শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

রুমা মোদক

কৃষ্ণকলি 

গায়ে হলুদের দিন ওর গায়ে যথেষ্ট পরিমাণ হলুদ মাখানো হয়েছিল, যেন বিয়ের দিনটাতে ওকে ফর্সা দেখায়আর উত্তর পাড়ার সই রেহানা ওর গায়ে ডলে ডলে হলুদ মাখতে মাখতে আদি রসাত্মক ঠাট্টায় হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছিল গায়ে আর চোখ ঠারে বলছিল, মাইয়া কালো হইলে কি অইবো? গায়ে   যৌবন ঢলঢলব্যাটা কি না দেইখ্যা পছন্দ করছে? কোনোদিন পুরুষের  সান্নিধ্য কিংবা স্পর্শ না পাওয়া রেবেকা তখন বিভোর নতুন স্বপ্নে, অচেনা শিহরণে ঘোর লাগছিল সবকিছুএই যে আয়োজন, হৈ হুল্লোড়, মোরগ জবাই,  আত্মীয়-স্বজন, হলুদ মেহেদী, পাত্রপক্ষের বারবার মোবাইল ফোন ইত্যাদি কোনোকিছু সে যেন উপলব্ধি করতে পারছিল না ভিতর থেকে মনে হচ্ছিল কেবল মানে মানে দিনটা পার হলে সে বাঁচেতাঁর স্বপ্ন সত্যি হয়ে যায়, তার অপেক্ষা শেষ হয়ে যায় তাই ঘটে, যা ঘটা অসম্ভব নয়।

সবাই বলাবলি করছে, কপাল বটে রেবেকার! কালো কুচকুচে মেয়েটির দিকে  হঠাৎ সবাই খুব মনোযোগ নিয়ে তাকাতে শুরু করেছে... কী আছে মেয়েটির  মধ্যে? রেবেকার পরীক্ষার ফলাফলগুলো খুব ভালো, সবকটাতেই প্রথম শ্রেণী,  কিন্তু এমন বর পাওয়ার ক্ষেত্রে এটা কোনো যোগ্যতা বলে মনে হয় না কারো সদ্য ইউনির্ভাসিটি পার হয়ে আসা বান্ধবীরা কয়েকজন দল বেধে এসেছে  ঢাকায় রেবেকার হবু বরকে নিয়ে একবেলা চাইনিজ খেয়েছে ওরা, রেবেকাও সাথে ছিল আড়চোখে দেখেছে লোকটিকে অদ্ভুত সুপুরুষ, প্রতিষ্ঠিতও বটে!  বয়সও খুব বড়জো রেবেকা থেকে বছর পাঁচেকের বড়এই লোক কেন  পছন্দ করল রেবেকাকে? বান্ধবী পল্লবী বলেছিল চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে, দোস্ত পথেঘাটে ছেলেরা আমাদের প্রেমে পড়েছে, আমরাও হালি হালি প্রেম  করেছি, আর শ্যালা ছক্কা মারলি তুই? দুঃখ নয়, দুঃখবোধ ছিল রেবেকার কোনোদিন কো্নো মুগ্ধ নয়ন পড়েনি তার দিকেপ্রেমপত্র লেখায় যোগ্যই মনে  করেনি ওকে কেউ কোনোদিন সেই সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ যখন, গ্রামে বখাটেদের  উৎপাতে স্কুল যাওয়া ছেড়ে দিল অনিমা ফারহানারা; কিন্তু দিব্যি স্কুল পেরিয়ে নির্বিঘ্নে কলেজ শেষ করেছে রেবেকা, কোনোদিন কো্নো উৎপাত সহ্য করতে হয়নি ওকে

বুদ্ধিটা ভীষণ তীক্ষ্ম ছিল বলে স্কুল কলেজ পেরোনার সনদগুলোর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলটাও ছিল মেধা তালিকার প্রথম দিকে সেখানে যখন বান্ধবীরা চুটিয়ে প্রেম করেছে ক্লাসমেট সিনিয়ার ভাইদের সাথে, ডেটিং করেছে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে, ছেলেবন্ধুদের সাথে সিনেমা হলে ঢুকেছে হঠাৎ  বৃষ্টিদেখতে, রাতভর চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছে টিএসসির মাঠে হল গেটে,  তখন রেবেকা লাইব্রেরিতে এ্যাসাইমেন্ট তৈরি করেছে কিংবা খুব বড়জোর রুমের অবৈধ হিটারে চা চাপিয়েছে টোস্ট বিস্কুট চুবিয়ে খাবে বলেএই অনিবার্য বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার অভ্যাসে অবশ্য রেবেকার লাভ হয়েছেপ্রখর একটা ব্যক্তিত্ববোধ তৈরি করতে পেরেছে সে। ফলে, ভোগেনি হীনমন্যতায় কিংবা আত্মবিশ্বাসের অভাবে নিজেকে তৈরি করেছে তীক্ষ্ণ মেধার দীপ্তিতে। অবশ্য   গল্প উপন্যাসের নায়িকার মতো মেধার দীপ্তিতে চকচক করে না ওর মুখাবয়বসবার মাঝখানে খুব সাদামাটা আর অনাকর্ষণীয়ই দেখায় ওকেতবু সুপুরুষ এই লোকটি একবার দেখেই ওকে পছন্দ করল যদিও কথাবার্তা হয়নি তেমন কিছু যে, রেবেকার অসম্ভব ব্যক্তিত্ব আর মেধা তাকে মুগ্ধ করবে

বিয়ের দিন বেশ টাকা দিয়ে গঞ্জের বিউটি পার্লার থেকে বিউটিশিয়ান আনা হয়েছিলমা, আপারা বারবার বলেছিল, মেকাপ যেন একটু বেশি করে দেয়া  হয়রেবেকাকে যেন ফর্সা দেখায়ভীষণ বিরক্ত হলেও নতুন বউরা মুখে কিছু বলতে পারে নারেবেকাও পারেনিবিউটিশিয়ান আদিবাসী কুন্তলা চাকমা প্রাণপণ চেষ্টা করেছে রেবেকাকে ফর্সা বানাতে সারা গলায় ঘাড়ে ডলে ডলে  ঘষে ঘষে ফাউন্ডেশন, তার পর ব্লাশার ইত্যাদি কত কী ডলতে ডলতে রেবেকাকে অচেনা করে ছেড়েছে

রেবেকার তেমন কিছু মাথাব্যথা ছিল না এ নিয়ে, ওকে ফর্সা দেখাচ্ছে নাকি কালো দেখাচ্ছে, সুন্দর দেখাচ্ছে নাকি কুশ্রী! রেবেকা কনের বেশে বসেছিল মালা বাধাঁনো খাটেঅতিথিরা আসছিল, ভিড় বাড়ছিল, বাড়ছিল হৈ-হুল্লোড়,  তখন ভীষণ ঘামছিল রেবেকা, ভিড়ের চাপে নয়, ভেতরের অস্থিরতায়আজম্ম  পুরুষের স্পর্শহীন রেবেকার সর্বাঙ্গ যেন ভরা বর্ষার জলে ফেঁপে ওঠা নদী, পাড় ভাঙার অপেক্ষায় উদগ্রীব। ওর ঘুমন্ত নারীসত্তাকে জাগিয়ে দিয়েছে ভীষণভাবে  সেই পুরুষরেবেকা আকন্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে প্রহর গুনছিল লোকটির সঙ্গলাভের আর সঙ্গে ছিল সেই প্রচন্ড উৎকন্ঠা, কেন লোকটি তাকে পছন্দ করেছে!



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন