বিসর্জন
বিসর্জনের ঘট ভেসে যায়, বিসর্জনের ফুল ভেসে যায়।
মা ভেসে যায়, ডুবে যায়। ঢাকের বোলে বিসর্জন
বাজে। ক’দিন পর কাঠমাটা
তুলে নিয়ে যাবে। আবার নতুন খড় বাঁধা হবে, মাটি চাপানো হবে। পুরনো মা সারা বছর ধরে
নতুন হবে একটু একটু করে।
ট্রেনের ঝাঁকুনি জোর। প্রৌঢ়া একমনে উল বুনছেন। শীতের আভাস আসতে
শুরু করবে ক’দিন পর থেকেই। প্রৌঢ় একমনে বই পড়ছেন চশমা এঁটে। মেয়েটির কানে
ইয়ার-প্লাগ গোঁজা, কোলে একটি ছোট সাইজের ল্যাপটপ, তাতে টুক টুক করে
কিছু টাইপ করে চলেছে। লালগোলা
প্যাসেঞ্জারের ফার্স্টক্লাস কম্পার্টমেন্ট। ছোট ছোট খোপ করা ঘর। কোনও খোপে চার জন
আঁটে, কোনো খোপে ছয়জনা। নয়জনার কোনো খোপ নেই। তেমন দিল-দরিয়া
টিকিট চেকার হলে তেঁতুল পাতায় নয়জনার ব্যবস্থা করে দেন বৈকি। তিনজনার এই খোপে
এখনো একজনার কমতি। প্রৌঢ়া প্রৌঢ় আর
মেয়েটি উঠেছে শেয়ালদা থেকে। দশমীর বিসর্জনের বাজনা বাজে চারদিকে। যে স্টেশনে যখন
ট্রেন থামে তখনই শোনা যায়, ‘বলো দুগগা মাঈ কি’! ট্রেনের গতি বাড়লে বিসর্জনের আওয়াজ মুছে যায়। তখন ট্রেনের চাকায়
একটাই বোল ‘চল পাহাড়ি, তাড়াতাড়ি’! এটা অবশ্য প্রৌঢ় আর মেয়েটি
শুনতে পায়। প্রৌঢ়া উলকাঁটা
থামিয়ে বলে, “তোমাদের যত্তসব, যাহ ঘর পড়ে গেল”। বুনুনির ফাঁকে একটু অমনোযোগি হলে ঘর পড়ে যায়। প্রৌঢ়া সামলাতে ব্যস্ত।
ট্রেন থামে। স্টেশন থেকে ওঠেন এক
সৌম্যদর্শন বয়স্ক। চেকারকে টিকিট দেখান। ওনার নির্ধারিত খোপ এই তিনজনা যে খোপে আছেন, সেটি। বয়স্ক খোপে
ঢোকেন। বসেন প্রৌঢ়’র পাশে।
প্রৌঢ় বই পড়ছেন, মুখ তোলেন না। ঘর পড়ে যাবে ভয়ে প্রৌঢ়া মুখ তোলে না। মেয়েটি কিছু ব্যস্ত
হয়ে টাইপ করছে, চোখ নিচু। সৌম্যদর্শন চুপচাপ
বসেন। ওদিক থেকে আওয়াজ আস্ ‘বলো দুগগা মাঈ কি’! ট্রেন ছাড়ে। গতি
বাড়ে। বিসর্জনের আওয়াজ মুছে যায়। ‘চল পাহাড়ি, তাড়াতাড়ি’! সৌম্যদর্শন বয়স্কটি জিজ্ঞেস করেন, “আপনারা ফিরছেন, না যাচ্ছেন?” “ফিরছি”, চশমার ফাঁক থেকে একঝলক থেকে প্রৌঢ়র উত্তর। “আমি যাচ্ছি”। কিছুক্ষণ থেমে, “নিমন্ত্রণ করতে,
অঘ্রাণ পরেই বড় ছেলের বিয়ে”। “বাহ, খুব ভালো। সুখী হোক আপনার
পুত্র-পুত্রবধূ”! “ওরা দুজনেই ডাক্তার। ছোট থেকে একসঙ্গে
খেলাধুলো পড়াশোনা করে বড় হলো। এবার চার হাত এক করে
দেওয়ার দায়িত্ব আমার। দুই ছেলে রেখে ওদের
মা সেই আশ্বিনে বিসর্জনের ঘন্টা বাজিয়ে চলে গেল”। থামেন বয়স্ক
মানুষটি। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। মাঠে
কাশফুল। সাদায় ঢাকা সবুজ। মেয়েটি মুখ তোলে। সেও বাইরে তাকায়। প্রৌঢ়াও উলকাঁটা
বোনা বন্ধ রেখে বাইরে তাকায়। “আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজিনা বাজি – মনে পড়ে?” বয়স্ক মানুষটি
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস
করেন। “হ্যাঁ”। ঘাড় কাত করে মেয়েটি। “পড়াশোনা কর?” “না, একটা চাকরিতে জয়েন
করেছি কিছুদিন হলো”। “বাহ বেশ। আপনাদের বাড়ি কোথায়? আমি যাচ্ছি
মন-মাঝি-পুর, বন্ধু আছে। নিমন্ত্রন করতে”। প্রৌঢ়ার দিকে তাকান বয়স্ক। প্রৌঢ়া বলেন, “ওখানেই”। “তাই না কি? আমার
বন্ধুর নাম শান্তিরঞ্জন, আপগারি দপ্তরে ছিল, সহকর্মী”। “আমাদের শান্তিদা নয় তো?” প্রৌঢ়া জিজ্ঞেস করে
প্রৌঢ়কে। “শান্তির কি একছেলে একমেয়ে? ছেলেটি বিদেশ গেল?” প্রৌঢ় তাকান বয়স্কর
দিকে। “হ্যাঁ ঠিক, কী আশ্চর্য, ট্রেনে কীভাবে পরিচিতি বেরিয়ে
আসে!” প্রৌঢ়া ট্রেনের সিটে
পা তুলে জাঁকিয়ে বসে, “শান্তিদার মেয়ে তো
আমারই মেয়ের বয়সী, কিন্তু পড়াশোনায় একেবারে যা তা”। “থাক না মা”, মেয়েটি বলে। “তুমি থাম টুসি,
বড়দের মাঝে কথা বলে না”, প্রৌঢ়ার ধমক। “তোমার নাম টুসি না
মৌটুসি?” মজা করে জিজ্ঞেস করেন বয়স্ক। “না না উজ্জ্বয়িনী”। “বাহ ভারি ভালো নাম
তো! বয়ফ্রেন্ড আছে? আজকাল সকলেরই তো থাকে!” “না না, টুসির ওসব কিছু নেই”, প্রৌঢ়া তড়িঘড়ি। “আছে না কি রে?” চশমার ফাঁক দিয়ে
তাকান প্রৌঢ়। “বাবা তুমিও?” “আহা ঐ ফেসবুক টুক
থেকে হয় তো শুনি, তোর আবার সেসব হলো কি না’!” মেয়েটি খুব রাগ করে
মুখ ফেরায়। ট্রেনের জা্নালা দিয়ে দূরে তাকায়। তারপর মুখ নিচু করে
ল্যাপটপে টাইপে মন দে। বয়স্ক মানুষটি হা হা
করে হেসে ওঠেন, “যা বলেছেন। আমি ভাবছিলাম আমার
ছোট ছেলেটির জন্য, ওটিরও তো গতি করতে হবে। আপনাদের সঙ্গে পরিচিতি যখন বেরিয়ে পড়ল”। প্রৌঢ়ার উলকাঁটা বোনা একেবারে বন্ধ। প্রৌঢ় মেয়েটির দিকে
তাকিয়ে বলেন, “শুনছিস রে? চল
পাহাড়ি, তাড়াতাড়ি!” “বাবা তুমিও?” মেয়েটির নেহাতই করুণ অবস্থা।
প্রৌঢ়র পকেটে মোবাইলে রিং বাজে। ট্রেনটি কোনও
স্টেশনের কাছাকাছি আসছে বোধ হয়। তাই মোবাইল-এ টাওয়ার এলো। বয়স্ক ফোন ধরেন, “হ্যাঁ রে অনি বল, এই
তোদের কথাই হচ্ছিল, বুঝলি!” ওপ্রান্ত থেকে
অচেনা গলা, “আপনি কি অনির্বাণ দত্তর বাবা?” “হ্যাঁ, আপনি কে?
অনির মোবাইল আপনার কাছে কেন? অনি কি মোবাইলটা হারিয়েছে?” “আপনি যেখানেই থাকুন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরুন। তারপর ডেডবডি সনাক্ত করতে
হবে। আপনার ছোট ছেলেকেও
ফোন করেছি, সে পুনেতে। আমরা থানার লোক, পুলিশ”। “কিন্তু কার কী হয়েছে? অনি কোথায়?” “প্রতিমা বিসর্জনের
সময় কিছু বদমাশ একটি মেয়েকে উত্যক্ত করছিল অশ্লীল ভাবে। আপনার ছেলের চোখে পড়ে। মেয়েটিকে
বাঁচাতে যায়। বদমাশগুলো গুলি করে পালায়, আপনার ছেলে সঙ্গে সঙ্গে শেষ”।
ট্রেন থামে একটি
স্টেশনে। “অনি নেই, অনিকে গুলি করে মেরে ফেলেছে, আমাকে
ফিরতে হবে”, তিনজনকে বলেন বয়স্ক মানুষটি। সৌম্যদর্শন বয়স্ক
মানুষটি নেমে যান ট্রেন থেকে। বাইরে থেকে ভেসে আসে ‘দুগগা মাঈ কি, জয়’! ট্রেন চলতে শুরু
করে। প্রৌঢ়র বইয়ের পাতা বাতাসে উল্টে যায়। প্রৌঢ়ার উলকাঁটার ঘর
পড়ে যায়, মেয়েটি তাকিয়ে থাকে ট্রেনের
জানালা দিয়ে, দূরে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন