সীমানা ছাড়িয়ে দূরে
কখনো রাতের আকাশে সপ্তর্ষি বা
কালপুরুষ খুঁজে দেখেছ? জন্ম, মৃত্যু ও জরা এক অমোঘ সত্য। তুমি কি জানো, প্রত্যাশাগুলো
কমিয়ে আনতে পারলে আর কোনো দুঃখ থাকে না... আরো
কীসব তিনি বলছিলেন টিভিতে।
ঘর ছেড়ে ধীরে ধীরে বারান্দায় গেলাম। নিচে তাকিয়ে দেখলাম, অন্য
বিকেলগুলোর মতোই আজকের বিকেল। মোড়ের
দোকানটায় ভিড়, দুটো ছেলের দ্রুত বাইসাইকেল
চালিয়ে যাওয়া, মিনারেল ওয়াটারের ভারী বোতলগুলো নিয়ে
একটা রিক্সাভ্যানের দাঁড়িয়ে থাকা।
পা দুটো এখনো কমজোরি। টলমলে
মাথা। দু’হাতে শক্ত করে ধরলাম বারান্দার গ্রিল।
আরিয়ান ঘরের মেঝেতে বসে একমনে
খেলছে। আশিকা ড্রেসিংটেবিলের সামনে চুল আঁচড়াচ্ছে। আশিকার
পাঁচ, আরিয়ান সাড়ে তিন।
গ্রিলে ভর করেই দাঁড়িয়ে আছি, ভয়
করছে গ্রিল ছাড়লে যদি পড়ে যাই!
মামুন কী করছে? হাসপাতাল থেকে ফ্ল্যাটে
ফেরার পর থেকে ওর সাড়াশব্দ নেই।
হয়তো ছবি আঁকছে! আবার
এসে বিছানায় শুলাম। টেলিভিশন
বন্ধ করে দিলাম। কী যেন তিনি বলছিলেন, দুঃখ নিয়ে, চাওয়া নিয়ে... সত্যিই কি বেশি কিছু চাই! মামুন আর আমার যৌথ জীবনে বিয়ের প্রায়
দেড় বছর পর রুমা নামের তৃতীয় কারো যুক্ত হওয়া কি ছন্দপতন ঘটায় না? আশিকা
আসার পর যদিও ভেবেছিলাম মামুনও আমার মতো
আশিকাকে নিয়েই মেতে আছে, আবার একটু একটু করে জুড়ে যাবে হয়তো ফাটলগুলো...
আরিয়ান তার ছোট হাতদুটো আমার কপালে
রেখেছে। জানতে চাইল, তোমার কি খুব জ্বর?
আধো আধো কথা এখনো ওর। একটা সরলরৈখিক পথ হঠাৎ করে বাঁক খেয়ে গেছে। বাঁকের
মুখে ভয়াল খাদও। পা হড়কালে মৃত্যু। তেষ্টা পায়। রুমাকে অন্য শহরে
পাঠিয়েছিলাম। আরিয়ানের দুইহাত কপালে এখন। ঘরে আলো কম। অন্ধকারে
আরিয়ান ভয় পায়। বুকের কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে ওঠে। আরিয়ান, রুমা
মামুনের
সন্তান। ভেবেছিলাম দূরে সরিয়ে দিলে বুঝি বন্ধন ছিঁড়ে যায়, অথচ আশিকার দেড়
বছরে মাথায় আরিয়ান জন্মালো। সেকথা
জানতে আমার এত বছর লেগে গেল....
মাত্র পনের দিনে কি এ ঘরের রঙ সম্পূর্ণ
বিবর্ণ হয়ে গেল, নইলে ধূসর কেন সব!
অসহ্য লাগতে শুরু করে। আশিকাকে গলার সবটুকু শক্তি দিয়ে ডাকতে
চেষ্টা করি, চোখ বেয়ে জল গড়ায়।
আরিয়ান আবার বলল, আমার মা কোথায়?
এক ঝটকায় ওকে সরাতে গেলাম।
সামলাতে না পেরে ধুম করে পড়ে দরজায়
মাথা ঠুকে যায় ওর। চিৎকার শুনে আশিকা দৌড়ে এসে ভাইকে তোলে। মামুন
এ ঘরে আসে। মৃদু আলোটা জ্বেলে দিয়ে আরিয়ানকে কোল তুলে আশিকার এক হাত
ধরে অন্য ঘরে চলে যায়। দু’
হাতে আমি মুখ ঢেকে ফেলি।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চোখ
খুলে আরিয়ানের মুখ মনে পড়ে।
উঠে বসি বিছানায়। দেওয়াল ধরে ধরে সামনে এগোই। পাশের ঘরটায় আলো জ্বলছে। ডাইনিং
থেকে দেখতে পাই, মামুন আরিয়ানকে ঘুম পাড়াচ্ছে। আশিকা শুয়ে কার্টুন
দেখছে। হাতে বড় একটা কিটক্যাট। আরিয়ান আধো ঘুমের
ভেতর দু’বার মা বলে। আমাকে না। ও
আমায় কোনো কিছু বলে সম্বোধন করে না।
জলের বোতল নিয়ে ঘরে ফিরে ওষুধ খাই,
সাথে ছোট একটা আপেল যা ফ্রিজে থেকে থেকে আরো ছোট হয়েছে। কানে লেগে থাকে আরিয়ানের
মা মা বলা। ভোরের দিকে আরিয়ানের মা আসে। হিস হিস করে
বলে, খুব খিদে তোর? আরিয়ানকেও খাবি? আমি বুকে বালিশ জড়িয়ে পিছোতে থাকি, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়।
আরিয়ানের মা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিজেকে
বাঁচাতে আরিয়ানের মা’র খোলা চুল দু’ হাতে
ছিঁড়তে যাই। ও আমার ডান স্তনের মাংস কামড়ে তুলে নিলে আর্তচিৎকার করি। আমাকে
শূন্যে তুলে আছড়ে ফেলে ও।
ঘাম সপসপে শরীরে হিমশীতল ঘরে জেগে উঠি। ভোর
এসেছে অনেক আগে। পায়ে
পায়ে পাশের ঘরে যাই। আরিয়ান আর আশিকা একে অন্যকে জড়িয়ে, পাশের সোফায়
মেঝেতে পা ঝুলিয়ে মামুন।
আরিয়ানের মাথায় হাত রাখলে ও হঠাৎ ঘুমের
মধ্যে
বলে ওঠে, মা! হাত সরিয়ে নিই।
****
কখন কীভাবে জেলখানায় এসেছি, জানি
না। ভিজিটিং
আওয়ার্স নয়। জেলার আমার শারীরিক অবস্থা বুঝে সদয় হন বুঝি! পায়ে
পায়ে রুমার সেলের দিকে এগোই।
রুমা ভীত চোখে তাকিয়ে। যেন
দুঃসংবাদের অপেক্ষায়। কাছে গিয়ে দাঁড়াই।
বলি, রুমা, আরিয়ান ভালো আছে। রুমা
কেঁদে ফেলে ঝরঝর করে। শরীর ঝিমঝিম।
মাথায় কেবল রঙের স্প্ল্যাশ। এখনও
নির্বিষ হইনি! যে বিষ ধারণ করেছিলাম, তা ধরেও তো রাখিনি! সমস্ত জেনে যাবার
পর থেকেই আমি রুমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছি। মামুনকে
দিনের পর দিন ঘরে আটকে রেখেছি।
তারপর এলো ওইদিন, মিথ্যে কেসের
আসামী
করে রুমাকে জেলে পাঠিয়ে আমি হাসপাতালে। আর নয়। আশিকার
পর আর কেউ আসবে না। আড়াই মাস চলছিল।
আরিয়ানের কথাও কি জানতাম... এবরশনের ধকল শরীরে, হাসপাতালে, মামুন ফোন করল, তুমি কোথায়? আরিয়ানকে
বাড়ি নিয়ে এসেছি।
আবার সুইসাইডের চেষ্টা...
ফ্ল্যাটে ফিরতে ফিরতে বেলা বাড়ল। মামুন
দরজা খুলে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। আরিয়ান
আমাকে দেখে দরজার ফাঁকে লুকিয়ে পড়ল।
আশিকা পেইন্টিংএ ব্যস্ত। আরিয়ানকে
ইশারায় ডাকলাম। আমার হাতে ওর জন্য কেনা পোকোম্যান রিস্টওয়াচ। আরিয়ান
ইতস্তত করল। আমি দু’হাত বাড়িয়ে দিলাম।
রুমা ও মামুনের ছেলে আরিয়ান পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে।
মাথায় রঙের ঘূর্ণি নাচছে প্রবল...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন