রবিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৫

তমাল রায়

রেলচরিত

চলন্ত ট্রেনে জন্ম আমার। মামা বাড়ির দাদু নাম রেখেছিল এক্সপ্রেস। কেন রেখেছিল? ট্রেন চলছে, খুউব জোর, আমার গর্ভবতী মা তার দুর্বল স্বামীকে ফেলে যাবে না কিছুতেই, শেষে দাদু এলেন নিয়ে যেতে, আর না করতে পারেনি মা, তাই বাধ্য হয়েই। মুখ গম্ভীর। ট্রেন চলছে, কাঁপছে থর থর কামরা। বর্ষা কাল। ঘোর দুর্যোগের রাত। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। মা পারলেন না আর বহন করতে। জন্ম নিলাম আমি। না, আমি কাঁপাতে পারিনি কিছুই। দাদু বেঁচে থাকলে জিজ্ঞেস করতাম, কেন শ্রাবণ নয়! অশ্রুসম্বল এ জীবনের নাম ‘বাদল’ও হতে  পারতট্রেন আসে ট্রেন যায়, আমি বেঁচে থাকি। প্রথম সে শৈশবের কথা মনে আসে কই! কেমন এক ধোঁয়া আর কুয়াশা ভিড় করে থাকে। কেবল মনে পড়ে, মাকে ডাকতাম মা নয়, প্যাসেঞ্জার বলে। মা’র ছিল দুলকি চলন, আর থেকে থেকেই দাঁড়িয়ে পড়ত এখানে সেখানে। আর লোকও তো অনেক। দুলুমামা, কানন মাসী, হাবলুদা, গাবলুদা, কেতোকাকা আর রতনমামা। রতনমামা ছিল মা’র প্রেমিক। কিছুই করত না তেমন, শুধু অপেক্ষা ছাড়া, অপেক্ষা তো বাজারি বিশ্বে কোনো যোগ্যতা নয়, তাই না! তাই মা’র পথ ছেড়ে দিতে হয়েছিল রতন মামাকে বাবাকে ডাকা হতো মেল। মেল ট্রেনের গতি বেশি, ঠাট যমকও। তাই দাদু বিয়ে দিলেন মেল-এর সাথেই। মেলের অবশ্য স্থিরতা কম। তা দাদুর মতো প্রাজ্ঞ লোকও বোঝেনি কেন, কে জানে! মেলের ছিল দৌড়নোর নেশা, আর আনুষঙ্গিকও। এখানে ওখানে অস্থান কুস্থানের ওপর দিয়েই দৌড়তে হতোদৌড়নোর সময় কি অত খেয়াল থাকে! অবিশ্যি তেমন কিছু করতে পারেনি, কেবল রোগ বাঁধিয়ে বসল মারাত্মক। মা তো প্যাসেঞ্জার, সে দাঁড়ায়, ভালো করে লক্ষ্য করে কে আসছে, যাচ্ছে। কাউকে ফেলে যায় না, তাই বাবাকেও তারপর... যা হয়। মেল চলে গেল একদিন হুস করে। সেদিনও খুব বৃষ্টি। মেলের মুখাগ্নি আমি করিনি। মনে পড়ছিল, মেল তার দৌড়নোর নেশায় তার পুত্রকেও কিছু দেয়নি কখনো, কেবল গ্যাস বেলুন ছাড়া। লাল, নীল, সবুজ। রঙ বোঝার আগেই তারা রওয়ানা দিয়েছিল আকাশে। মেলও যেমন আকাশে এখন। মা’র খুব অভিমান হয়েছিল। আর আমার অভিমান হয়েছিল মা’র ওপর। মা কেমন গুমরোতে লাগল একা একাই। নিজের মনেই কথা বলা শুরু করলঅ্যাক্সিডেন্টের ভূত চেপে বসল মাথায় ‘ও বাবা তাকাসনা ও কাটা পড়েছে রেলে। কী রক্ত! উফফ!’ আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। কী করব! ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ওষুধ দিল। মা বিশ্বাসই করে না, তার কিছু হয়েছে। ফলে দু’দিন ভালো থেকে, ওষুধ দিল বন্ধ করে। আবার যে কে সেই। আমার সাথে ততদিনে আলাপ হয়েছে তনিমার। সপ্রতিভ, কথা বলে অনেক। ও রেল নিয়ে একটা ডকুফিচার বানাচ্ছে, তাতে ওর মনে ধরেছে আমার পরিবারকেই। ও আমায় ডাকে এক্সপ্রেস বলেই। আমি ডাকি ওকে মেট্রো। কী সুন্দর তনিমা! কী ঝকঝকে, কী গতি !প্রেমে পড়লাম। ও আমার হাত ধরে বলল - এসো এক্স (ও আদর করে নাম ছোট করেছে) আমরা এক সাথে দৌড়ই। তনিমাকে বোঝালাম অনেক। পাশাপাশি দুটো ট্রেন দৌড়য় ঠিক, কিন্তু সে আর কতক্ষণ! হলোও তাই। মন্ট্রিয়ল- এ ওর ডকু পুরস্কার পেল। আর ও আমায় ভুলে গেল। চিঠি লিখেছিলাম-
মেট্রো তুমি তো গতিশীলা, সুন্দর ঝকঝকে। কিন্তু আমি শ্লথ। অনেক মায়াকে পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। তাই খুব জোরেকী করে যাবো বল? মানে তেমন পরিসর আমায় কেউ কোনোদিন করে দেয়নি। তোমার দৌড়নোর জন্য আলাদা স্থান আছে। কিন্তু জানো, আমি ভালোবাসতে জানি! এসো একবার। কথা আছে। আছে কিছু আলো ও অন্ধকার।

মেট্রো উত্তর করেছিল
এক্সপ্রেস, তুমি তো সেই ৪০ কি মি/আওয়ারে থেমে যাওয়া মানুষ। কী করে তাল মেলাবে নতুন সময়ের সাথে! তোমার বাড়ি গিয়ে দেখে এসেছি প্যাসেঞ্জারকে। তিনি পাগল। কে আর পাগলের ছেলের সাথে থাকে, বল! ওসব রিয়েল পেথস সিনেমায় লাগে। জীবনে ওসব না আসাই ভালোপা্রো তো দৌড়াও জো্রে, হয়তো দেখা হয়ে যাবে।

যদিও আর কথা হয়নি। ক’দিন পর আলাপ হলো লক্ষ্মীর সাথে। ওর নাম দিলাম লোকাল। ও হাত ধরলপানিফল, ঝালমুড়ি, বাদাম, ঝাল লজেন্স, বিয়ে। মা চলে গেল। সেদিন খুব মারপিট, ভাঙচুর আমাদের রেলপট্টি ভাঙতে। পুলিশ পাঠিয়েছিল সরকার বাহাদুর। মা গেছিল তাদের অ্যক্সিডেন্ট্ তত্ত্ব বোঝাতে। ব্যাস। মাথায় লাগল লাঠি। মা চলে গেল। অ্যাক্সিডেন্ট! লোকজন মা’কে শহীদ আখ্যা দিল। সংগ্রামী মানুষের লড়াই-এর সাথী হতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন...
আমাদের সন্তান হলো। নাম দিলাম টয়ট্রেন। লক্ষ্মীর যা অপূর্ণ সাধ, সে ওর মধ্যেই মেটাতে চায়। ও টয় সোনাকে নিয়ে চললো পাহাড়ে। উঁচুতে উঠতে হবে তো!
কেটে যাচ্ছিল দিন। আমার গতি আর ওর পছন্দ নয়। সেই আগের লোকাল আর আছে না’কি! ডি এম ইউ থেকে ই এম ইউ হয়েছে। ততদিনে লোকালের স্পীডও তো বেড়ে গেছে অনেক। আমার মতো ধীর গতির লোককে কার আর ভালো লাগবে! ন্যাগিং, মেলানকলিক যখন তখন বেগড়াই। কিন্তু কী করব বল, আমার তো ইতিহাস আছে, আছে অতীত। কী করে ভুলব তা? ফল যা হবার তা হলো লক্ষ্মী টয়কে নিয়ে আলাদা হলো  আমি ক’দিন মনমরা হয়ে বসে থাকতে চাইলাম। চাইলেই কি সব হয় গো! বলা পাপ চলা কাজ। তাই মুখ বন্ধ করে আবার চলো। চলতে আর ভালো লাগে কই! শরীর খারাপ। বুকে একটা ব্যথা গুণ গুণ করে বাজে। সরকার বাহাদুর আমাদের ফেলে দিলেন না পুরনো বা বাতিল বলে। নতুন ইঞ্জিন লাগিয়ে করে দিল সুপারফাস্ট শতাব্দী বা রাজধানী বলে ভেবো না। ওরা জাতে কুলীন। আমাদের বলে পুরনো শরীর। নতুন ইঞ্জিন জুড়লেই হবে!   

আমার ইতিমধ্যে বাইপাস হয়ে গেছে। অনেক রেস্ট্রিকশন। তবু দৌড়ই। সেও তো এক নেশা। বাপের থেকে উত্তরাধিকার বশে পাওয়া। দু'পাশের গাছপালাগুলো হুস হুস করে পেছনে মিলিয়ে যায়। আমি অবাক হয়ে দেখি। আলো আসে, অন্ধকার বেশি তবু চলি।
সে রাতে ঠিক কি হয়েছিল, জানা নেই সঠিক। পথ চলতে সামনেই তাকানো  দস্তুর। কিন্তু কতটা সামনে তুমি তাকাতে পারো বন্ধু? তোমারও তো সীমাবদ্ধতা আছেই। কেবল মনে আছে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল এক প্যাসেঞ্জার, একই লাইনে। না’কি মা দাঁড়িয়েছিল? চাঁদনি রাত। চারপাশে অদ্ভুত এক মায়া জ্যোৎস্না। হাতছানি দিচ্ছেন মা-  ‘আয় এবার। অনেক হলো’ আর কিছু মনে নেই। অনেক ফ্লাশ বালব জ্বলছিল। বুমগুলো এগিয়ে আসছিল। দেখলাম লক্ষ্মী এসেছে টয়কে নিয়ে। হাসলামওরা আমায় ফেয়ার ওয়েল দিতে এসেছে। আমিও জড়ানো গলায় বললাম, ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন।
আসলে জীবন এক যাত্রাপথ। সে তুমি লোকালই হও বা সুপারফাস্ট। কিছুটা প্যাসেঞ্জার, কিছুটা পুরনো মেল - এ সব নিয়েই তোমার ইতিহাস আর ভূগোল।  তাই চরৈবেতি। আমি ‘এক্সপ্রেস’ রওয়ানা দিলাম এক নতুন স্টেশনের দিকে। সেখানে নিশ্চয়ই অনেক আলো থাকবে, অনেক সুখ, আর মাইলের পর মাইল রেল শেষ রাতে কোনো এক্সপ্রেসের হর্ন যদি শোনো, বুঝো আমিও তোমাদেরই মতো বেঁচে আছি। বলা হলো না স্টেশন, কারশেড, ওভারহেড তার অথবা আরো আরো কত কিছুই। সেগুলো আমার ফ্যামিলি অ্যালবামে পাবে। জলছবির মতো একটা নাম  না জানা স্টেশনের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, কোনো আলো ফোটা সকালে সে আমার কপালে চুমু দিয়ে বলেছিল – ‘আবার এসো’। সেখানে যাবার আমার খুব ইচ্ছে, এবার আসলে ওখানেই...

৩টি মন্তব্য: