ক্যানসার
প্রবল ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকাচ্ছিল
অনেকদিন। কবে যেন ধরাবে আগুন। পুড়িয়ে ছাড়খাড় করবে সব। আমি আগুন নিভিয়ে রাখছিলাম
ঘরের। পরিপাটি করছিলাম উঠোন। বারবার টানটান করছিলাম বিছানার চাদর। ফুলদানীতে ফুল
মরে গেলে বাসী ফুলগুলো ফেলে নতুন ফুলে বার বার সাজিয়েছিলাম ফুলদানী। উড়ে যাওয়া
ঘরের চাল জুড়ে দিয়েছিলাম বাবুই পাখির মতো ঠোঁটে করে একটু একটু খড়কুটো এনে। এখানে
একটা ঘর আছে। ঘরের ভেতর একটা দেহ আছে। দেহের
ভেতর একটা মন আছে। মনের ভেতর একটা ঘা আছে। জমাট। দগদগে। তাকে দেখবার সময় ছিল না
কখনো
আমার। চিকিৎসা কিংবা চিকিৎসক ওষুধ কিংবা পথ্য না পেতে পেতে ঘা টা
প্রবল আকার ধারণ করে গেছে একসময় আর অক্টোপাশের মতো
জড়িয়ে ধরেছে প্রবল কেবলই। ক্যানসার। বুঝতে পারিনি। জানালাটা
খোলার সময় হয়নি কখনো। খুলবো খুলবো করে দিন গেল। দিনের পর দিন
গেল। মাস গেল। বছর বছর গেল। যুগ গেল। যুগ
যুগও বুঝি যেতে বসলো। চিঠি আসতে শুরু করলো। বসন্তেরও
যাবার সময় হলো। একদিন দারুণ ঝড়ে নিজেই খুলে গেল জানালার কপাট। ঘর
জুড়ে ধূলো এলো। বিছানার
গোছানো চাদরটা এলোমেলো বাতাসে অগোছালো হলো। ধূলিতে
মলিন হলো সব। সাথে বৃষ্টি এলো ।ভিজিয়ে দিয়ে গেল ঘর। আর তারপর সেই
বৃষ্টিমাতাল হাওয়া সেরে তুমি এলে। যেন বহুদিনের বরষামেঘের দিন শেষে একটা
নতুন-আলসে-চাঁদ উঠলো আমার আকাশে। আমি অনেক আদরে দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে
নিলাম তাকে। কোথায় রাখবো এ মড়া নদীর পাড়ে জন্ম নেওয়া নতুন চাঁদের আলো। দিশেহারা
মন। উদাসীন ঘর বর সংসার সব। বেঁচে থাকবার প্রবল বিশ্বাসে আমি
জড়িয়ে নিলাম সে গভীর আলো। আমি উল্টো পথে হাঁটলাম। জগৎ সংসার
স্বপ্ন প্রত্যাশা সব কিছু থেকে অনেক অনেক দূরত্বে যে পথ। গন্তব্য
জানে না। অ-সী-ম। পেছনে
পড়ে থাকলো আমারই আত্মার কিছু অংশ। হয়তো একদিন ছড়াবে তারা আলো পৃথিবীর অন্ধকারে-
একটা নতুন জন্ম যেন। নতুন
শপথ। অথচ প্রতি মুহূর্তে আবিষ্কার করি চির
পুরাতন আমাকে। বহুযুগ আগে যেমন খুব গোপনে প্রথম ফুটেছিল সন্ধ্যামালতী তেমনি
আজো ভোরবেলা ঝরে পড়ে মনোবাতায়নে রাতের ফোঁটা শিউলি ফুল। কী
যে সুঘ্রাণ তার! গোপনে আসে চিঠি। সে
চিঠি লুকোবার জায়গা নেই। যেথায় তারে লুকাই আমি সেথায় পড়ি ধরা। তবু
গোপনে লুপ্ত অবদমনে সে এক নগণ্য নক্ষত্র হয়ে
জ্বলে থাকে এতদিনের অন্ধকার আকাশে। নিঃশব্দে নিমগ্ন সত্ত্বায় ভর করে থাকে
প্রেম। মায়াবী এক স্নিগ্ধতা। প্রেম! বুঝি
প্রেমই এলো। নিবিড় প্রত্যাশা জাগে চুপিসারে। স্তব্ধবাক
হৃদয়ের গোপন ঘরে। তবু স্বপ্ন জাল বোনে। ইঁদুরে কাটবে বলে ঊর্ণ কি বন্ধ রাখবে তার
জাল বোনা! সমাজ সংসার সব তুচ্ছ মনে হয়। ক্যানসারটা বুঝি এই জীবনের জন্য সেরে
যাবে। হঠাৎ যেন কোথায় এক অমলিন বাতি জ্বলে ওঠে। যার ক্ষয় নেই। আর
সে যেন এক নিমগ্ন বাতিওয়ালা। কিছু দিন যায়। পূবে
আদিসূর্য। বারান্দায় কিশোরী রোদ। চড়ুইগুলো
এক্কাদোক্কা খেলতে শুরু করে। দখিনে বাতাস। যেন হিল্লোল তুলে আবার ঘরে বাইরে
চেতনার গভীরে। সে এক অনাদি। বিশুদ্ধ। চির
অপরাজেয় এক বর্ণিল ঘোর লাগা পৃথিবী। আলো এসে রাঙিয়ে দিয়ে যায় আমাকে। সেখানে
রোজ পাখি ডাকে শৈশবের সুরে। রোজ প্রজাপতি পাখা মেলে ভুবন ভরিয়ে।
সূর্যের বিচ্ছুরিত আলোর প্রতিটি রঙ আর রেখায় কী যে সুমধুর রাগ! বৃষ্টির
জল। জলের প্রতিটি কণায় কী যে অপরূপ সুধা। জড়িয়ে
রাখে প্রতি পল অনুপল মথিত আবেগে। মিহি সুতোয় বুনে দিয়ে যায় এক অত্যাশ্চার্য্
স্বপ্নাতুর বিহ্বলতা। সে অনেক দূর। আমি আরো সুদূরের বাসিনী। ক্ষণিক
পথ চাওয়া। ক্ষণিক আসা যাওয়া। কখনো পাতার আড়ালে বসা। চুপি
চুপি তারার সাথে কথা কওয়া। চাঁদের পাশে ছবি তোলা। জলের
অতলে ঘর বাঁধা। বুঝি কখন কিশোর এক ছুঁড়ে দেবে ঢিল। জলের
প্রাণ ভেদ করে চলে যাবে অতলে। কোনো
এক বিরহী যুবকের বাঁশিতে তোলা বেহাগের ক্ষীণ রাগিনীর মতো মৃদু অথচ গভীর ঢেউ ক্রমশ ছড়াতে ছড়াতে ছড়াতে শত টুকরো
হয়ে ভেঙে পড়বে ঘর। আর তার অনুরণন ছড়াতে থাকবে যাপিত জীবনের প্রতিটি
সূক্ক্ষ্মতর সময়ে। এমনই মিহিন ঘর। এক
র্নিমম বাস্তবতা। বাঁশি সুর ছড়ালো। বাঁশি মন ভরালো। টেনে আনলো পথে মাঠে
ঘাটে। তারপর সুর হারালো বাঁশি। পথ
হারালাম আমি। পথ। সে এক অজানা র্দূলক্ষ্য পথ। উড়ে
যাওয়া মেঘে স্বপ্ন ধোয়া কন্টকিত এক নির্মম বাস্তবতা।
মরে যাওয়া শত শত স্বপ্নের কফিন কত নিজ
হাতে রেখেছি মাটির তলে। জলের শিশির একা নিঃশব্দে ঝরেছে কত
নিরালা একাকী প্রহরে। ছেয়েছে আকাশ কত যে অতন্দ্রা বিষণ্নতায়। বিচ্ছিন্ন
মনের জোড়া লাগানো সন্ধিগুলো ছড়িয়ে পড়েছে এখানে সেখানে। খুব
গোপনে জুড়ে রেখেছি নিজেরই শব। নিদারুণ বাস্তবকে মেনে নিতে নিতে
একদিন মনে হলো এখনো দখিনের কিছু বাতাস বুঝি রয়ে গেছে বাকি। এখনো
মৃত্যুর বুঝি কিছু অবশেষ আছে। এখনো জন্মের কিছু ভ্রূণ পড়ে রয়েছে
বুকের অতলে। কিন্তু সব সত্য সত্য নয়। সব
সত্য সত্য হয়ে ওঠেও না। মনের
গভীরে ভীষণ ভালোবাসায় জন্ম নেয় যে আত্মজের মুখ তা কখনো মিথ্যে হতে পারে না। কিন্তু
পৃথিবীর আলোয় তা কি সদা সর্বদা সত্য হয়ে ধরা দেবার সুযোগ পায়! আমিই
বা কী করে অস্বীকার করি তার জন্মের সুতীব্র আলো!
তাই, পিঠে বেঁধে
নিই আত্মজের ছায়া। গলিত স্বপ্নের লাভা ছড়িয়ে দিয়ে চলে যাই বনপথরেখা ধরে অনেক অনেক
দূর। তোমার জন্য। তোমাদের জন্য। যাদের
ঘর বেঁধেছি রক্ত রেখায়। স্বপ্ন বুনেছি ক্ষরিত স্বেদে। ভালোবাসা
ছড়িয়েছি তুমুল খরায়। ঝড়ে উড়ে যাওয়া চাল জুড়েছি নিঃশব্দে। এঁকে
দিয়েছি মাথার উপর আকাশের মতো বিশাল নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। তারা
ভীষণ উদাসীনতায় জ্বেলেছে আগুন। পুড়িয়েছে
ঘর মন উঠোন আর দারুণ শিল্পীত ক্ষুধা।
আমি বরং নিঝুম পাহাড়ই হই। নির্বাক
নিরালা অনুভব। সবুজ ঘাসের মাঠে তুমি কিংবা তোমাদের আসা যাওয়ার সরল হিসেবে আর
গরমিল হবার আশঙ্কা থাকবে না। এতদিন
সমতলে পেয়েছ। এবার একটু বাড়তি শ্রম লাগবে। অতল
উথল খাঁড়ি পথ বাওয়া। শুধু দুটো পা’ই যেখানে ভরসা। তবু
ভালো। পৃথিবীর পঙ্কিল দ্বন্দ্ব পাবে না
তার অবাধ বিস্তৃতি। তোমার ধোঁয়াশা মন জ্বালে রোদ্র
জ্বালা। পোড়ায় দীর্ঘ বনপথ। আমি পাহাড়ের বুকে পাখি কেটে আঁকি
স্বপের মেঘমালা। পাখি উড়ে যায়। বেঁধে রাখি তার ছায়া, উড়ে যাবার
পথরেখা। তোমার ছড়ানো ঊর্ণাজালে তেমনি মোহন মায়া। মরিচীকা। শুধু
স্বপ্ন জড়ানো হিমশীতলতা। আঁখি খুললেই স্বপ্নের অকাল মৃত্যু। বিষম
ভয়। নিজেকে চিনতে পারি না আর। এত বিষণ্নতা আমার,
বন্ধু ছিল না কোনোকালে। এখানে
জল তো ওখানে নদী। ওখানে নদী তো এখানে ঝর্ণা। নদী
শুকালে দূরের ঝর্ণা থেকে জল টানা। এভাবেই ছিল দিনাতিপাত। তুমি
জানালে অতলে গভীরতা আছে আরো। সেখানে উঁকি দিলে দেখা যায় এক ধূসর
মরুভূমি। তুমি যাকে বল সজল পৃথিবী। তোমাদের
আর আমার দেখায় অনুভবে এমনই বিস্তর ফারাক। তবু একদিন খুব ভালোবেসেছি তোমাদের। একদিন
কেন বলি। এখনো বাসি। কিন্তু বাসতে চাই না
আর। এই বর্তমানটা অতীত হয়ে যাক খুব চাইছি মন থেকে। তাই
নিজেকে ভবিষ্যতে দাঁড় করাই। তখন দেখি তোমাদের ভালো না বেসেও থাকতে
পারি আমি। আজ যেটা অসম্ভব মনে হয় ভবিষ্যতে দাঁড়িয়ে দেখি তার সবটাই সম্ভব।
তোমার তমিস্র আমাতে ধন্ধ জাগায়। মোহজালে আবিষ্ট রাখে। আমার
চির পুরাতন চির প্রাচীন অনুভবকে মনে হয় ভীষণ পরাজিত। পথহারা। বুঝি না,
আমি কি তোমার কবিতা না কথা। বুঝি না
তোমার হৃদয় না ব্যথা। বাস্তব না স্বপ্ন। এতই
বিপরীত সবকিছু। তাই আমি কেবল দূর খুঁজি। দূর
দূ..র। আরো দূরে গিয়ে দেখতে চাই। কতটা উন্মাতাল হলে প্রেম যুগ যুগ জিও।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন