রমাকান্ত নামা — চেত অচেত
যদি ফুরফুরে হওয়া ছাড়ে তবে রমাকান্ত কি করবেন? মাঝে মধ্যে এমনি হয়, একলাটি ঘরে বসে থাকলে কোনোদিন হয়তো দুপুর পেরিয়ে আকাশ মেঘলা হয়ে ওঠে আর বৃষ্টি আসার আগেই হওয়া ছেড়ে দেয়। সে ঝোড়ো হাওয়া নয়, বেশ মেজাজি ফুরফুরে হওয়া। রমাকান্তর মাথার কয়েক গাছ চুলও বেশ এলোমেলো উড়তে থাকে।
বয়সকাল অনেক আগেই হারিয়েছেন তিনি। স্ত্রীর বিয়োগ হয়েছে আজ প্রায় বছর পনের হতে চলল। শুরুর দিকে খুব খালি খালি লেগেছে। তার পর ওই লিখতে লিখতে লেখক হয়ে যাবার মতো একলা থাকতে থাকতে তিনি অনেকটা একলাচোরা হয়ে পড়েছেন। আগে স্ত্রী, শৈলবালার কথা অহরহ মনে পড়ে যেত। যখন তখন যেখানে সেখানে একটা খালি খালি ভাব শরীরের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। আজকাল অনেকটা হালকা হয়ে গেছেন তিনি। তবু বছরের কয়েকটা দিন আসে, মন বড় আনচান করে ওঠে - বাগানে শেফালী আর বনে কাশ ফুল ফুটলে, প্যান্ডেলের ঢাকের শব্দ কানে এলে, কিম্বা ওই উদাসী ফুরফুরে হাওয়া বইলে।
- এমন মন মরা হয়ে বসে থাকলে হবে? হঠাৎ ঝিম অবস্থা ভেঙ্গে চমকে উঠলেন রমাকান্ত। কে? কে? কে কথা বলে ওখানে? একদম শৈলবালার গলা যেন! মাঝে মাঝে এমনি হয় - সত্তরের টান! এ সময় নাকি মানুষের স্বর্গ মর্ত্যের মাঝখানের অবস্থান হয়। রমাকান্ত জানেন, ওটা স্বর্গ মর্ত্য হবে না, ওটা হলো ইহলোক পরলোক। এ সময় কিছু কিছু টান সব দিক থেকে পাওয়া যায়। একদিকে পরলোক থেকে স্ত্রীর ডাক যেমন শোনা যেতে পারে, ঠিক তেমনি ইহলোকের প্রকৃতিও তোমাকে ডাক দিয়ে যাবে।
আখির সব কিছুই ছেড়ে চলে যেতে হয়। এই চামড়া মাংস হাড়ের শরীর ছেড়ে চলে যেতে হয়। শরীর হলো গিয়ে মানুষের বেশ - পোশাক। ঠিক এমনি সময় রমাকান্তর ধ্যান ভঙ্গ হলো। তিনি দেখলেন, স্বয়ং সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর নষ্ট প্রেমিকা!
- কী রমাদা, তুমি কিসে এত বিভোর হয়ে থাক? এই সেই শ্যামলী যে কিনা রমাকান্তর সরা জীবনে বলতে গেলে প্যাঁচিয়ে পুঁচিয়ে রয়ে গেছে। একে নিয়ে বেশ কিছু ঘটনা রমাকান্তের জীবনে ঘটেছে। তিনি জানেন এসব সংযোগ। যখনই রমাকান্ত নিজেকে একলাটি অসহায় মনে করেছেন, ঠিক সে সময়টাতেই এসে হাজির হয়েছে তাঁর এই নষ্টনীড়! কিন্তু ওই এক ব্যাপার, মাঝে মধ্যে বাইরের দরজা দিতে তিনি
একদম ভুলে যান। এই কারণে সেদিন যেমন কুকুরকাণ্ড ঘটে গিয়েছিল!
- কি হলো, এতদিন পরে কোত্থেকে? রমাকান্ত প্রশ্ন করলেন।
হাসল শ্যামলী। এখন এই বয়সেও শ্যামলীর গাল ঈষৎ লাল হতে দেখলেন রমাকান্ত। তিনি ভালো করে তাকালেন ওর দিকে। এক বৃদ্ধা, হ্যাঁ বৃদ্ধাই তো, বসয় ষাট পার করেছে। তবে হ্যাঁ, এখনও ফিটফাট রাখা শরীর। মনকে খোলা রাখে ও। লতাপাতার বেড় যথা সময় ছাঁটিয়ে নেয়। উদার উদাস আপনভোলা মহিলা। কাউকে ক্যাত্কুত দিয়ে কিছুই জানান দেয় না।
শ্যামলী বলে
উঠল, চলে এলাম বৃন্দাবন থেকে।
- কেন? কোনো গোসাঁই মেলেনি বুঝি? রমাকান্তর মুখ থেকে ফস করে কথাটা বেরিয়ে গেল।
- কী বলছ রমাদা! বয়স তোমার কত হলো বল তো?
- বয়স কি মানুষের অভ্যাস চলন বলন ধরে রাখতে পারে ?
উত্তরে শ্যামলী কিছুই বলল না, সামান্য হাসল মাত্র। বোধহয় নিজের বয়সের কথা তার মনে পড়ে গেল। অথবা বৃন্দাবনের কোনো বিরহ কথা। রমাকান্ত দেখেছেন, শরীরের চেত বোধ ভোঁতা হয়ে গেলেও মানুষের স্বভাব অভ্যাসের ধরন যায় না। আর তাছাড়া শরীর আর মনের গতি এক প্রকার হয় না। বরং লোকে বলে বুড়োরা নাকি আরও বেশি রসিক হয়। রমাকান্তর বয়সের কমজোরি, আসলে মানসিক দিক থেকে তিনি বুড়িয়ে যান নি। তবে আত্মহনন যখন করা যাবে না, তখন সময় কিল করতে কিছু না কিছু তো করে যেতেই হবে! এমনিতেই একা মানে বোকা, একা মানে বোবা - কাঁহাতক নিজের সঙ্গে নিজের কথা চলতে পারে?
- এই রামদা, আমার কথা শুনছ না তুমি? কী ভাবনায় মত্ত? শ্যামলী রমাকান্তর গায়ে ঠেলা দিয়ে বলে উঠল।
সত্যি, কথাবার্তা বলতে না পেরে তিনি নিজের মধ্যেই চিন্তা করে যান, নিজের সঙ্গেই কথা বলে যান। সেখানে তিনি একলা নন, জীবনের কাজের মানুষগুলিও জুটে যায়। এখন বর্তমানে আছেন তিনি, হ্যাঁ, বল কী বলছ?
- তুমি তো একা থাক, ঝুট ঝামেলা তো কিছু নেই, তবে এত চিন্তা কিসের? শ্যামলী বলে ওঠে।
- একাই তো ভয়ের কারণ!
- মানে? যেন ঠিক অনুধাবন করতে পারল না শ্যামলী, মরে যাবার?
- এটাই তো জীবনের চরম ভয়, যদিও আমরা আপ্রাণ তাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করি। যদিও রবীন্দ্রনাথ এক জাগায় বলেছিলেন, তুঁহু মম শ্যাম সমান!
- হ্যাঁ, এবার তোমায় মানাচ্ছে। এমনি কথা বল, মৃত্যুকে স্বাভাবিক ভেবে নিয়ে জীবনের ভাবনা ভাব। শ্যামলী বলল।
রমাকান্ত বললেন, জীবন চলমান, তাকে সাজিয়ে নেওয়া, কী ভাবে সাজাবে তা নিজের কাছে-
- সব সময় নিজের কাছে থাকে না রমাদা, নিয়তির প্ররোচনা বড় জেনো। আমার জীনটাই দেখো না! দোষগুণ মিলেই তো মানুষ, রমাদা! আমার কামড়ে দেওয়া একটা মানসিক দোষ আমি জানি। জানি এ ব্যাপারে আমি সাইকো—
- এ সব কথা তুলে লাভ কী? তুমি একটু বিশ্রাম কর। আমি বরং স্নান সেরে আসি। আজকাল রমাকান্ত কিছু সময় ধ্যানে বসেন, চেষ্টা করেন ধ্যান ধারণায় মন দিয়ে কিছু সময় ব্যতীত করতে।
- কি ব্যাপার, তুমি তুমি ধর্ম কর্মে মন দিয়েছ নাকি?
- কি করব, জীবন কাটাতে হবে তো! দুঃখকে সব সময় যতটা দূরে সরিয়ে রাখা যায়। তুমি বিশ্রাম কর, আর কথা না বাড়িয়ে রমাকান্ত স্নান করতে বেরিয়ে গেলেন।
স্নান সেরে রমাকান্ত ঠাকুর ঘরে বসে আছেন। পুজোআচ্চা বন্ধ হয়েছে বহুদিন। শৈলবালা মারা যাবার পর থেকে দুঃখে তিনি আর ব্যাপারটা ধরে রাখতে চাননি। আজ আর ধ্যানে মন রাখা যাচ্ছিল না। শ্যামলীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। শ্যামলী, তাঁর জীবনের উপনায়িকা তো বটেই, জীবনের মোড়ে মোড়ে ওর সঙ্গে সাক্ষাত। ওর প্রতি দুর্বলতা আছে রমাকান্তর। অনেক রংবেরঙের ভাবনা একসময় মনে রচিত হয়েছিল। সে রং বেশি দূর চড়ে নি। সেটা অবশ্য শ্যামলীর সাইকো মনের জন্যে। দুর্দান্ত মুহূর্তগুলিতে নায়ককে সে কামড়ে দেয়। এ মানসিক রোগের কারণেই তার বিয়ে টেকেনি, কাউকে ভালোবাসা নিবেদন করতে পারেনি। এও তো এক অভিশপ্ত জীবন!
আজ দুজনেই বৃদ্ধ বৃদ্ধা। আলাদা ভাবে ওদের জীবনগুলি ছন্নছাড়া, খণ্ডাংশ বলা যায়। তবু মন, তাকে ধরে রাখা যায় কৈ! না আজ কিছুই হচ্ছে না। ধ্যান ধারণায় কিছুতেই মন লাগাতে পারছেন না রমাকান্ত। চোখ খুলতেই অবাক হলেন তিনি, শ্যামলী তাঁর একেবারে কাছটিতে বসে তাঁর দিকেই মোহিত নয়নে তাকিয়ে আছে।
- কী হলো? রমাকান্ত মুখ খুললেন।
- তোমায় দেখছি, রমাদা! মানুষ যখন স্থির ভাবে বসে থাকে, তখন তার মধ্যে শুদ্ধশীল এক মানুষের প্রকাশ ঘটে।
- আচ্ছা! আমি তা হলে এখন শুদ্ধ শুচিময়?
- না, এখন আবার তুমি পুরুষাকারে জেগে উঠছ!
রমাকান্ত আর শ্যামলী বড় কাছাকাছি বসে আছে। ওদের পরস্পরের শ্বাস প্রশ্বাস পরস্পরের মুখমণ্ডলে এসে লাগছে। ক্রমশ: বৃদ্ধ বৃদ্ধার শ্বাস মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। একজন আর একজনের দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু তাকিয়ে আছে। এ সময়টুকু গোনার বাইরে। শুধুমাত্র স্তব্ধতা চারদিক ঘিরে আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন