শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬

শুক্লা মালাকার

মেট্রোবিভ্রাট


দুটো করে ধাপ লাফিয়ে লাফিয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠে দেখল, এখনো দুমিনিট দেরি টা ছয়ের মেট্রোটা ধরতেই হবে আজ একটা ইম্পরট্যান্ট প্রেজেন্টেশন আছে একেবারে শেষ কামরায় ওঠে শ্রেয়া নেমেই এস্কেলেটর পেয়ে যায় নির্দিষ্ট জায়গার দিকে এগোলো একটা অল্পবয়সি ছেলে ধাক্কা দিয়ে যেতে যেতে মুখ ঘুরিয়ে ‘সরি’ বলল পড়ে যেতে যেতে সামলে নিল নিজেকে এত তাড়াহুড়ো যে কিসের বোঝে না শ্রেয়া যে কোনো একটা কামরাতে উঠলেই তো হয়, পরে চেঞ্জ করে নিতে পারে। উঠতি জেনারেশনের ধৈর্য বড় কম। খালি দৌড়চ্ছে। গজগজ করতে করতে শ্রেয়ার চোখ ছেলেটিকে অনুসরণ করল এবং অভাবনীয় ভাবে শরীর বুক কাঁপিয়ে দিল। প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সিকিউরিটি কিছু বোঝার আগেই ছেলেটি লাইনে ঝাঁপ দিট্রেন তখন সবে ঢুকছে।  

মৃত্যুছোঁয়া নিয়ে সচল চাকা খানিকটা এগিয়ে অচল হলোঅদৃশ্য থেকে কেউ ‘লক’  বলে গোটা প্ল্যাটফর্ম স্টাচু করে দিয়েছে। হাড়-হিম করা নিঃশব্দ কয়েকটা মুহূর্ত।  তারপর অবধারিত ভাবে ঝড় আছড়ে পড়ল স্টেশনে। মেট্রোতে সুইসাইড পেট্রোলের দাম ওঠাপড়া করার মতো হয়ে গেছে। হামেশাই হচ্ছে। মানবদেহের স্বাদ পেতে পেতে ট্রেনের চাকাগুলোও বিরক্ত হয়ে গেছে তাই বোধহয় মাঝে মাঝেই মাঝপথে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ে।  

ট্রেন বাতিল হলে রোজকার যাত্রীদের চূড়ান্ত ভোগান্তি মৃত মানুষটির যন্ত্রণা, অসহায়তা বা তার পরিবারের ওপর নেমে আসা দুঃখ কণামাত্র ছাপ ফেলে না কারো মনে। ব্যক্তিগত অসুবিধার চাপে সব এক একটা জ্বলন্ত খনি হয়ে যায়। মুখ থেকে লাভা উগরানোর মতো শব্দ ঝরে। বহুবার এই কারণে পরিচিত-অপরিচিতদের সঙ্গে  তাল মিলিয়ে শ্রেয়াও গালাগাল করেছে। অথচ আজ এক বিজাতীয় অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরেছেকয়েক মুহূর্ত আগে যে ছেলেটি তাকে ধাক্কা দিয়ে ‘সরি’ বলেছিল, তার  যাবতীয় তাড়া ছিল শুধু মাংসপিন্ড হবে বলে! কী সেই দুঃখ, কী সেই অনুভূতি, যা তাকে মেট্রোর লাইন অবধি তাড়িয়ে নিয়ে গেল! 

থোকা থোকা হয়ে থাকা যাত্রীদের পিছন থেকে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক ভুলু! ভুলু! ডাকতে ডাকতে হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছলেন চশমা ভাঙা, উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক দেখছেন আর বলছেন, আমার ছেলেটাকে দেখেছেন? অ্যাঁ! আমার ছেলেটাকে?   দৌড়ে চলে এলো, জানেন! টিকিট কাটতে গিয়ে আমার দেরি হলো, ওর তো কার্ড। দেখেছেন?’ সেকেন্ডের নীরবতা। জনগণের চোখ আর মতামত লোকটিকে ঘিরে  ধরতেই তিনি পাথর হয়ে গেলেনঠোঁট চেপে মুখটা নামাতেই ভাঙা চশমা খুলে পড়ল। তিনিও পড়ে গেলেন।

বিক্ষিপ্ত জনতার কাছে তিনি ভাব আর ইমোশনের দৃশ্যমান প্রতীক হলেন। সবাই এসে  একবার করে তাকে দেখে যাচ্ছে। তারপর নিজেদের মতো করে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা  করতে করতে ফিরেও যাচ্ছে। সময় কম সকলের, পাশে থেকে পুত্রহারা পিতার পিঠে হাত রাখার ইচ্ছেও নেই কারো। ওর ছেলের কারণে আজ তাদের ভোগান্তি, বাসের জন্য ছুটতে হবে।   

মেট্রো কর্তৃপক্ষও দ্রুত কাজে লেগে পড়লতাদেরও সময় কম। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করতে হবে। যাদের তাড়া কম, দেরি হলেও মেট্রোতেই যাবে, আর উৎসাহী কিছু  মানুষ মৃতদেহ সরানোর প্রক্রিয়া দেখার তাগিদে রয়ে গেল। শ্রেয়াও থেকে গেছে। কী  এক ঘোর লাগা বিষাদ তার চেতনায় ঘন্টা বাজিয়ে চলেছে। অফিস, প্রেজেন্টেশন - সব হাওয়া। লোকটির চোখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। সেখানে তখন মিনতি,  আর্তি আর প্রস্থানের কান্না। শ্রেয়ার সবকটা ইন্দ্রিয় বলছে, ওখানে ওই চোখে, ছেলের জন্ম থেকে এই পর্যন্ত জীবনের স্লাইড-শো চলছে।

আচমকা তিনি উঠে ট্রেনের দিকে দৌড়ে গেলেন। ওখানে তখন রেলকর্মীদের ভিড়। ফিরে এলেন। পায়চারী করছেন। ফাঁকা মঞ্চে একাই অভিনেতা। বিড়বিড় করছেন, কেন এমন করলি বল তো! আমি তো বাবা! রেজাল্ট খারাপ হয়েছে বলে একটু বকতেও পারব না! আচ্ছা বলুন তো, বাবা তার ছেলেকে লেখাপড়া নিয়ে বলবে না!  সারাদিন মোবাইলে আঙুল চলছে। বলেছি বলে এত রাগ হলো! আচ্ছা আমি না হয়  মোবাইলটা কেড়েই নিয়েছি! দিয়েই তো দিতাম! ওটা তো তোর জন্যই কিনেছিলাম না কি! আচ্ছা আমি না হয় খুব খারাপ বাবা! তোর মা তো তোকে আগলে আগলে রাখতো! তার কথাও মনে পড়ল না!

কখনো থামছেন, কখনো হাঁটছেন, কখনো নিজেকে বকছেন, সময় ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছেলেকে পেতে চাইছেন, যেন দুঃস্বপ্নে জেগে তার ‘পিতা’ জীবনের মানে খুঁজে চলেছেনঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো তিনি ফেটে পড়লেন, কেন এলি! কেনই বা চলে গেলি! আমি কী নিয়ে বাঁচবো বলে যা! সব বুঝলি! বাবার মনটা বুঝলি না রে! এত অভিমান  তোর!

শ্রেয়ার কানে বহুক্ষণ বাজতে লাগলো সেই আর্তরব, ‘সব বুঝলি! বাবার মনটা বুঝলি না রে!’ এই ‘ওয়াই-ফাই’ জেনারেশন চূড়ান্ত অভিমানীও বটে। বুকের মধ্যে ভয়ংকর একটা মোচড়। তার মেয়ে টিয়ার মনে কোনো মেঘ জমে নেই তো? কে জানে!  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন