গত সপ্তায়ও ওর কাছে শুক্রবারের মানে ছিল অন্যরকম। শুক্রবারে
রিন্টু সহজে বিছানা ছাড়ে না, কিন্তু ওর তো সেই
উপায় নেই! অন্য দিনগুলোতে
শাশুড়িমাকে সুবোধ বালিকার মতো ওঁর যাবতীয় সারগর্ভ
আলোচনা গিলতে হয়। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ধীরে সুস্থে তিনি সকালের খবরের কাগজের ভাঁজ
খোলেন। শিরোনামে চোখ বোলাতে বোলাতেই শুরু করেন, ‘বুঝলে রেবা, এই সরকার টিকবে বলে মনে হয় না!’ কেন টিকবে না জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই, এমনকী রেবা মানে শ্বাশুড়িমা’ও প্রশ্ন তোলেন না।
সবাই জানে জিজ্ঞেস না করলেও তিনি তাঁর স্বারগর্ভ বিশ্লেষণ শোনাবেন। কিন্তু কীসের
প্রেক্ষিতে এই আলোচনা তার সূত্রনির্দেশ আলোচনার শাখাপ্রশাখার ভেতরেই বিলীন হয়ে
যাবে। রিন্টু আর ও একসময় ‘আসি বাবা’ বলে সটকে পড়বে, কিন্তু বেচারী শাশুড়িমা আরও ঘন্টাখানেক এই ঘোড়েল কথার চক্করে থাকবেন। এটা এ বাড়ির
নৈমিত্তিক ঘটনা। শুক্রবারটাতেই ও আটকে যেত এই ‘মাইনকা চিপায়’। সারা
সপ্তাহ্’র কথার ঝাঁপি খুলে বসতেন তিনি। প্রায় দু’ঘন্টা ওকে দেশ বিদেশের হালচাল
বোঝাতেন। শাশুড়িমা ‘দেখি রান্নার কী ব্যবস্থা হলো বলে ঠোঁটে টেপা হাসি
নিয়ে আলগোছে সরে যেতেন।
বিয়ের পর প্রথম ক’দিন নানাবিধ আচারের ঠেলায় ভালো করে ঠাহর করে নি ও। দশ রাত্রির নায়রের পরেই ওর চোখে ক্রমশ ধরা পড়ে এই ব্যাপারটা। মানুষ এত
বকতে পারে! ‘উনি তো ব্যাংকার ছিলেন, এত বকলে হিসেব
গুবলেট হয়ে যেত না?’ একদিন আলটপকা বলে ফেলেছিল রাতে। রিন্টু ঠান্ডা চোখে দেখেছিল ওকে। ও
তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে নিয়েছিল। তবে শাশুড়িমা বলেছিলেন রিটায়ারমেন্টের
পরেই পেপারের খুঁটিনাটি নিয়ে এই অবিরাম বকে যাওয়ার শুরু।
আজ দু’দিন হয়ে গেল। শাশুড়িমা একটু পর পরই আনমনে বারান্দায় যাচ্ছেন। ওর
নিজেরও কেবলই মনে হচ্ছে এখুনি ডাকবেন, ‘রেবা চশমাটা দিয়ে যাও তো!’ এখনও ইজি চেয়ারটার চ্যাপ্টা হাতলের ওপর ওঁর তালপাতার পাখা, বারান্দায় ছোট
জল চৌকিটার ওপর সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘লোটা কম্বল’এর পাতা মুড়ে উপুড় করা। পাশেই গ্লাসের
বাসি জলে রাতের পোকারা মরে ভাসছে। গ্যাসের ওষুধের
রাঙতাটা অসাড় মেঝেতে হাওয়ায় ঘষ্টাচ্ছে। কেউ কিচ্ছু সরায় নি।
ভ্যান গাড়ির সব্জিওয়ালা পলিথিনে ভরা আমড়া দিয়ে গেল কিছুক্ষণ আগে। আর
তারপরেই ওর পৃথিবী দুলে উঠল। তিন মাসের পোয়াতি ও।
পাঁচ বছর ধরে এ ডাক্তার সে ডাক্তার, মাজার মাদুলি করার পরে অবশেষে ও মা হতে চলেছে। আমড়া ওয়ালা পিরিচে চা ঢেলে আওয়াজ
তুলে চুমুক দিতে দিতে শোনাচ্ছিল শেষ ক’ মুহূর্তের বিবরণ। ‘আঁরে খইল যে টিঁইয়া
দশউয়া খম আসে ভাইনা, খালিয়া বিয়ান্না আঁত্তুন চাঁই লইও (আমাকে বললেন দশ টাকা কম
আছে ভাগ্নে, কাল চেয়ে নিও)’। আমড়ার দাম মিটিয়ে ক’পা সামনে গিয়েই তিনি পড়ে
গিয়েছিলেন। লোকজন জমে গিয়েছিল। কেউ একজন অবশেষে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে। রিন্টুকে
জানিয়েছিল ফোন-ফ্যাক্সের দোকানের মালিক ছেলেটা।
শাশুড়িমা আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছিলেন। ‘মামী টিঁইয়া ন
লাইবু অনে অঁড়া গুন রাঁইদন’। (টাকা চাই না মামী, আপনি
আমড়া ক’টা রেখে দিন)। রিন্টু আমড়াওয়ালার
হাতে পঞ্চাশ টাকা গুঁজে দিয়ে বিদায় করেছিল, ‘যত্ত সব!’
লোকটা বেরিয়ে যেতেই মনে হলো হঠাৎ আমড়া কেন? শাশুড়ির জন্যে পান সুপুরি আনাটা নৈমিত্তিক। অমনি বুকটা কেঁপে উঠল। ও আমড়া
খেতে চেয়েছিল উনি জানলেন কীভাবে? আর তখনই মনে পড়ে গেল সুমাইয়ার সাথে টেলিফোনের কথোপকথন।
‘বলিস না আর, সকালটা চাকরির ছুতোয় পালিয়ে
বাঁচি। ডাক্তার বেড রেস্ট দিয়েছে। বুড়োর সাথে প্রতি সকালে বসে পেপার পড়তে হবে ভাবতেই হাত
পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার একটা দিন ছুটি, ভাবতে পারবি না কী
যন্ত্রণায় থাকি আমি! এবার প্রতিদিন যদি বসতে হয় তাহলে আমি বেড রেস্টেই চিরনিদ্রায়
শায়িত হব’। ফোনের ওপারে সুমাইয়া হাসতে হাসতে শেষ। তার আগে নুনমরিচ ডলে কাঁচা আমড়া
খাওয়ার ইচ্ছের কথা বলেছিল সুমাইয়াকে। কথা
বলতে বলতে দরজার দিকে নজর চলে গিয়েছিল। কারো ছায়া সরে গেল কি? মনেরই ভুল। সবাই নিচে পুজোর তোড়জোড়ে ব্যস্ত। চান করে ওকেও নামতে
হবে। প্রবারণা পূর্ণিমা আর লক্ষ্মীপুজোর উপলক্ষে ওর স্কুল ছুটি। রিন্টু কাজে চলে
গিয়েছিল সকালে। শাশুড়িমার উপোস। ওর গা ম্যাজম্যাজ
করছিল বলে চা’টা ঘরে চেয়ে পাঠিয়েছিল।
ছায়াটা তবে সত্যি ছিল!
সবাইকে চমকে দিয়ে ও হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন