া ধরিনি, ট্রাকের গায়ে কী লেখা দেখ! জয়িতারা কবে যেন ময়মনসিংহ থেকে এই শহরতলীতে চলে এসেছিল? মানুষ
তখনও আন্তরিক, এপাড়া ওপাড়া আসা যাওয়া, বিকেল হলে ছেলেদের রকে বসে আড্ডার চল। ছিমছাম শহরতলী, জয়িতার জায়গাটা ভালো লেগে গেছিল। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার
আদালতপাড়ায় বি চৌধুরীর নাম তখন জ্বলজ্বল করে। ক্রিমিনাল কেসে তিনি বাঘের মতো
লড়িয়ে। সেই রমরমা অবস্থান ছেড়ে, অত বড় বাড়ি বিক্রি করে ভাগ্যতাড়িতের মতো তিনি
কেন এই শহরতলীতে এসে পড়লেন... তা পুরনো কথা কে কবে অত
মনে রেখেছে!
সময়ই বা কখন কারো জন্য
থেমে থেকেছে! সে
তার নিজস্ব গতিতে চলে গেছে বহু বহুদূর সোজা কিংবা বাঁক খেতে খেতে। তাই চৌধুরী
সাহেবের সেইসব দিনগুলোর কথা আজ আর কেউ জানে না। সেই পসার ছেড়ে এখানে তিনি বাস গড়েছিলেন নিজের স্ত্রীর সাধপূরণের জন্য।
চৌধুরী গিন্নীর বাপের বাড়ির জমি বেদখল হবার আশংকায় তাদের
ময়মনসিংহ জেলায় নিজস্ব বাড়িঘর ফেলে এই শহরতলীতে ফিরে আসতে হয়। এহেন আত্মবলিদানের শুরুতে নিজেকে উদার মনে হলেও
ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ
হতে শুরু করেন চৌধুরী সাহেব। আদালত বা প্র্যাকটিশ কোনোটাতেই আর মন বসেনি ফলে ক্রম বিষণ্ণতা এবং চার দেওয়ালের
ভেতর নিজেকে ফেলা। অতঃপর শয্যাশায়ী। শুরুর বিষণ্ণতা বাড়ির লোকদের তেমন করে নজরেই আসেনি । আর এভাবেই কোনো এক
সন্ধ্যায় তিনি তাঁর শ্যাওলার মতো জীবনটিকে আর গ্রাহ্য করেন না।
শয্যাশায়ী অবস্থায় তিনি সকলের উদ্দেশ্যে
ক্ষমা চাইবার ভঙ্গীতে দু’হাত একসাথে করে প্রস্থান করেন
অন্য এক ঠিকানার উদ্দেশ্যে। যেন এ হবারই ছিল। বাড়িতে
শোক উথলে ওঠার মতো
তেমন কোনো ব্যাপার ঘটে
না। নিয়ম মানতে দিন সাতেক। ক্রমেই বাড়ির স্বাভাবিকতার ছন্দে গলা উচ্চকিত হয়। ছাদে আত্মীয়রা গোল হয়ে বসে গল্প করে। কারো রাগ হলে সে তা প্রকাশে ঘরে ঢুকে সজোরে দরজা দেয়। মিসেস চৌধুরী কর্তার অনুস্পস্থিতিবলে
সমস্তকিছুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন। সময় পেরোতে থাকে নিজস্ব ছন্দে।
আজ
পাঁচ দিন সেই চৌধুরী গিন্নীও আর নেই। হঠাৎই, বুকে কেমন করছে বলতে বলতে নেই। তিনি
ছিলেন, তিনি চলেও গেলেন, মাঝখানের ওই যাপনে তার কাছাকাছি এই জয়িতাই। জয়িতা যখন এ পরিবারে বৌ
হয়ে আসে তখন চৌধুরীদের সূর্য মধ্যআকাশে তেজী
আলো ছড়াচ্ছে। এ বাড়িতে সে দ্বিতীয় ছেলের বৌ। অবিবাহিত বড় ছেলে কানাডায়। বিয়ের পর চৌধুরী বাড়ির হালচাল শিখতে শিখতে জয়িতা দেখেছিল শ্বশুরমশাই যেমন দু’হাতে
আয় করেন, শাশুড়ি তেমনি চারহাতে খরচ করেন। অকর্মণ্য
স্বামীটির তাই আয়ে মন নেই। সে বুঝেছিল স্বামী নয় শাশুড়ির আঁচল ধরে থাকে চলতে হবে। এ দীর্ঘ সময় ধরে সে তাই
করেছে। এমনকি চৌধুরী গিন্নীর শেষ দিনটাতেও আর কেউ নয়, জয়িতাই ছিল পাশে। শোকের
বাড়ি, লোকজন নেই। ঘরে অসুস্থ পঙ্গু স্বামী। আজ জয়িতা যথার্থ একা। শাশুড়ির শূন্য
ঘরের দরজায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শেষ বিকেলে
সে বিছানার পাশের টেবিল থেকে হরলিক্স,ওষুধের শিশিপত্তর তুলে এনে বারান্দায় রাখে। সঙ্গীবিহীন বিচ্ছিন্নতার হুইলচেয়ারের দিকে
তাকিয়ে নিঃসন্তান জয়িতার মনে পড়ে, শ্বশুর মশাই চলে যাবার পর জমানো টাকা একসময় তলানিতে, জমিজমাও একে একে
বিক্রি শেষের দিকে, নিচের তলায় তাই ভাড়াটে এলো। চলতে তো হবে! বড় পুত্রটি
কানাডা পাড়ি দিয়ে নিজের মতো থাকে, রোজগেরে আর কই! এসবের ভেতর
হঠাৎ
এক সকালে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে চোট পান চৌধুরী গিন্নী। ভাঙা হাড় আর জোড়েনি। পরবর্তী যাপনে জুড়ে যায় হুইলচেয়ার। দুটো
বছর সেভাবেই কাটিয়ে পাঁচ দিন আগে তিনিও চলে গেলেন। হঠাৎ যেন বারান্দায় রাখা ওষুধ আর হরলিক্সে জারিত
জয়িতা নিজেকে দেখতে পায় ওই হুইলচেয়ারে উপবিষ্ট। চক্রাকার এই খেলায় তারও সে সময় খুব
দূরে নয়। চৌধুরী গিন্নীর তবু জয়িতা ছিল। জয়িতার?
ধুলো
মুছে খবরের কাগজ আর পলিথিনে জড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসার প্রাকমুহূর্তে শক্ত করে সে বাঁধতে থাকে হুইলচেয়ার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন