রবিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৫

লিপিকা ঘোষ

বিসর্জন

বিসর্জনের ঘট ভেসে যায়, বিসর্জনের ফুল ভেসে যায়। মা ভেসে যায়, ডুবে যায়ঢাকের বোলে বিসর্জন বাজেক’দিন পর কাঠমাটা তুলে নিয়ে যাবে। আবার নতুন খড় বাঁধা হবে, মাটি চাপানো হবে। পুরনো মা সারা বছর ধরে নতুন হবে একটু একটু করে

ট্রেনের ঝাঁকুনি জোর। প্রৌঢ়া একমনে উল বুনছেনশীতের আভাস আসতে শুরু করবে ক’দিন পর থেকেইপ্রৌঢ় একমনে বই পড়ছেন চশমা এঁটেমেয়েটির কানে ইয়ার-প্লাগ গোঁজা, কোলে একটি ছোট সাইজের ল্যাপটপ, তাতে টুক টুক করে কিছু টাইপ করে চলেছেলালগোলা প্যাসেঞ্জারের ফার্স্টক্লাস কম্পার্টমেন্ট। ছোট ছোট খোপ করা ঘর। কোনও খোপে চার জন আঁটে, কোনো খোপে ছয়জনা। নয়জনার কোনো খোপ নেইতেমন দিল-দরিয়া টিকিট চেকার হলে তেঁতুল পাতায় নয়জনার ব্যবস্থা করে দেন বৈকিতিনজনার এই খোপে এখনো একজনার কমতিপ্রৌঢ়া প্রৌঢ় আর মেয়েটি উঠেছে শেয়ালদা থেকেদশমীর বিসর্জনের বাজনা বাজে চারদিকেযে স্টেশনে যখন ট্রেন থামে তখনই শোনা যায়, ‘বলো দুগগা মাঈ কি’! ট্রেনের গতি  বাড়লে বিসর্জনের আওয়াজ মুছে যায়তখন ট্রেনের চাকায় একটাই বোল ‘চল পাহাড়ি, তাড়াতাড়ি’! এটা অবশ্য প্রৌঢ় আর মেয়েটি শুনতে পায়প্রৌঢ়া উলকাঁটা থামিয়ে বলে, তোমাদের যত্তসব, যা ঘর পড়ে গেলবুনুনির ফাঁকে একটু  অমনোযোগি হলে ঘর পড়ে যায়। প্রৌঢ়া সামলাতে ব্যস্ত

ট্রেন থামেস্টেশন থেকে ওঠেন এক সৌম্যদর্শন বয়স্ক। চেকারকে টিকিট দেখানওনার নির্ধারিত খোপ এই তিনজনা যে খোপে আছেন, সেটি। বয়স্ক খোপে ঢোকেন বসেন প্রৌঢ়’র পাশে। প্রৌঢ় বই পড়ছেন, মুখ তোলেন নাঘর পড়ে যাবে ভয়ে প্রৌঢ়া মুখ তোলে নামেয়েটি কিছু ব্যস্ত হয়ে টাইপ করছে, চোখ নিচুসৌম্যদর্শন চুপচাপ বসেন। ওদিক থেকে আওয়াজ আস্‌ ‘বলো দুগগা মাঈ কি’! ট্রেন ছাড়ে। গতি বাড়ে। বিসর্জনের আওয়াজ মুছে যায়‘চল পাহাড়ি, তাড়াতাড়ি’! সৌম্যদর্শন বয়স্কটি  জিজ্ঞেস করেন, আপনারা ফিরছেন, না যাচ্ছেন? ফিরছি, চশমার ফাঁক থেকে   একঝলক থেকে প্রৌঢ়র উত্তর। আমি যাচ্ছিকিছুক্ষণ থেমে, নিমন্ত্রণ করতে, অঘ্রাণ  রেই বড় ছেলের বিয়েবাহ, খুব ভালোসুখী হোক আপনার পুত্র-পুত্রবধূ”! ওরা দুজনেই ডাক্তারছোট থেকে একসঙ্গে খেলাধুলো পড়াশোনা করে বড় হলোএবার চার হাত এক করে দেওয়ার দায়িত্ব আমারদুই ছেলে রেখে ওদের মা সেই আশ্বিনে বিসর্জনের ঘন্টা বাজিয়ে চলে গেলথামেন বয়স্ক মানুষটি। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। মাঠে কাশফুল। সাদায় ঢাকা সবুজ। মেয়েটি মুখ তোলে। সেও বাইরে তাকায়প্রৌঢ়াও উলকাঁটা বোনা বন্ধ রেখে বাইরে তাকায়আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজিনা বাজি – মনে পড়ে? বয়স্ক মানুষটি মেয়েটির  দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন। হ্যাঁ ঘা কাত করে মেয়েটি। পড়াশোনা কর? না, একটা চাকরিতে জয়েন করেছি কিছুদিন হলো”বাহ বেশ। আপনাদের বাড়ি কোথায়? আমি যাচ্ছি মন-মাঝি-পুর, বন্ধু আছে। নিমন্ত্রন করতেপ্রৌঢ়ার দিকে  তাকান বয়স্কপ্রৌঢ়া বলেন, ওখানেইতাই না কি? আমার বন্ধুর নাম শান্তিরঞ্জন, আপগারি দপ্তরে ছিল, সহকর্মীআমাদের শান্তিদা নয় তো? প্রৌঢ়া জিজ্ঞেস করে প্রৌঢ়কে। শান্তির কি একছেলে একমেয়ে? ছেলেটি বিদেশ গেল? প্রৌঢ় তাকান বয়স্কর দিকে। হ্যাঁ ঠিক, কী আশ্চর্য, ট্রেনে কীভাবে পরিচিতি বেরিয়ে  আসে!” প্রৌঢ়া ট্রেনের সিটে পা তুলে জাঁকিয়ে বসে, শান্তিদার মেয়ে তো আমারই মেয়ের বয়সী, কিন্তু পড়াশোনায় একেবারে যা তাথাক না মা, মেয়েটি বলে। তুমি থাম টুসি, বড়দের মাঝে কথা বলে না, প্রৌঢ়ার ধমক। তোমার নাম টুসি না মৌটুসি? মজা করে জিজ্ঞেস করেন বয়স্ক। না না উজ্জ্বয়িনীবাহ ভারি ভালো নাম তো! বয়ফ্রেন্ড আছে? আজকাল সকলেরই তো থাকে!” না না, টুসির ওসব কিছু নেই, প্রৌঢ়া তড়িঘড়ি। আছে না কি রে? চশমার ফাঁক দিয়ে তাকান প্রৌঢ়। বাবা তুমিও? আহা ঐ ফেসবুক টুক থেকে হয় তো শুনি, তোর আবার  সেসব হলো কি না’!” মেয়েটি খুব রাগ করে মুখ ফেরায়। ট্রেনের জা্নালা দিয়ে দূরে তাকায়তারপর মুখ নিচু করে ল্যাপটপে টাইপে মন দেবয়স্ক মানুষটি হা হা করে হেসে ওঠেন, যা বলেছেনআমি ভাবছিলাম আমার ছোট ছেলেটির জন্য, ওটিরও তো গতি করতে হবে আপনাদের সঙ্গে পরিচিতি যখন বেরিয়ে পড়লপ্রৌঢ়ার  উলকাঁটা বোনা একেবারে বন্ধপ্রৌঢ় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলেন, শুনছিস রে? চল পাহাড়ি, তাড়াতাড়ি!” বাবা তুমিও? মেয়েটির নেহাতই করু অবস্থা

প্রৌঢ়র পকেটে মোবাইলে রিং বাজে। ট্রেনটি কোনও স্টেশনের কাছাকাছি আসছে বোধ হয়। তাই মোবাইল-এ টাওয়ার এলোবয়স্ক ফোন ধরেন, হ্যাঁ রে অনি বল, এই তোদের কথাই হচ্ছিল, বুঝলি!” ওপ্রান্ত থেকে অচেনা গলা, আপনি কি অনির্বা দত্তর বাবা? হ্যাঁ, আপনি কে? অনির মোবাইল আপনার কাছে কেন? অনি কি মোবাইলটা হারিয়েছে?” আপনি যেখানেই থাকুন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরুন তারপর ডেডবডি সনাক্ত করতে হবেআপনার ছোট ছেলেকেও ফোন করেছি, সে পুনেতে। আমরা থানার লোক, পুলিশকিন্তু কার কী হয়েছে? অনি কোথায়? প্রতিমা বিসর্জনের সময় কিছু বদমাশ একটি মেয়েকে উত্যক্ত করছিল  অশ্লীল ভাবে। আপনার ছেলের চোখে পড়ে। মেয়েটিকে বাঁচাতে যায়। বদমাশগুলো গুলি করে পালায়, আপনার ছেলে সঙ্গে সঙ্গে শেষ 

ট্রেন থামে একটি স্টেশনে। অনি নেই, অনিকে গুলি করে মেরে ফেলেছে, আমাকে ফিরতে হবে, তিনজনকে বলেন বয়স্ক মানুষটিসৌম্যদর্শন বয়স্ক মানুষটি নেমে যান ট্রেন থেকেবাইরে থেকে ভেসে আসে ‘দুগগা মাঈ কি, জয়’! ট্রেন চলতে শুরু করে। প্রৌঢ়র বইয়ের পাতা বাতাসে উল্টে যায়। প্রৌঢ়ার উলকাঁটার ঘর পড়ে যায়,   মেয়েটি তাকিয়ে থাকে ট্রেনের জানালা দিয়ে, দূরে



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন