সিঁড়ি
চওড়া একটা সিঁড়ি বেয়ে তরতর
করে উঠে যাচ্ছি। সমিত ডাকছে। পাত্তা দিই নি। ওর জন্য অপেক্ষা করলে এ জন্মে সিঁড়ি
ভাঙা শেষ হবে না। কয়েকটা সিঁড়ি আগে কাবেরীকে দেখেছি। বরের হাত ধরে বৃষ্টি
মাখামাখি, আদিখ্যেতা! থাক ও শ্রাবণের নববধূটি হয়ে।
আরো অনেকটা উঠে এসেছি। আরে!
নীলা না! ও একটা ক্লাউন! আজীবন হেসে গড়াচ্ছে। এত আত্মতৃপ্তি কোথায় পায়? শুনেছি
ডাইভোর্স হয়ে গেছে। মেয়ে নিয়ে মায়ের কাছে থাকে। দাদাদের ইমোশনাল অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে শপিং মলে কাজ করছে। এত কিছুর পরেও এত হাসে কী করে? চড়া মেক-আপ, না নেশাগ্রস্থ হয়ে থাকে সব
সময়!
ওই আর একজন! আলোক দাস। ওর
জীবন জুড়ে শুধুই নিম্নচাপ। রাজনীতি ওকে কিছুই দেয় নি। উঠতে উঠতে তাই দাঁড়িয়ে
পড়েছে। পায়ের নিচে শেকড় ছড়াচ্ছে, স্মৃতির শেকড়। শুনেছি কবিতা
লিখে লিখে ধরে রাখে বঞ্চনার ইতিহাস।
আমি পৌঁছে গেছি প্রায় মাঝামাঝি।
পিছন থেকে কে ডাকে? ও হো! এ তো গদাই, মানে অরিত্র। নামের বাহার কাজের নয়।
ছেলেবেলায় গুলি, ডাংগুলি, ক্রিকেট ব্যাডমিন্টন খেলেছি। ও ডাকে কেন? ও তো বি-কম ফেল
মৎস্যজীবী, মানে মাছের আড়তদার। ছেলেবেলার খেলার সঙ্গে জীবনকে গুলিয়ে দিলে চলবে না। আমার পায়ে চাকা নেই, পিঠে নেই ডানা। নিজের পায়েই উঠতে হবে সবকটা
সিঁড়ি।
ঝটপট উঠছি, সময় কমে আসছে।
মধুরিমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওকে দেখে নিজেকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হলো। কষায় উঠে এলো বিষ। এতটা সিঁড়ি উঠে এসেছি অক্লান্ত। লাবণ্য
ঝরিয়ে আকন্ঠ পান করেছি স্বেদ। মধু দিব্যি নিজস্ব পুরুষের ছায়া মেখে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে রামধনু। ওর মায়াবী হরিণ চোখ এখনো
অধীর, অস্থির।
বিচলিত হলে চলবে না। দূরে
কুয়াশার ওপারে আমার শেষ সোপান। ভাসা ভাসা ভাটিয়ালী সুর উজ্জীবিত করে আমার
আত্মবিলাস। দু’পা উঠে আমি শেষ ধাপে। স্বর্ণ বৃষ্টির মধ্যে এসে দাঁড়াই। সোনালী আলোয় সাফল্য ঝকঝক করে। আমি বালিকার মতো হাত বোলাই।
যারা পিছনে পড়ে আছে তাদের দিকে হাত তুলে চিৎকার করি- আমি পেরেছি, আমি পেয়েছি
সোনালি পৃথিবীর ঘ্রাণ।
আমার চিৎকার গোঙানির মতো
ফিরে এলো। চারপাশে থইথই শূন্যতা। অনেক নিচে যেখানে সিঁড়ি নেমে গেছে সাদা কুয়াশার ভিড়ে, সেখান থেকে উঠে আসছে
অদ্ভুত মিশ্রিত কলরব। তার বিন্দু
বিসর্গও বুঝে উঠতে পারছি না। সাফল্যের চূড়ান্ত কম্পন গ্রাস করেছে ভাসমান নৌকো,
বিলুপ্ত পিয়ানো, আউশ ক্ষেতের আলপথ, পেয়ারা বাগান, বৃষ্টি ভেজা গোধূলি, মরুঝড়, বকুল
গাছ, ভালোবাসার রোশনাই।
সোপান চূড়ায় আমার মৃতদেহ
ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে গান-মাটি-কৃষ্ণচূড়া স্বপ্ন, মেঘাছন্ন চুল, বিষণ্ন চুমু আর অসমাপ্ত কামনা জড়ানো দুটি চোখ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন