দ্বিধা
সূর্যটা মধ্যগগনে। রাজপথে মধ্য দুপুরের
ব্যস্ততা। টুং টাং, প্যাঁ প্যাঁ, হৈ চৈ হুল্লোড়। ট্রাক-বাস
রিক্সা-মানুষ, বাজার ফেরতে, হাসপাতালগামী। শহরটা সবসময়
এমন ব্যস্ত, দম ফেলার ফুরসত নেই। জীবনের এই
ব্যস্ততা দৌড়ানো কীসের
তাড়ায়, কে জানে! যেন পুরো শহরটার
কোনো নিকটাত্মীয় হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়, দ্রুত না
পৌঁছালে শেষ দেখা হবে না। রাজপথ
থেকে একটু ভিতরে গলির
রাস্তায় মাথার উপর দাঁড় কাকগুলো উড়ে যায়, কা- কা। পাখার ঝাপটানিতে কিছুটা কাঁপে স্থির সূর্যের
তাপ... কিন্তু
নড়ে না। ভাদ্রের তালপাকা রোদ। রাজপথের
মতো ব্যস্ত নয় এ গলিপথ,
ইতঃস্তত দু’একজন পথচারি, নেহাৎ দায়ে না
পড়ে নির্জন গলিপথ মাড়ায় না কেউ। এরই মাঝে
গায়ের উপর হুমড়ি খায় কেউ।
- গায়ের উপর পরেন ক্যান? রাস্তা দেখে হাঁটতে পারেন না?
- দেখেন না গাড়ি রাস্তায়!
- গাড়ি তো পাঁচ হাত দূরে!
- কোথায় পাঁচ হাত দূরে...
তর্কাতর্কি যখন সপ্তমে, তখন চারপাশে জনতার ভিড়
ক্রমে ক্রমে বাড়ছে। একজন
দুজন করে জমতে জমতে বেশ একটা বৃত্ত তৈরি হচ্ছে। জমিদারের
নাট্যমন্ডপের মতো, মাঝখানে
রঙ্গমঞ্চ আর চারপাশে বিনোদন পিপাসু দর্শক শ্রোতা। উৎসুক
জনতা দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। দেখতে
বেশ লাগছে।
- এজন্য আপনি আমার গায়ের উপর পরবেন?
-
আমি দেখিনি।
-
দেখিনি মানে? চোখ
নেই?
- বললাম না,
দেখিনি!
প্রত্যাশিত প্রতিবাদ তবু কারো কাছ থেকেই আসে না। আসবে
কিনা তাও নিশ্চিত নয়। কারো অবয়বে সেরকম কিছু পরিলক্ষিত হয় না। এ মুহূর্তে কাংক্ষিত সমর্থনটুকু খুব দরকার। মানুষের
মূল্যবোধ পাল্টে গেছে। দৃষ্টিভঙ্গিও। অন্যায়ের
প্রতিবাদে কিংবা অবলা নারীর পক্ষ ধরে কথা বলা বোকামি, গাধামির
সামিল।
- আবার ধমক
দিয়ে কথা বলেন?
- ধমক দেব না? বলছি দেখিনি!
- দেখিনি, দেখিনি মানে! দিন দুপুরে রাস্তার উপর
মেয়েমানুষ দেখেন না আপনি?
বেয়াদব, ছোটলোক!
- গালি দিচ্ছেন কেন?
- গালি দেব না?
কথা কাটাকাটি চরমে। কেউ কাউকে
সামান্য ছাড় দিতে রাজি নয়। ভিড় ঠেলে সামনে আসে উজান। নন্দিতার
আপাদ-মস্তক সুসজ্জিত আধুনিক সাজপোশাকে। আকর্ষণীয়
দেহবল্লরী। মূলত এজন্যই জমেছিল রঙ্গমঞ্চটা। নন্দিতা
খুব ভালো গান গায়, ওর
গলায় ফোক গানের মন পাগল করা সুর, এই তথ্যটি উপস্থিত জনতার মাঝে কেবল উজানই জানে।
- এ্যাই কী হয়েছে?
অনেকদিন রজনীগন্ধা নিয়ে সে দাঁড়িয়ে থেকেছে রাস্তায় মোড়ে, শহরের ক্রেজ
গায়িকা নন্দিতা সেনকে দেবে বলে। প্রত্যাখ্যান করেনি নন্দিতা সেন। মুচকি
হেসে গ্রহণ করেছে। যেন এই সুকন্ঠীর জন্য এ আর এমন কী? দলীয় প্রভাবশালী পরিচয় থাকলেও সে পরিচয়
নন্দিতার সামনে দেখানোটা যে ঠিক হবে না, তা উপলব্ধি করার মতো বুদ্ধি কাজ
করে। তাই অপেক্ষা... বোধহয় শেষ হলো আজ সেই অপেক্ষার পালা!
- এ্যাই কথা কস না কেন? কী হয়েছে?
নন্দিতা নির্বাক। রাগে থরথর
কাঁপুনিতে নাক
ফুলে ফুলে উঠে।
রাগের তীব্রতায় তৈরি হয় বাকরুদ্ধতা। মেয়েদের
গায়ে ধাক্কা খাওয়াটা এদের অভ্যাস, গাড়িটা তো অজুহাত
মাত্র! মেয়েরা
হরহামেশা বিকৃতির শিকার হয়, কিন্তু কেউ কোনোদিন
রুখে দাঁড়াতে পারে?
শুধু বিকৃত লোকটির নয়, সমবেত
পথচারিদেরও ধারণার অতীত তা,
অথচ যাবতীয় ধারণাগুলো মিথ্যে হয়ে যায় নন্দিতার আচরণে। লোকটির
দ্বিতীয় ধারণাটাও মিথ্যে হয়ে গেল যখন লোকলজ্জা, লোক-জানাজানি, লোকের ঠাট্টা-তামাশা তোয়াক্কা না করে নন্দিতা
অগ্রাহ্য করল চোখ রাঙানিও। চুপসে না গিয়ে তর্কাতর্কিটা
চালিয়েই যেতে থাকল গোঁয়ারের মতো, আর
উজান পেয়ে গেল পৌরুষ প্রকাশের মোক্ষম সুযোগ, অনেক অপেক্ষার পর।
- দেখেন না, রাস্তার ট্রাকটা দাঁড়িয়ে আছে, আমি পাশ কাটাতে
গিয়ে ওনার গায়ে একটু লেগেছে কি না লেগেছে!
উজানের রূঢ় নিষ্ঠুরতায় পরবর্তীতে প্রতিক্রিয়া অনুমান করে
করুণা অথবা সমর্থন প্রত্যাশায় নিতন্ত ভদ্র বিনয়ী গলায় কাঁচুমাচু
মুখ মুখ লোকটির। লোকটি জানে না যে, সে অন্যায় করেছে। যদি
ন্যায়ও করত সে, তবুও
সামান্য করুণা মিলত না আজ উজানের কাছ থেকে। কেননা
এই সুযোগ এসেছে অনেকদিন অপেক্ষার পরে।
উজান অসহিষ্ণু আক্রমণে
ঝাঁপিয়ে পড়ে।
- কি? লেগেছে কি না লেগেছে? দিন দুপুরে রাস্তার উপর মেয়েমানুষ, চোখে দেখস না? শালা আবার
সাফাই গাইতাছস?
তারপর বিচারের ভার নিজের হাতে তুলে
নিয়ে নন্দিতাকে বলে,
-
আপনি চলে যান!
পুরো ভিড়টা এবার
হুমড়ি খেয়ে পড়ে লোকটার গায়ে। রিক্সায় চাপতে
চাপতে নন্দিতার
কানে আসে লোকটির আর্তচিৎকার। ঘুরে
নন্দিতা দেখে, এলোপাথাড়ি চড় থাপ্পড় ঘুষিতে বিপর্যস্ত লোকটি লুটিয়ে
পড়ছে মাটিতে।
উজান উন্মাদ ভক্ত তার। নববর্ষ, ঈদ, ভ্যালেন্টাইন
ডে-তে নিয়ম করে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার মোড়ে। শহরের
মঞ্চ যখন কাঁপে তার সুকন্ঠী সুরে, সামনের
সারির চেয়ার দখল করে বসে থাকে মুগ্ধ শ্রোতা উজান। এ
দৃশ্য বহুদিনের। এই
প্রতিক্রিয়া তো কাম্যই তার কাছে! আর্তচিৎকার
তীব্র হচ্ছে ট্রেনের
হুইসেলের মতো, কিন্তু তার ভেতরটা
এমন মোচড় দিচ্ছে কেন? খুব কি মার খাচ্ছে লোকটা? এত শাস্তি কি
পাওনা তার? রাস্তাঘাটে এর চেয়ে কত জঘন্য অভিজ্ঞতা হয় মেয়েদের! আহত
রক্তাক্ত হচ্ছে লোকটা। মেরেই ফেলবে নাকি? পত্রিকার হেডলাইন হবে
‘গণপিটুটিতে নারী নির্যাতনকারী নিহত’? লোকটাকে কি তার
বাঁচানো উচিত? এই করুণাটুকু
কি তার জাগা উচিত? রিক্সাটা কি
থামাবে নন্দিতা?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন