স্লিপিং পিলস্
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটা রাত। উল্টোদিকে শোকেসের কাচে প্রতিফলিত হওয়া সংখ্যাতত্ত্ব, সঙ্গে মেপে-ঝোপে তাপমাত্রার অবাধ বিচরণ... শুরুটা সেই নব্বই দশকের গোড়ার দিকে। তখন সরষের বালিশ মাথায় দেওয়া থাকত ঘাড় শক্ত হবে বলে... আর যত দিন গেছে, সালের সংখ্যা যত বেড়েছে, শক্ত হয়েছে মন... সেই বালিশেই, তবে ঘাড় গুঁজে নয়, মুখ গুঁজে।
সরষের ঝাঁঝগিরিও এখন আর চলে না... ক্লাস ওয়ানের দুগ্গাপূজো রচনার 'শরৎ কালের আকাশে পেঁজা তুলোর' অবস্হান এখন 'Down To
The Earth' বা আর একটু গভীরে বললে,
‘Down To The Bedroom'...
কী যে সেই সখ্যতা বালিশের সাথে... বোধহয় শুয়েও বোঝানো যায় না।
বিছানার কোণ করে বাঁ-দিক ঘেঁষে তিনজনের তিনটে বালিশ, বাপ-মা-ছেলে, আর দু-খান পায়বালিশ, ওপরে একখান চাদর। সে চাদর আবার গিরগিটির ন্যায়, মাঝে মাঝেই রং বদলায়। জ্যেঠু-জ্যেঠিমা এলে চার বছর আগের পুরনো চাদর, মামু-মামি এলে বাটিক প্রিন্ট, আর বন্ধুর মা-য়েরা এলে ভেলভেট...
তবে বালিশের রং কিন্তু কোনোদিনই বদলায়নি, বদলায়নি গন্ধও। ঘুম পাড়ানোটা ধীরেধীরে একসময় যখন লুপ্তপ্রায় অভ্যেসে পরিণত হচ্ছিল, তখন থেকেই বালিশের নারকেল তেলের ভিজে ভিজে গন্ধটা আফিমের কাজ করত।
তুলোর এই আয়তক্ষেত্র কত কিছুরই না সাক্ষী থেকেছে! কত গোপন কথা, গোপন দুঃখ, গোপন ইচ্ছে... ছোটবেলা থেকে ছেলেবেলা পেরিয়ে, বড় থেকে বুড়ো হওয়ার পথে এমন এক নিরপেক্ষ সহযাত্রী বালিশ ছাড়া আর ক-জনই বা হতে পেরেছে!
বয়ঃসন্ধির আড়ালে গোঁফদাড়ির সবে সবে যাতায়াত, জীবন বিজ্ঞান বইয়ের ভাঁজে সদ্য বড় হওয়ার হাতছানি, হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুল প্যান্ট... আর জ্যাঠতুতো দাদার
পাল্লায় পড়ে প্রথমবার... নীল-চিত্র...
পরে রাতের বেলা ঐ তুলোর সামনেই তো র্নিভয় কনফেসান...
‘আর কোনোদিনও দেখবো না... প্র্রমিস...'
এরপর একদিন হঠাৎ করেই ‘পায়’-বালিশের ‘পাশ’-বালিশ হয়ে ওঠা...
‘বিম্ব’ নামের মেয়েটি ‘প্রতিবিম্ব' হয়ে ঘুরে বেড়ায় আজকাল... এদিকে আবার অবস্হাঅনেকটা ঐ... 'বলব বলব করেও কেন বলতে পারছি না!'
তাই অগত্যা পাশবালিশই সব...
একদিন তো... একদিন তো... (ভাবছি বলবো কিনা )... একদিন তো, মানে ইয়ে... ওই পাশবালিশটাকেই ছোত্ত করে একটা চুমু খেয়েছিল...
তবে ঐ একদিনই... সত্যি...
তারপর একদিন বেশ সাজুগুজু করে ছায়া ছোঁয়ার প্রস্তুতি। কিন্তু সেদিন বিম্ব আর 'বিম্ব' থাকলো না, ততক্ষণে আলো হয়ে গেছে।
আবার আরেকবার বালিশ মুখ গোঁজা। নারকেল তেলের সঙ্গে নোনাজল তখন একাকার হয়ে গেছে, তবু 'পাশ'-বালিশ আর কোনোদিনই 'পায়'-বালিশ হয়নি...
তোর মুরদে কিচ্ছু হবে না... এ তো প্রায় বাণীর মতো হয়ে গেছিল। উঠতে, বসতে,খেতে, শুতে...
নাহ্... একমাত্র ঐ বালিশ-ই বলেছিল... 'তোর হবে’...
হয়েও ছিল.... ঘুম!
তারপর থেকে কত ঘুমই এসেছে, গেছে। একটা মধ্যবিত্ত স্বপ্ন চিরকাল গ্রাস করে থেকেছে একটা মধ্যবিত্ত জীবনকে। তার মাঝেই বালিশের ভালোবাসা ভাগ করে নিতে হয়েছে কিছু মানুষের সাথে, তাও সেই তুলো তুলো পরিবেশ কোনোদিনই ভোলা হয়নি।
বয়স এখন মরচে ধরিয়েছে শরীরে, তার সঙ্গে ইন্দ্রিয়গুলোর বিশ্বাসঘাতকতা তো আছেই। পাশে থাকার যার কথা ছিল, সেও আজ চরম সত্যের শিকার, রক্তের সম্পর্কও আজ ভীষণ ভাবে নিয়মনিষ্ঠ। এখন চারপাশে শুধুই বার্ধ্যকের সরলতা...
আর থাকার মধ্যে আশ্রমের একফালি রোদ, একখান জলচৌকি, আর... আর... বালিশ...
ভাগ্যিস... ভাগ্যিস... প্রথম দিন থেকেই তুলো আঁকড়ে বাঁচতে শিখেছিল...!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন