মুখোশ
একা আছি
অনেকদিন অন্ধকারে
আমার আগে অনেকে এসেছে এখানে
আমার পরে অনেকে এসেছে
কেউ কাউকে দেখি না
হাতড়ে হাত খুঁজি
ফাংগাস যন্ত্রণা
সমুদ্রের মতো কাঁপে।
(‘একা আছি’ / বিষ্ণু বিশ্বাস)
নির্ঘুম রাত পেরিয়ে দিনের আলো ফুটে উঠতেই অস্থিরতা কানা উপচে পড়তে থাকে। ফেনায় একেবারে ফেনায়িত। একশ পাওয়ারের বাল্বের তীব্র আলোয় চোখ কটকট করে। বাথরুমে পানির টিপটিপ শব্দ, বি বি সি থেকে ভেসে আসছে দ্যা নিউজ রেড বাই ফয়েজ আহমেদ। বোবা সকালে ফ্লোরাইড টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মেজে পোশাক পাল্টাই... দিনটার সূচনা ঘটে। কর্মব্যস্ত দিনগুলো আমার— একটার পর একটা দিন আসে, চলে যায়...
রোদকণার তেজ, রিকশার টুংটাং, ফেরিওয়ালার চিৎকার, মরচেধরা খয়েরি গেটের দু’পাশে ঘিরে থাকা চা-খোর, কলা বিক্রেতা এবং ভবঘুরে লোকদের চাহনি পেরিয়ে যেতে যেতে পুষে রাখা রাগটা বাড়তে থাকে। রিকশাস্ট্যান্ড থেকে কোনো রিকশাই নেওয়া হয় না। সরু গলির মোড় পেরোতেই স্কুলগামী ছেলে-মেয়েদের চঞ্চলতা, যুবকদের রিং করে সিগারেট খাওয়ার দৃশ্য চোখে আটকে থাকে। অফিসযাত্রী, গার্মেন্টসযাত্রী, কতজনের সাথেই চোখ চাওয়া-চাওয়ি হয়। এক যুবকের কাঁধের স্পর্শে সম্বিত ফিরে পাই। দরদাম করে চড়ে বসি একটা রিকশায়। বুকটা জ্বলতে থাকে, জলের তেষ্টা পায়, কিন্তু রিকশা আর দাঁড়িয়ে থাকে না। সাতাশ নম্বরের দীর্ঘ একহারা পথ পেরিয়ে আসাদ গেট যেতে যেতে চেহারায় ফুটে ওঠে বিরক্তির ছাপ। এমন দিনের পরিণতি সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা নেই, সম্ভবত কারোরই নেই, যদিও তারা তা মনে করে না। ভাবে দিনের শেষে সন্ধ্যা আসবে, তারপর রাত। রাতের ঘন কালো রূপ। একজন দু’জন করে গাবতলি, মিরপুরের যাত্রী চলে যায় লোকাল বাসে, কিন্তু অভীষ্ট বাসটি আসতে বহু দেরি করে ফেলে।
ভিড় ঠেলে সড়ক যানটির ভেতরে ঢুকতেই শ্রেণীবোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সকলের দিকে চেয়ে নিয়ে বিষ ঢালতে থাকি হেল্পারের উপর। ধীরে ধীরে বাস চলছে, মেয়েদের বিশেষ সিটে গা ঘেঁষে বসা সিঙ্গারের মেয়েরা খানিকটা চেপে পাশের বোরকা পরিহিতার গায়ে ঠেলে দেয় আমাকে। একসময় ভেতরের রাগটা কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়ে আসে। গাড়ির গতির সাথে মনের একটা সম্পর্ক হয়। কোনো সন্ধিও হয় হয়তো। এমনধারা বাসযাত্রা প্রতিদিন আমাকে একটা নির্দিষ্ট স্টেশনে নামিয়ে দেয় যেখানে সবুজ ঘাস এবং হলুদাভ আকাশমনি ফুলেরা প্রায়ই আমার ভূতে পাওয়া গাম্ভীর্যকে ঠাট্টা করে। মিনিটের কাঁটা ঘুরে রোদের তেজ বাড়তে থাকে, মধ্যাহ্ন সমাগত হয়, তরুণ-তরুণীর কোলাহলে মিশে যেতে থাকি। সেখান থেকে কিছুতেই নিজেকে আর আলাদা করা যায় না। দু’হাত, দু’পা আর একটা নাকওয়ালা মানুষের মতো বিদ্যাপিঠের নিয়ম মেনে চলি। দু’একজন বন্ধু উত্তাপহীনভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে চলে, যদিও সুতোর টান তারা ঠিকই টের পায়। আর সে টান ক্রমাগত তাদের কেন্দ্রমুখী করে। অভিকর্ষজ টানে তারা কেন্দ্রাভিমুখী হলে নিদারুণ কষ্টে গড়া মুখোশখানা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমি নিশ্চিত সেই মুখ কেউ কখনো দেখেনি বা কেন্দ্রের টান তখন এতই প্রবল থাকে যে সকলেই নিজ মুখোশ সযতনে বুকপকেটে নয়তো ভ্যানিটি ব্যাগের চোরাখোপে গুঁজে রাখতে ব্যস্ত থাকে। মধ্যাহ্নের আলো ফিকে হয়ে এলে আরও কিছু কোমল নয়তো গভীর দৃষ্টি বিনিময় করে ক্রমশ পূর্বদিকে সরে যেতে থাকি আর আমার মুখচ্ছবিও ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে থাকে। সূর্য যতই পশ্চিম দিকে ঢলে পড়তে শুরু করে, পূর্বের শহরটি ততই ছটফটে তরুণ-তরুণীতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। ঠোঁটকাটা মধ্যবয়সী ভদ্রমহোদয়দেরও অভাব হয় না। এইসব পথের বন্ধুরা আমাকে সম্ভাষণ জানায়।
সন্ধ্যার ম্যাজেন্টা আভা মিলিয়ে যেতেই গাঢ় কালো শহরটি হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে, কিন্তু অমোঘ নিয়তি প্রতিরাতে আমায় নির্লোভ, শূন্যকামী ব্রত গ্রহণ করতে হয়। তখন আমার চোখ দুটো জ্বলতে থাকে কয়লা পোড়া আগুনের আঁচে। শূন্যকামী আত্মার আদলে ঘুরে বেড়াই ঘরের কোণায় কোণায়, মুখ থেকে খুলে ফেলি চিত্রিত মুখোশখানা। এইসব বদল, কোনো কিছুই আমাকে স্থিরতা দেয় না, দিনের শেষে লম্বা হয়ে ঝুলে থাকি দেওয়ালে দেওয়ালে, ঘুপচির আড়ালে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন