কোকিল
রাত দুটোয় কোকিল ডাকে কখনো? অবশ্য রাত না দিন, দুটোর মাঝখানে এখন দুলছে রাকা। ফ্যানটা চলছে ঘটাং ঘটাং করেই, জানালায় ভারী পর্দার এধারে গুমোট অন্ধকার। পর্দা সরালেও সেই অন্ধকারই থাকবে। ওপ্রান্তে এক অদ্ভুত দেওয়াল, যার শুরু আর শেষ বলে কিছুই নেই; সময় ওই দেওয়ালের ওপাশে বোম্কে আছে। চোখে মুখে জল দিয়ে এফ এমটা চালিয়ে দেয় রাকা। মোবাইলে হেডফোনের প্লাগটা গুঁজে অপর প্রান্ত কানে ঢোকায়। একটা গান হচ্ছে খুব করুণ সুরে। সুর ছাপিয়ে আবার কোকিলের ডাক শুনতে পায়। নাহ! এবারের স্বর রাগত, কিছুটা অসহিষ্ণুতার মিশেল। কোকিলটা কোথায়, পর্দা সরিয়ে দেখার চেষ্টা করে রাকা, ঠিক ঠাহর করতে পারে না।
আজ এক সপ্তাহ হলো এই ঘরে বন্দি রাকা। বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ বলতে এই মোবাইলের এফ এম-টুকু। মাঝে মাঝে একজন এসে খাবার, জল দিয়ে যায়। ঠান্ডা বিস্বাদ খাবার। প্রথম প্রথম কেঁদেছে রাকা, অভিমানে খাবার ছুঁড়ে ফেলেছে। কোনো হেলদোল ঘটেনি লোকটার। একটা অবিচল পাথরের মতো আসে, খাবার রাখে, ফ্রিজে জল ঢোকায়, নোংরা সাফাই করে বেরিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত একটাও শব্দ মুখ দিয়ে বেরোতে শোনেনি লোকটার। কেমন ঠান্ডা পাথুরে দৃষ্টি! লোকটা কি বলতে জানে না? না বলে না? দু’ একদিন পর থেকেই একটু একটু করে খাবার ঠুকরে খেয়েছে রাকা। এখন নির্বিবাদে খেয়ে নেয়, যত বিস্বাদই হোক।
এই ঘরে ঢোকানোর আগে মোবাইল থেকে সিমকার্ড ওরা খুলে নিয়েছে। যেহেতু এফ এম বাজে, তাই সে কলকাতায় আছে, এটুকু বুঝতে পারে রাকা। মাঝে মাঝে ভাইটার কথা মনে হয়, বাড়ির ব্যালকনিতে রাখা গ্ল্যাডিওলাসের সবুজ পাতাগুলোকে মনে হয়, তাসার জুলজুলে চোখ আর ঝাঁপিয়ে কোলে এসে গাল চেটে দেওয়ার কথা মনে হয়। আর কলেজ ক্যান্টিনের জানালায় দেখা আধখেঁচড়া আকাশটাকে মনে হয়। আর বিশেষ কিছু মনে হয় না।
উফ! সেই কোকিলটা আবার ডাকছে...! আচ্ছা ওরা কি বাবার কাছে টাকা চেয়েছে? না অন্য কোনো শর্ত! আচ্ছা, মা ঘুস দিয়ে কাজটা করায় নি তো? মা'কে এক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করে না রাকা। শুধু মায়ের ছেলেটাকে আজকাল কেন যেন ভাই ভেবে ফেলে রাকা। কেমন যেন করুণ চোখে তাকায়, অসহায় ভাবে কচি কচি হাতে জড়িয়ে ধরে রাকাকে। রাকা জানে, কোনোদিনই টলোমলো পায়ে হাঁটবে না মায়ের ছেলে। বাস্কেটবল নিয়ে তার সাথে লড়াইয়ে যাবে না, বইয়ের র্যাক শেয়ার করতে হবে না বড় বড় চোখের এক বছর সাতমাসের অটিস্টিক ছেলেটাকে, তাই একটু ভাই ভেবে কন্সিডার করা যেতেই পারে! আজকাল অবশ্য কলেজের পরে ওর সাথেই বেশি সময় কাটাতো রাকা। রাকার নিজের মায়ের একটা ছবি আছে মোবাইলে। পিসির এলব্যাম থেকে চুরি করে স্ক্যান করে নিয়েছিল। একটু এডিট করতেই চোখ মুখ একেবারে জলজ্যান্ত। কাল থেকে ছবিটা বারবার দেখছিল। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে রাকা, নিজেই জানে না।
নাহ, এখন দুপুর নয়, বরং রাতন। রাতের খাবারটা পড়ে আছে, কিন্তু ছুঁতে ইচ্ছে করছে না রাকার। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। মাঝখানে ওই কোকিলের একঘেয়ে ডাকটা, এত বিরক্তিকর! এবার যেন একেবারে সামনে ঠিক মাথার কাছে ডাকটা! এবার সারা ঘর জুড়ে কখনো উচ্চগ্রামে, কখনো নিম্নগতি, কখনো সুরেলা, কখনো ভা্রী, কখনো ফিসফিস। এবার কি পাগল হয়ে যাবে রাকা?
এত ভাবেও ডাকতে পারে একটা কোকিল! কোকিলটাকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারছে, এই ঘরেই আছে, তার আশেপাশেই। এক অদ্ভুত হাইড এন্ড সিক খেলা যেন চলছে তাকে ঘিরে। ওরা কি খাবারের সাথে কোনো ওষুধ মিশিয়ে দিচ্ছে? ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাওয়ার ওষুধ? না হলে রাতদুপুরে বন্ধ ঘরে কোকিলের ডাক কেন শুনবে রাকা? তবে কি আস্তে আস্তে রাকা পাগল হয়ে যাবে এই চার দেওয়ালের ভেতরেই! তারপর একদিন পাগল হয়ে এখানেই মরে পড়ে থাকবে অথবা তাকে ছেড়ে দেবে রাস্তায়! কলকাতার রাস্তায় আরেকটা পাগলী ঘুরে বেড়াবে! এবং একদিন রাস্তায় গর্ভবতী হয়ে সন্তানের জন্ম দেবে রাকা পাগলী! আর ভাবতে পারে না রাকা। মাথায় এক অসহ্য যন্ত্রণা পাক দিয়ে ওঠে। আর সাদা আলোর ঝলকানি...
এবার কোকিলটাকে দেখতে পায় রাকা। রুবীর মতো লালচোখ আর মিশকালো ডানাগুলো ছড়িয়ে বিশাল আলমারির মাথা থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। কোকিলটাকে তুলে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাকা। ওপারের দেওয়ালটায় লেগে একটা পাথরের মতো খানখান শব্দ তোলে কোকিলটা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন