টিপ
খবরটা শুনে দৌড়ে বার্ণ ইন্সটিউট গেছে শাবানা। ঝিলমের ওড়নায় আগুন ধরে গেছে। মুহূর্তে সে পুড়ে গেছে অনেকটা। মাত্র পরশুদিন পিকনিকে
ঝিলমের সাথেও দেখা হলো। দুনিয়ার গল্প। তিন বছরের বাবাই আর জাহিন, এই হলো ঝিলমের সংসার। হাসপাতালের ওয়ার্ডে কম বেশি সবাই যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কিন্তু এদের মধ্যে ঝিলম কোথায়?
চোখের জল মুছতে মুছতে অনেক চেনা উচ্ছ্বল ঝিলমকে মনে মনে খোঁজে শাবানা।
পিকনিকে সবার অর্ডারি শাড়ি ছিল। মেরুন কমলার জমিন আর কপার রঙ পাড়। ঝিলম সেজেছিল সামান্য। কপালে মেরুনটিপ আর কানের পাশে কাঠগোলাপ ফুল। ঝকঝকে সুন্দর স্মার্ট মেয়ে সে ফোন কম্পানিতে কাজ করে। শাবানার খুব ন্যাওটা। পিকনিকে কেন যেন ঝিলম বারবার একা হয়ে যাচ্ছিল। গানের সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। আইটেম খেলার সময় সে নেই। খাবার সময় ডেকে ডেকে হয়রান।
চোখের জল মুছতে মুছতে অনেক চেনা উচ্ছ্বল ঝিলমকে মনে মনে খোঁজে শাবানা।
পিকনিকে সবার অর্ডারি শাড়ি ছিল। মেরুন কমলার জমিন আর কপার রঙ পাড়। ঝিলম সেজেছিল সামান্য। কপালে মেরুনটিপ আর কানের পাশে কাঠগোলাপ ফুল। ঝকঝকে সুন্দর স্মার্ট মেয়ে সে ফোন কম্পানিতে কাজ করে। শাবানার খুব ন্যাওটা। পিকনিকে কেন যেন ঝিলম বারবার একা হয়ে যাচ্ছিল। গানের সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। আইটেম খেলার সময় সে নেই। খাবার সময় ডেকে ডেকে হয়রান।
‘ঝিলম কোথায় তুমি বাবা, বার বার গায়েব হয়ে যাচ্ছ!’ অন্য সবাই হাসতে থাকে। আবার পিলো পাসিংএর সময় তার মুড ফিরে এলো। সে দিব্যি সবাইকে তাক লাগিয়ে প্রথম হয়ে গেল।
ভাবতে ভাবতে চোখ জ্বলছে শাবানার। কী অসম্ভব মিষ্টি যে ঝিলমের মুখটা! পানপাতা কাট। জোড়া টানা ভ্রু। কোমর ছাপানো চুল। শুধু জীবনে একবার ভুল হতে হতে বেঁচে গেছে। জাহিন বিয়ে করবে শুনে ছোটবেলার বান্ধবীর আত্মীয় ঝিলমকে সেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। আজ এত বছর পর ওয়ার্ডে শোওয়া ঝিলমের বেডের দিকে যেতে পা আর সরে না শাবানার। সে কীভাবে এই আলোময় মুখের বদলে দগদগে বসে যাওয়া আগুনের বীভৎস তান্ডব দেখবে?
ঝিলম চা বানাচ্ছে দৌড়ে দৌড়ে, কারণ ছায়ানটের শিল্পীদের সরাসরি গান হচ্ছে বটমূল থেকে। শাকিলভাই গাঢ় গলায় ‘মেঘবিহীন খর বৈশাখে’ গাইছেন। এর মধ্যে জাহিন চা চাইছে। ঝিলম গান মিস হয়ে যাচ্ছে, তাই চুলায় পানি বসিয়েই দৌড়ে ঘরে এসেছে। খানিক শুনে, পানি ফুটে গেছে দৌড়ে চায়ের পাতা পানিতে ফেলে, আবার টিভির সামনে হাজির। মা হয়েছে, তবু চঞ্চলতা যায়নি ঝিলমের। ছেলের সাথে পাল্লা দিয়ে চলে তার দুষ্টুমি।
‘শাবানাপা, আমার মুখের কী অবস্থা, তাই না?’ চমকে গেল শাবানা।
ঝিলম তার হাতটা ধরে কাতর গলায় কথা বলার চেষ্টা করে। অবাক কান্ড! মুখটা তার কীভাবে যেন অক্ষত থেকে গেছে!
‘অল্পের জন্য বেঁচে গেছ তুমি। শরীরে সামান্য পুড়েছে, ঠিক হয়ে যাবে সোনা। একটু ধৈর্য ধরো’।
চোখ ফেটে জল আসে শাবানার। কীভাবে সে যে এসব কথা বলছে, সে নিজেও জানে না। কীভাবে সহ্য করবে সে ব্যথা! সারা গায়ে প্রোটিন দেওয়া হয়েছে। ৭০% বার্ণ, তবু বুকে সাহস আছে ঝিলমের।
‘শাবানাপা, তোমাকে একটা কথা...’
‘বেশি কথা বলে না এখন, ডাক্তারসাহেব বকা দেবেন। এখন চুপ করে থাকো ঝিলু। দেখ অফিসের সবাই দেখতে এসেছে তোমাকে। দেখ সেদিন পিকনিকে যারা ছিলেন সবাই এসেছে রে পাগলী! সবাই কত ভালোবাসেন তোমাকে’।
ভাবতে ভাবতে চোখ জ্বলছে শাবানার। কী অসম্ভব মিষ্টি যে ঝিলমের মুখটা! পানপাতা কাট। জোড়া টানা ভ্রু। কোমর ছাপানো চুল। শুধু জীবনে একবার ভুল হতে হতে বেঁচে গেছে। জাহিন বিয়ে করবে শুনে ছোটবেলার বান্ধবীর আত্মীয় ঝিলমকে সেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। আজ এত বছর পর ওয়ার্ডে শোওয়া ঝিলমের বেডের দিকে যেতে পা আর সরে না শাবানার। সে কীভাবে এই আলোময় মুখের বদলে দগদগে বসে যাওয়া আগুনের বীভৎস তান্ডব দেখবে?
ঝিলম চা বানাচ্ছে দৌড়ে দৌড়ে, কারণ ছায়ানটের শিল্পীদের সরাসরি গান হচ্ছে বটমূল থেকে। শাকিলভাই গাঢ় গলায় ‘মেঘবিহীন খর বৈশাখে’ গাইছেন। এর মধ্যে জাহিন চা চাইছে। ঝিলম গান মিস হয়ে যাচ্ছে, তাই চুলায় পানি বসিয়েই দৌড়ে ঘরে এসেছে। খানিক শুনে, পানি ফুটে গেছে দৌড়ে চায়ের পাতা পানিতে ফেলে, আবার টিভির সামনে হাজির। মা হয়েছে, তবু চঞ্চলতা যায়নি ঝিলমের। ছেলের সাথে পাল্লা দিয়ে চলে তার দুষ্টুমি।
‘শাবানাপা, আমার মুখের কী অবস্থা, তাই না?’ চমকে গেল শাবানা।
ঝিলম তার হাতটা ধরে কাতর গলায় কথা বলার চেষ্টা করে। অবাক কান্ড! মুখটা তার কীভাবে যেন অক্ষত থেকে গেছে!
‘অল্পের জন্য বেঁচে গেছ তুমি। শরীরে সামান্য পুড়েছে, ঠিক হয়ে যাবে সোনা। একটু ধৈর্য ধরো’।
চোখ ফেটে জল আসে শাবানার। কীভাবে সে যে এসব কথা বলছে, সে নিজেও জানে না। কীভাবে সহ্য করবে সে ব্যথা! সারা গায়ে প্রোটিন দেওয়া হয়েছে। ৭০% বার্ণ, তবু বুকে সাহস আছে ঝিলমের।
‘শাবানাপা, তোমাকে একটা কথা...’
‘বেশি কথা বলে না এখন, ডাক্তারসাহেব বকা দেবেন। এখন চুপ করে থাকো ঝিলু। দেখ অফিসের সবাই দেখতে এসেছে তোমাকে। দেখ সেদিন পিকনিকে যারা ছিলেন সবাই এসেছে রে পাগলী! সবাই কত ভালোবাসেন তোমাকে’।
ঝিলমের
মুখটা ফুলে চোখ ঢেকে গেছে। তবু সে চোখ খুলে চেনা সবাইকে দেখতে চাইছে।
ঝিলম চা বানিয়ে চুলা থেকে হাড়ি নামিয়ে পাশেই ট্রেতে সাজাচ্ছে আর গুন গুন গান চলছে। স্টেজে শিশুরা গাইছে...
‘এমন মানব জনম আর কি হবে / মন যা কর ত্বরায় করো এই ভবে’। আহা! মন যা চায় তাই কি করা যায় সব সময়!
পিরিচে ভালো বেকারির বিস্কিট নিল জাহিনের জন্য। ভোরে উঠে দুজনেই গান শোনা শুধু করেছে। আজ নাস্তা কখন হবে কে জানে!
ঘরের মধ্যে গানের আওয়াজে উঠে গেছে বাবাইও। সেও তো স্কুলে গান শিখেছে মিউজিক টিচারের কাছে। সে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে শুয়ে সবাইকে দেখছে। আজ বাবা মা খুব খুশী।
‘জোনাকী কি সুখে ঐ ডানা দুটি মেলেছোও ও ও’ মাথা নেড়ে নেড়ে অনুষ্ঠানের বাচ্চাদের সাথে সেও গাইছে।
হাসপাতালে যন্ত্রণার শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। যেন কিছুক্ষণের জন্য হলেও মানুষ বাইরের সব কিছু ভুলে যায়। চারদিকের আর্তনাদে নিজেদের ঠুনকো কষ্ট বড় আলগা লাগে।
‘আমার বাবাই... আমার ছেলে... ও কি কিছু বুঝেছে আপা? আর পারছি না’।
ধীরে ধীরে নেতিয়ে যাচ্ছে ঝিলমের কণ্ঠ।
‘বাবাই কিচ্ছু জানবে না। ক’দিন পর সে তার ভালো হয়ে যাওয়া মা’কে বাসায় পাবে। আর কাঁদে না ঝিলম!’
ডাক্তার তেমন আশা দিচ্ছেন না কেন জানি না। শাবানা উঠে শিবলির কাছে দাঁড়ালো। শিবলী তার স্বামী। চোখাচোখি হলো। শিবলি চোখ নামিয়ে কথা বলছে। অর্গানগুলো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কিডনি, লিভার – একযোগে কাজ বন্ধ করে দিচ্ছে।
‘আর শুনতে চাই না’। শিবলির পাশ থেকে ছিটকে সরে এলো রুমের বাইরে। ঝর ঝর করে কাঁদতে লাগল। কান্নার দমকে তার শরীর কাঁপছে।
সিল্কের ওড়নায় কখন আগুন ধরেছে, টের পায়নি ঝিলম। সে চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ঘরের দিকেই আসছিল। টের পাবার সঙ্গে সঙ্গে ওড়না টান দিতে গিয়ে দেখে, ওড়না গলায় কীভাবে পেচিঁয়ে গেছে। জাহিনের নাম ধরে চিৎকার করতে করতে ছাদের দকে ছুটতে থাকে সে। বাতাসে আগুন উপচে উঠে জড়িয়ে ধরে ঝিলমকে।
ঝিলম চা বানিয়ে চুলা থেকে হাড়ি নামিয়ে পাশেই ট্রেতে সাজাচ্ছে আর গুন গুন গান চলছে। স্টেজে শিশুরা গাইছে...
‘এমন মানব জনম আর কি হবে / মন যা কর ত্বরায় করো এই ভবে’। আহা! মন যা চায় তাই কি করা যায় সব সময়!
পিরিচে ভালো বেকারির বিস্কিট নিল জাহিনের জন্য। ভোরে উঠে দুজনেই গান শোনা শুধু করেছে। আজ নাস্তা কখন হবে কে জানে!
ঘরের মধ্যে গানের আওয়াজে উঠে গেছে বাবাইও। সেও তো স্কুলে গান শিখেছে মিউজিক টিচারের কাছে। সে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে শুয়ে সবাইকে দেখছে। আজ বাবা মা খুব খুশী।
‘জোনাকী কি সুখে ঐ ডানা দুটি মেলেছোও ও ও’ মাথা নেড়ে নেড়ে অনুষ্ঠানের বাচ্চাদের সাথে সেও গাইছে।
হাসপাতালে যন্ত্রণার শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। যেন কিছুক্ষণের জন্য হলেও মানুষ বাইরের সব কিছু ভুলে যায়। চারদিকের আর্তনাদে নিজেদের ঠুনকো কষ্ট বড় আলগা লাগে।
‘আমার বাবাই... আমার ছেলে... ও কি কিছু বুঝেছে আপা? আর পারছি না’।
ধীরে ধীরে নেতিয়ে যাচ্ছে ঝিলমের কণ্ঠ।
‘বাবাই কিচ্ছু জানবে না। ক’দিন পর সে তার ভালো হয়ে যাওয়া মা’কে বাসায় পাবে। আর কাঁদে না ঝিলম!’
ডাক্তার তেমন আশা দিচ্ছেন না কেন জানি না। শাবানা উঠে শিবলির কাছে দাঁড়ালো। শিবলী তার স্বামী। চোখাচোখি হলো। শিবলি চোখ নামিয়ে কথা বলছে। অর্গানগুলো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কিডনি, লিভার – একযোগে কাজ বন্ধ করে দিচ্ছে।
‘আর শুনতে চাই না’। শিবলির পাশ থেকে ছিটকে সরে এলো রুমের বাইরে। ঝর ঝর করে কাঁদতে লাগল। কান্নার দমকে তার শরীর কাঁপছে।
সিল্কের ওড়নায় কখন আগুন ধরেছে, টের পায়নি ঝিলম। সে চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ঘরের দিকেই আসছিল। টের পাবার সঙ্গে সঙ্গে ওড়না টান দিতে গিয়ে দেখে, ওড়না গলায় কীভাবে পেচিঁয়ে গেছে। জাহিনের নাম ধরে চিৎকার করতে করতে ছাদের দকে ছুটতে থাকে সে। বাতাসে আগুন উপচে উঠে জড়িয়ে ধরে ঝিলমকে।
জাহিন
ছেলে নিয়ে ছাদে ঘুরছে। বাবাই কুমকুম মানে কবুতর দেখবে। তাদের ছাদে সাদা সুন্দরী কবুতর আছে চারজোড়া। তাদের আছে গালভরা নাম। সব ঝিলমের বন্ধুবান্ধব।
ছায়ানটের গান বটমূলের প্রাঙ্গণ থেকে ঝিলমদের বাড়ির কোণায় কোণায় সুর ছড়িয়ে পড়েছে। ‘আমি যখন ছিলেম অন্ধ’ – কে গাইছেন? চিরকালের সুকন্ঠী ঝিলম বেসুরা চিৎকার দিতে দিতে অন্ধের মতোই ছাদের দিকে আসছে। জাহিন খুবই অবাক হয়ে দেখল, ছাদে ঢোকার মুখেই ঝিলম দাঁড়িয়ে আছে, দু’পাশ দিয়ে দাউ দাউ আগুন। জাহিন যেন কিছুই বুঝতে পারছে না! ঝিলমের কপালে মেরুন টিপ কোত্থেকে এলো? সকালে তো ছিল না! এক সেকেন্ড সময় নিলো সে বুঝতে। ছাদে মেলা চাদর লেপ কম্বল যা ছিল, সবশুদ্ধ এনে জড়িয়ে ধরলো ঝিলমকে। থরথর করে কাঁপছে জাহিন। কী হয়েছে, জিজ্ঞেস করার বোধ নেই এখন।
ঝিলম কাতরাচ্ছে, সে বলছে, ‘পুড়ে যাচ্ছি, পুড়ে যাচ্ছি গো! আমার ছেলে যেন না দেখে...’ ভয়াবহ চিৎকারে অন্যান্য ফ্ল্যাটের সবাই বের হয়ে এসেছে। দ্রুত ঝিলমকে বার্ণ ইউনিটে নিতে হবে। ছাদে বাবাই এখনো খেলছে। প্রতিবেশী কে যেন দৌড়ে গেল ছেলেকে ধরতে।
মিলাদে আসা সব অতিথি ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছেন। শাবানার স্বামী শিবলি সবাইকে বিদায় দিচ্ছেন, তদারকি করছেন। বাবাইকে কোলে নিয়ে শাবানা চুপ বসে আছে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ঝিলম চলে গেল। সময় দিল না বেশি। যাবার আগে সে বারবার কী যেন বলতে চাইছিল। শাবানার আর শোনা হলো না। বাচ্চাদের মতো ঝিলম যেন হাততালি দিচ্ছে। বলছে, বেশ হয়েছে শাবানাপা, তোমাকে বলতে চাইলাম, তুমি কিছুতেই শুনলে না তো। যাও আর বলব না।
জাহিনের সাথে বিয়ের আগে সাগরের সাথে এনগেজমেন্ট ঠিক হয়েছিল ঝিলমের। সাগর ছায়ানটের শিল্পী। খুব জনপ্রিয়। ঝিলমের মনে মনে ভালো লাগতো তাকে।
তো সেদিন রাত বাড়ছে, বারোটার কাঁটা গড়িয়ে যাচ্ছে। ছেলেপক্ষের আত্মীয় সবাই প্রচন্ড উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে, কিন্তু সাগর আর সে রাতে আংটি পরাতে আসেনি। ফোনে জানিয়েছে। বাবা মায়ের অনুরোধে এখানে মত দিয়েছিল। তার অন্য কোথাও এফেয়ার আছে। দূর থেকে আসা সাগরের সমস্ত আত্মীয়স্বজন খেয়েদেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে চলে গেল। যার যার আংটি তার তার কাছেই রইলো। আংটি আর বদলানো হলো না।
পিকনিকে হঠাৎ অন্য পার্টির লোকজনের মাঝে সাগরকে দেখে
শাবানাও চমকে গেছে। সারাটা দিন ঝিলম অন্যমনস্ক ছিল। সাগর তার ধামাচাপা
স্মৃতি সেদিন নতুন করে উস্কে গেছে। নইলে সে তো
এত বেখেয়াল না! এতখানি আগুন তার
শরীরে ধরে গেল আর সে কিছুই টেরই পেলো না!
ছায়ানটের গান বটমূলের প্রাঙ্গণ থেকে ঝিলমদের বাড়ির কোণায় কোণায় সুর ছড়িয়ে পড়েছে। ‘আমি যখন ছিলেম অন্ধ’ – কে গাইছেন? চিরকালের সুকন্ঠী ঝিলম বেসুরা চিৎকার দিতে দিতে অন্ধের মতোই ছাদের দিকে আসছে। জাহিন খুবই অবাক হয়ে দেখল, ছাদে ঢোকার মুখেই ঝিলম দাঁড়িয়ে আছে, দু’পাশ দিয়ে দাউ দাউ আগুন। জাহিন যেন কিছুই বুঝতে পারছে না! ঝিলমের কপালে মেরুন টিপ কোত্থেকে এলো? সকালে তো ছিল না! এক সেকেন্ড সময় নিলো সে বুঝতে। ছাদে মেলা চাদর লেপ কম্বল যা ছিল, সবশুদ্ধ এনে জড়িয়ে ধরলো ঝিলমকে। থরথর করে কাঁপছে জাহিন। কী হয়েছে, জিজ্ঞেস করার বোধ নেই এখন।
ঝিলম কাতরাচ্ছে, সে বলছে, ‘পুড়ে যাচ্ছি, পুড়ে যাচ্ছি গো! আমার ছেলে যেন না দেখে...’ ভয়াবহ চিৎকারে অন্যান্য ফ্ল্যাটের সবাই বের হয়ে এসেছে। দ্রুত ঝিলমকে বার্ণ ইউনিটে নিতে হবে। ছাদে বাবাই এখনো খেলছে। প্রতিবেশী কে যেন দৌড়ে গেল ছেলেকে ধরতে।
মিলাদে আসা সব অতিথি ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছেন। শাবানার স্বামী শিবলি সবাইকে বিদায় দিচ্ছেন, তদারকি করছেন। বাবাইকে কোলে নিয়ে শাবানা চুপ বসে আছে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ঝিলম চলে গেল। সময় দিল না বেশি। যাবার আগে সে বারবার কী যেন বলতে চাইছিল। শাবানার আর শোনা হলো না। বাচ্চাদের মতো ঝিলম যেন হাততালি দিচ্ছে। বলছে, বেশ হয়েছে শাবানাপা, তোমাকে বলতে চাইলাম, তুমি কিছুতেই শুনলে না তো। যাও আর বলব না।
জাহিনের সাথে বিয়ের আগে সাগরের সাথে এনগেজমেন্ট ঠিক হয়েছিল ঝিলমের। সাগর ছায়ানটের শিল্পী। খুব জনপ্রিয়। ঝিলমের মনে মনে ভালো লাগতো তাকে।
তো সেদিন রাত বাড়ছে, বারোটার কাঁটা গড়িয়ে যাচ্ছে। ছেলেপক্ষের আত্মীয় সবাই প্রচন্ড উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে, কিন্তু সাগর আর সে রাতে আংটি পরাতে আসেনি। ফোনে জানিয়েছে। বাবা মায়ের অনুরোধে এখানে মত দিয়েছিল। তার অন্য কোথাও এফেয়ার আছে। দূর থেকে আসা সাগরের সমস্ত আত্মীয়স্বজন খেয়েদেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে চলে গেল। যার যার আংটি তার তার কাছেই রইলো। আংটি আর বদলানো হলো না।
‘শাবানা আপা শোনো’ - উধাও ঝিলম যেন
ডাকে তাকে! ঝিলমের মুখটা
দেখতে গিয়ে সে সেদিনের পিকনিকের উচ্ছল মুখটা দেখতে পায়। যেন তার কপাল
জোড়া মেরুণ টিপ, কানে গোঁজা কাঠগোলাপ আর পেটভর্তি গল্প। প্রাণভরে গল্প করার জন্য
শাড়ির কুঁচি ধরে ছুটতে ছুটতে আসছে ঝিলম। এক জীবনের সমস্ত কথা সে আজ শাবানাপাকে
বলবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন