নিকেতন
ভদ্রলোক প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে বসার ঘরে। দুপুরে কক্ষনও ঘুমোয় না ও। ভ্যাপসা গরম, সে কারণেই হয়তো চোখটা লেগে গিয়েছিল। কী আশ্চর্য, তাই বলে কেউ ডাকবে
না!
প্রায় দু’ সপ্তাহ্ হয়ে গেল দেশে এসেছে। এই প্রথম ও বাবা মাকে ছাড়া একা এলো। বাবাকে ম্যানেজ করলেও মা’কে রাজী করাতে প্রচুর তেল ঝরাতে হয়েছে। এখন ওর কুড়ি চলছে। তাও মা’র ভয় গেল না।
কিন্তু ভদ্রলোকের ব্যাপারটা তো মাথায় ঢুকছে না! এখানে স্বজনদের বাইরেও কাউকে চেনে না তেমন। মামাতো বোন ঝুমু’র
দৌলতে যাদের সাথে আলাপ, তাদের কারো বয়েস, ঠিক ভদ্রলোক বললে
যে ধরনের ছবি চোখে ভাসে, তেমনটি নয়। মামীমা বললেন, রজতপ্রভা রায়-এর সাথেই দেখা করতে এসেছেন উনি। রজতপ্রভা, রিমির ভালো নাম।
বসার ঘরে ঢুকেই দেখল, মাঝবয়েসী ভদ্রলোক এক দৃষ্টিতে এক্যুরিয়ামের মাছেদের বুড়বুড়ি কাটা দেখছেন। ওর পায়ের আওয়াজ শুনতে
পাননি।
মনোযোগ টানার জন্যে রিমি মৃদু কাশি দিল।
ভদ্রলোক ত্রস্ত
দাঁড়ালেন। রিমি আরও ব্যতিবস্ত হয়ে গোল পাকিয়ে ফেলল। হাত বাড়িয়ে কানাডীয় কেতায় বলল,
- রজতপ্রভা। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।
ভদ্রলোক ওর হাত ধরে
হেসে দিলেন।
- তোমাকে আমি এখনও আমার পরিচয়ই দি’ নি।
রিমি সামলে নিয়েছে
ততক্ষণে।
- আসলে আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখার জন্যে লজ্জিত বলতে
চেয়েছিলাম, ফস্কে গেছে!
ভদ্রলোক মৃদু হাসলেন।
- তুমি ভালো বাংলা বল। আমার নাম মোরশেদুল হক। আমার একটা অনাথ আশ্রম আছে। আমি তোমাকে আশ্রমটা একবার
ঘুরে দেখার জন্যে নিমন্ত্রণ জানাতে এসেছি।
রিমির ভ্রূ কুচকে
গেল অজান্তে। ওকে কেন?
-কাল তোমাকে রবিউলের
চাচার বাড়িতে দেখেছিলাম। তোমার অনেক সুনাম করল ওরা। তুমি কাউখালিতে স্কুলের বাচ্চাদের স্বপ্ন দেখিয়ে এসেছ। কী একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছ। শুনে মনে হলো তোমাকে একবার আমার আশ্রমে আসতে বলি।
রিমি তো অবাক! এই
কাজটা ও নীরবে করতে চেয়েছিল। রবিউল নামের ছেলেটার সাথে ঝুমু’র সুবাদেই পরিচয়। ছেলেটা
ফুটপাতে বিকেলে বাচ্চাদের স্কুল চালায়। রিমি ওর সীমিত সামর্থ্য অনু্যায়ী সেই স্কুলের
বাচ্চাদের বই কিনে দিয়েছিল। আর কাউখালির ব্যাপারটা হঠাৎ, তাও রবিউলের সূত্রেই। রবিউল বড় হয়েছে এখানে। কৃষক পরিবারের ছেলে। ওদের বাড়ির পাশেই ওর প্রাইমারী
স্কুল। কিছু না ভেবেই ওরা ঢুকে পড়েছিল স্কুলে।
বাচ্চাগুলি চেঁচিয়ে বানান শিখছে। গলায় কী জোর, কিন্তু চোখগুলো মাছের মতো নির্লিপ্ত! ওর হঠাৎ মনে হয়েছিল, এই বাচ্চাদের চোখের
রঙ পাল্টানো দরকার। পড়াশোনা মানে এক সুরে বর্ণমালা কপচানো আর ‘অ’ তে অজগর ‘আ’ তে আম নয়। প্রধান শিক্ষকের
রুমে নিয়ে গিয়েছিল রবিউল।
-বাচ্চাদের সাথে আমি
কি একটু কথা বলতে পারি?
প্রধান শিক্ষক নিমরাজি
হলেও রবিউল ঠিকই ম্যানেজ করে নিল।
রিমি ক্লাসে ঢুকে
ওদের সঙ্গে অনেক গল্প করেছিল। বাচ্চারা গোগ্রাসে গিলছিল ওর কথা। এরপর ওখানে বসেই কানাডার
ওর প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক মিঃ জনের সাথে কথা বলেছিল সেলফোনে। ‘ফ্রেন্ডস ফ্রম
বাঙলাদেশ’ নামে এখানকার বাচ্চাদের সাথে রিমির ছেলেবেলার স্কুলের বাচ্চাদের পত্রমিতালীর
একটা প্রজেক্ট চালু করার প্রাথমিক কাজটা হয়ে গেল ফটাফট। ফেরার পথে রবিউলের চাচার বাড়ি গিয়েছিল সবাই। মিলাদ হচ্ছিল।
রবিউলের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে এখন। ভদ্রলোক হয়তো ওকে বিশাল ক্ষমতাধর কেউ ভাবছেন। রিমির দিকে ভিজিটিং
কার্ডটা এগিয়ে দিতে দিতে তিনি বললেন,
- তুমি তোমার সময়মতো এসো একবার। তোমার বাবা মা আমার চেনা। মনে হলো তোমার
সাথে কথা বললে এই বাচ্চারাও জীবনে কিছু করার উদ্যম পাবে।
কার্ডটা হাতে নিয়েই
রিমির চোখ চলে যায় মোটা হরফে ছাউনি মোটিফের নিচে শিরোনামে, ‘নিকেতন’। ভদ্রলোক বেরিয়ে যাচ্ছেন। বুকের গভীরে ঘাই দিয়ে নিমেষে তাজা হয়ে ওঠে তে্রো বছর আগের সেই রাত। সাত বছরের জম্পেশ জন্মদিন। বন্ধুদের নিয়ে পিজাহাট। সুইমিং পুলে দুপুর থেকে বিকেল
হইচই। সবাই চলে গেলে বাড়ি সুনসান। সব গিফট খোলা হয়নি
তখনও। বাবা আর মা ওর বার্বী বিছানার দু’ধারে। এ কথা, সে কথা, তারপরেই দুম করে বাবা জানান, ঠিক চার মাস বয়েসে ওকে দত্তক নিয়েছিলেন ওরা। ওর আদি ঠিকানা ‘নিকেতন’। মা কাঁদছিল। বাবা ওকে বুকে আগলে রেখে বলে চলেছেন, ‘ইউ আর আওয়ার
প্রিন্সেস, সামহাউ মিস্প্লেসড ফর আ ভেরি ব্রিফ টাইম’। রিমি কিছুই শুনছিল না, কেবল দেখছিল ওর সাত বছরের প্রাসাদটা ঝুরঝুরে বালি হয়ে
মিশে যাচ্ছে মাটিতে।
কার্ডের লেখাগুলো ঝাপসা
লাগছে। বহুদিন পর বুকের গভীরে
চোরকাঁটাটা খোচাঁচ্ছে ওকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন