নকল
পদ্মশ্রী সিনেমা
হলের উলটো দিকে বাটার দোকানের গায়ে গাড়ি দাঁড় করালো অরিত্র। জিশানের বিরিয়ানি নিয়ে যেতে বলেছে পায়েল। মা
ছেলে দুজনেই বিরিয়ানির পোকা। এ সময়টাতে
ইভিনিং শো ভাঙে। প্রচন্ড ভিড়। বহুকষ্টে গাড়ি পার্ক করে রাস্তা পেরিয়ে জিশানে ঢুকলো। সেখানেও লম্বা লাইন। মিনিট
কুড়ি লেগে গেল। টাকা দিয়ে খাবারের প্যাকেট নিয়ে বেরোতেই ধাক্কা। লোকটাকে কিছু বলার
আগেই দেখল কাঁচা পাকা দাড়ি, ময়লা পাজামা পাঞ্জাবী উদাসীন এক মধ্যবয়সী। চোখে ঘোলাটে
চশমা। চেহারায় চূড়ান্ত দারিদ্রতার ছাপ। থমকে গেল অরিত্র। অরুণাংশু!
যাদবপুর বয়েজ-এর
ক্লাস ‘এইট-বি’ ঘরে কোনো এক মধ্যদুপুরে টিফিন খেতে খেতে দেবমাল্য, অরুণাংশু, আকাশ আর অরিত্র নামের চার
কিশোর প্রতিজ্ঞা করেছিল, ইহজীবনে তারা
তাদের বন্ধুত্ব ছিন্ন করবে না। সকলেই নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের। স্বপ্ন দেখত, বড় হয়ে বাড়ি গাড়ি হাঁকাবে। সাহিত্যভক্ত মেধাবী অরুণাংশু
স্বপ্ন দেখত মানুষ হবার। চিররুগ্ন মায়ের
ভালো চিকিৎসা করার। এইট-নাইন-টেন তিন বছরে তাদের বন্ধুত্বের সুঘ্রাণ সারা স্কুলে
ছড়িয়ে পড়েছিল।
কিন্তু কী যে হলো!
মাধ্যমিকের ইতিহাস পরীক্ষার দিন নকল করতে গিয়ে ধরা পরে গেল অরুণাংশু। সাহিত্য পাগল হলেও ইতিহাসে ওর খুব
আগ্রহ ছিল। এ হেন ছাত্র এমনটা করতে পারে,
কেউ ভাবে নি। সব পরীক্ষা বাতিল হয়ে গেল অরুণাংশুর।
এরপর যা হয়, শীতের
শেষের শুকনো পাতার ঝরে পড়ার মতো ঝরে গেল দেবমাল্য, আকাশ ও অরিত্র নামের পাতারা। তাদের জায়গায়
শুভজিৎ, কলাপ, শ্রীদীপ নামের নতুন পাতারা
জন্মালো। জীবন চলে জীবনের মতো। যাদবপুর
ইউনিভারসিটি থেকে নিউক্লিয়র ফিজিক্স নিয়ে
মাস্টার করার পর সরকারী চাকরি পেয়ে গেল অরিত্র। যথাসময়ে বিয়ে ছেলে। সবই গতানুগতিক। চার
কিশোর প্রাণের হাতে হাত রাখা সেই মধ্যদুপুর
সময়ের বালিচাপা হয়ে পড়ে রইল।
তারপর আজ এই দেখা। প্রায় পনের বছর পর
অরুণাংশুকে দেখল অরিত্র। বয়সের থেকে অনেক
বেশি বুড়িয়ে যাওয়া অরুণাংশু। কিন্তু মুখের সেই হাসি আজও অমলিন।
- কেমন আছিস? প্রথম
কথা বলল অরুণাংশুই।
- ভালো। তুই? কথা বলতে
কষ্ট হচ্ছিল অরিত্রর। কী এক বেদনা মিশ্রিত অনুভূতি তার গলার কাছে দলা পাকিয়ে
উঠছিল। অরুণাংশুকে দেখেই বুঝেছে, সে জীবনে চূড়ান্ত অসফল। হাতে ধরা খাবারের
প্যাকেট, গাড়ির চাবি, উচ্চমধ্যবিত্তের ছাপে নিজেকে ওর পাশে দেখে গুটিয়ে যাচ্ছিল
ক্রমশঃ।
- চলে যাচ্ছে রে!
বাকিদের খবর সব ভালো? আমার তো এই দেখছিস। একটা বড় রকমারী দোকানে হিসেব লেখার কাজ করি। তবে সেই
যে কবিতা লেখার পাগলামি ছিল, সেটা রয়েই গেছে জানিস! তবে এখন চাল ডালের হিসেবটাই বেশি করি। বলে হো হো করে হেসে উঠল।
সেই হাসি। মরমে মরে
যাচ্ছিল অরিত্র। অরুণাংশু যত বলছিল, ও তত মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। অরিত্র বলতে চাইল থাম!
ওরে থাম! আর বলিস না! অরুণাংশু তখনও বলে চলেছে -
- বুঝলি, সেই ঘটনার পর
বাবা তো আর পড়াল না। আমার সঙ্গে বহু বছর ঠিক করে কথা পর্যন্ত বলে নি। আমি তার
কুলাঙ্গার ছেলে। মায়ের অসুখের কথা মনে আছে তোর? মাও বেশিদিন ছিল না তারপর। মায়ের
চিকিৎসা, দিদির বিয়ে দিয়ে বাবার হাত ফাঁকা।
ছোট বোনটার লেখাপড়া বিয়ে বাকি। তখন থেকেই কাজ করছি। খেয়ে পড়ে বাঁচতে তো হবে। আগে
একটা ছোট দোকানে ছিলাম। এখন দোকানটা বড়, মাইনেটাও বেশি। যাক গে, বাদ দে
আমার কথা, তোর কথা বল। দেখে তো মনে হচ্ছে ভালোই আছিস।
লজ্জায় মরে গেল
অরিত্র। বলল -
- হ্যাঁ, ওই আর কী।
যাই রে, অনেকক্ষণ হয়েছে গাড়িটা নো-পার্কিংএ রেখে এসেছি। পুলিশ তুলে নিয়ে গেলে
ঝামেলায় পড়ে যাব।
কোনরকমে পালিয়ে এলো
অরিত্র। গাড়িতে বসে স্টার্ট দেবার আগে একবার পিছন ফিরে তাকাল। জীবনের ভারে নুয়ে পড়া রুগ্ন
মলিন পাজামা পাঞ্জাবী ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু মাথাটা তার ভিড় ছাড়িয়ে অনেক
উঁচুতে। ওর নাগালের বাইরে। অরিত্র চোখের সামনে তখন স্পষ্ট এক দুপুর। পাশাপাশি বসা
দুই পরীক্ষার্থী। একজন ধরা পড়ার ভয়ে নকলের কাগজ ফেলে দিচ্ছে পাশের বেঞ্চে বসে থাকা তার প্রিয়তম বন্ধুর দিকে। আর হতবাক
বন্ধুটি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন