গুটিপোকা
সকাল আটটা। মোবাইল ফোন বেজে উঠল। আধা ঘুম আধা জাগা অবস্থায় রাশি ফোনটা রিসিভ করে ঘড়ির দিকে নজর দিল। না, আর শুয়ে থাকা যাবে না। রাত বারোটা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত সে ফোনেই ব্যস্ত ছিল। জন্মদিনের শুভেচ্ছা
জানিয়ে বন্ধুদের ফোন। তারমধ্যে স্পেশাল জনের সাথেই তো প্রায় দেড় দু'ঘন্টা কেটে গেল ভাব-ভালোবাসার কথায়। এখন সকাল হওয়া
পর্যন্ত অপেক্ষা করে উইশ করে সেকেলেরা। রাশি একালের মেয়ে, তার বন্ধুরাও একালের। স্বাভাবিক ভাবে তাদের জীবনযাত্রার ধরনধারণও একালের। রাতভর ফোনে লেগে
থাকা, বাবা-মা কেউ পছন্দ করে না। তার ওপর ওই
প্রেমের কথা যেদিন জানবে, রাশি নিশ্চিত, বাড়িতে সেদিন ছোটখাটো একটা হিরোশিমা নাগাশাকি
হয়ে যাবে। এ নিয়ে এখন সে মাথা ঘামাতে বিন্দুমাত্র রাজী নয়। কী করবে সে সময়, ভাবা যাবে। তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে আজ রাত আটটায় পার্টি আছে। অবশ্য তার আগে বিকেল পাঁচটায় নন্দনে দেখা করতে
হবে। মজা করে বলেছে, এমন ভাবে সেজে
আসতে যাতে সিডিয়ুইসড হয়ে যায়। রাশিও মনে মনে চ্যালেঞ্জটা একসেপ্ট করে নিয়েছে। তবু এত খুশীর
মাঝেও একটা মন খারাপ মাঝে মধ্যে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পরছে। এবার জন্মদিনে রাঙ্গাদিদার ফোন আসল না। হয়তো আর আসবেও না। তিরাশি বছরের দিদা দিন পনেরো হলো অসুস্থ। এই সেদিন
পর্যন্ত শক্ত সামর্থ্য ছিল। হঠাৎ করে জ্বরে কাবু হয়ে সব বেসামাল হয়ে গেল। প্রথম দশদিন প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় ছিল। আজ দিন পাঁচেক কিছুটা ভালো। মাঝে মধ্যে কথা বলছে। যদিও ডাক্তার খুব
একটা আশাবাদী নয়। নাতি নাতনির মধ্যে রাশি তার সবথেকে আদরের। হয়তো একমাত্র নাতনি
বলে যাবতীয় আদর সে নিজের দিকে টেনে নিয়েছে। কত গল্প শুনিয়েছে দিদা। তার যুগের গল্প – মেয়েদের গল্প। তাদের মুখে কুলুপ
এঁটে থাকার গল্প। রাশির যে সবসময় শুনতে ভালো লাগতো, তা নয়। যে ছোট থেকে কোয়েড স্কুল কলেজে পড়ে
ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছে, তার কাছে এসব গল্প কেমন যেন অবাস্তব। তবুও
কিছু না বলে চুপ করে শুনত। দিদা যে সাংসারিক জীবনে দাদুকে নিয়ে অসুখী ছিল, তা তার
গল্প করা থেকে রাশি বেশ অনুমান করতে পারত। সব থেকেও কী যেন নেই। কী যেন এক অতৃপ্তির
সাথে যুঝে গেল সারাজীবন। রাশি অনেক সময় জানতে চাইলে মুচকি হেসে জবাব দিত, নতুন জন্মে সব
ঠিক হয়ে যাবে, কোনো দুঃখ থাকবে না।
তন্বী রাশি সিফন শাড়ি স্লিভলেস ব্লাউজে নিজেকে
সুসজ্জিত করে একগোছা ফুলের তোড়া নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে দিদার কাছে
এলো। রাশিকে দেখে শীর্ণ চেহারার
দিদার মুখ উজ্জ্বল হাসিতে ভরে উঠল। ধীরে সুস্থে তাকে বিছানায় উঠিয়ে বসালো রাশি। কোটরাগত চোখে বিদ্যুৎ
ঝিলিক। রাশি দু'হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো দিদাকে। কিছুক্ষণ পর বাহুমুক্ত হয়ে
চঞ্চল চোখে তাকালো দিদা রাশির দিকে। ক্ষীণ কন্ঠে একটা চুম্বনের আবদার সে রাখলো রাশির কাছে। এ এমন কী নতুন
কথা! এর আগেও রাশি বহুবার দিদার গালে চুমু
খেয়েছে। কিন্তু আজ দিদা নড়বড়ে হাতে রাশিকে
জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে টেনে এনে ক্ষুধার্ত এক চুম্বন এঁকে দিল রাশির ঠোঁটে। কিংকর্তব্যবিমূঢ রাশি অনুভব করল, দিদার শীর্ণ হাত তার উদ্ধত স্তনযুগলের সঙ্গে
খেলা করতে চাইছে। কিন্তু অসময়ের সময় বাধা হয়ে দাঁড়াল। রাশি বিস্মিত গলায় কিছু বলার আগে দিদা বলল, নতুন জন্ম! বলেই তার কোলে ঢলে পড়ল।
বিকেল পাঁচটা। এদিকে তখন নন্দন
চত্বর থেকে রাশির ব্যাগে ক্রমাগত গার্গীর ফোন বেজেই চলেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন