মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

রঞ্জনা ব্যানার্জী

সেফু


ছবিটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ঝিম ধরে ছিল মিমি। পুরনো কাগজপত্রের ভিড় কমাচ্ছিল, হঠাৎই বেরিয়ে এলো। সেফু আর ও আর রিন্টু মামার সেই জালালী কবুতর জোড়া। রিন্টু মামাই তুলেছিল ছবিটা। কী ঝলমলে হাসি দু’জনের! বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা কাঁটাটা খচ্‌ করে জানান দিয়েছিল। স্কুল পালিয়ে প্রেমিকের সাথে সীবিচে গিয়ে আর ফেরেনি সেফু। তিন দিন পরে হাটহাজারীর কাছে রাস্তার ধারে অজ্ঞান পাওয়া গিয়েছিল ওকে। ‘তুই কি ছেলেটাকে চিনতিস?’ কানে বাজছিল রিন্টু মামার গলা।

রিন্টুমামা এখন পাকাপাকি অস্ট্রেলিয়ায়। ওখানে তখন সকাল। ফোনের এপারে ফোঁপাতে থাকে মিমি, ‘লাল স্কুটার চালাতো। দূর থেকে দেখেছিলাম একবার’রিন্টু মামা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ‘ঠিক মনে আছে তোর?’ ‘চেহারাটা মনে নেই, স্কুটারটা লাল। সেফু দেখিয়েছিল একবার ছাদ থেকে। বলেছিল ওর ‘শাহরুখ খান’মামার গলায় হতাশা, ‘কতবার জানতে চেয়েছিলাম বল্‌! পুলিশকে তখন জানালে ধরা পড়ত হয়তো। মেয়েটা এমন মরার মতো বাঁচতো না’মিমির চোখের জল বাঁধ মানে না, ‘মামা আমি দেশে যাব’। 

সেফুর ভাইজানের ঠিকানাটা রিন্টু মামাই জোগাড় করেছিলেন। ফোন নম্বরও। মণিমামা ফোনে কথা বলেছিলেন মণিমামা রিন্টুমামার বড়দা’

পাঁচ বছর ছিল মিমিরা চাটগাঁয়। ক্লাস টুতে পড়ার সময়ই বাবার ট্রান্সফারমায়ের একমাত্র পিসিমা থাকেন চাটগাঁতে। মা আনন্দে ভাসছিলেন মিমি ডাকতো ‘পিসিমাদিদা’মণি, সঞ্জীব আর রিন্টু মা’র তিন পিসতুতো ভাই

মামাদের বাড়ির গা ঘেঁষে ছিল বিল্ডিংটা। সবাই বলতো ‘দুবাইওয়ালা বিল্ডিঙ’ ঐ বাড়ির তিনতলা ভাড়া নিয়েছিল ওরাওর পুরো নাম সিফাত আরা সেফু। মিমির স্কুলেই পড়ত দু’ক্লাস ওপরে। মিমি তখন সেভেনে, সেফু নাইনে। একদিন গেটের কাছেই দেখা। রিক্সা থেকে নামছে ও। মিমি তো অবাকসেফুও। ‘তোমাদের বাড়ি?’ ‘না  আমার পিসিমাদিদার বাড়ি’একটু বাদেই পিসিমাদিদার ছাদে এসেছিল সেফু। মিমিকে সিঁড়ি থেকে ঝুঁকে ডাকছিল। মামাদের পুরনো দিনের ভারী গেইট; খোলার সময় কঁকিয়ে জানান দেয়আওয়াজ হয়নি তো! সবাই অবাক ঢুকল কোনদিকে? মিমির সাথে রিন্টু মামাও সিঁড়ি বেয়ে উঠেছিলসেফুর বিকার নেই, ‘আমি তো প্রায়ই নামি কার্নিশ বেয়ে। পায়রাদের গম খাওয়াই’ছাদে সিঁড়িঘরের জানালার ওপরে রিন্টু মামার কবুতরের বাসা। ধবধবে শাদা জালালী জোড়া; আহেলী আর আহির। রোম ঝুমঝুম মোজা পরা পা। রিন্টু মামা সেইদিনই ওর নাম দিয়েছিল ‘ছাদবান্দরী’‘ছাদ–বান্ধবী’র অপভ্রংশ। সেফু হেসে কুটিকুটি, ‘রিন্টু মামা একটা জিনিয়াস’

ঠিক সময়েই এসেছিল ওরা।  দরজায় কল বেলে চাপ দিতে না দিতেই দরজা খুলে দেন মাঝ বয়েসী প্রৌঢ়, মিমির ভাইজান। গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন, ‘আপনে ভিত্‌রে যান’ পর্দা সরিয়ে কেউ ডাকে, ‘আসুন’ মণিমামাকে বসার ঘরে রেখে মিমি পা বাড়ায়। বড় বড় চোখের বছর দশেকের মেয়ে। নিজেই নিজের পরিচয় দেয়, ‘নার্গিস’সেফুর ভাইঝি। করিডোর দিয়ে বাঁপাশের ঘরটায় ঢোকে ওরা। উত্তেজনায় মিমি অবশ প্রায়।

দরজার কাছেই অল্প বয়েসী মহিলা ‘আদাব’ দেয়। সেফুর ভাবি, নার্গিসের আম্মা আবছা আলোয় মিমি দেখে খাটের সাথে লাগানো বড় টেবিল। তাতে রাজ্যের জিনিস ডাঁই করা। পৃথুলা মহিলা বিছানায় বসে একমনে টেবিলে মাথা ঝুঁকে কিছু করছে। সেফু! এতো পালটাতে পারে কেউ! দেয়ালে প্রচুর কাগজ সাঁটা। হেলাফেলায়।  পেন্সিলে আঁকা ছবি সবমিমি কাছে গিয়ে পরখ করেপায়রা! কী নিখুঁত! সবার পা রোমঝুমঝুম। ভদ্রমহিলা বলেন, ‘সারাদিন কেবল কয়তরের ছবিই আঁকে। কথাটথা নাই। এ্যামনে সবই ঠিক। কাউরে জ্বালায় না’

মিমি কাছে গিয়ে বলে, ‘আমি মিমি’সেফু তাকায় না। একমনে আঁকতে থাকে। মিমি ব্যাগ থেকে সেই ছবিটা বার করে। ‘চিনতে পারো? আহেলী আহির?’ সেফু ঝুঁকে থাকে কাগজের ওপর। মিমি ওর হাতের ওপর ছবিটা তুলে ধরে। ‘দেখ পিসিমাদিদার ছাদ!’ সেফু উত্তর দেয় না। পেন্সিলের নিখুঁত টানে পায়রার ডানায় যত্ন করে পালক পরাতেই থাকে।

‘কে ছিল ও? শাহরুখ খান?’ আচমকাই জিজ্ঞেস করে মিমি। ঝট করে সেফু মুখ তোলে। ঘোলা চোখে দেখে মিমিকে। মিমির চোখ ভেসে যায়, ‘আই এ্যাম সরি সেফু’সেফু আঁকা ছেড়ে বিছানায় পা গুটিয়ে পাশ ফিরে শোয়। ভাবী বলেন, ‘সে  আর এখন উঠব না। আসেন বাহিরে চা দিসে’মিমি উঠে দাঁড়ায় হঠাৎ মনে হয় দেয়ালে সাঁটা পায়রাগুলো ওকে দেখছে। এতক্ষণে মিমির চোখে পড়ে দেয়াল জুড়ে সব একলা পায়রা। ওরা কেউ উড়ছে নাসেফুকে পেছন থেকেই জড়িয়ে ধরে মিমি। মিমির চোখের জলে সেফুর পিঠ ভিজে যায়; সেফু তাও পাশ ফেরে না।








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন