রবিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৫

সুমী সিকানদার

শামুক

এডজাস্ট করার এক দারুন ক্ষমতা আছে আমার
আমি নিজেই বুঝি। কোনো নতুন  জায়গায় বেড়াতে গেছি তো নিজেই যেচে সবার সাথে কথা বলেছি। আবার স্কুলে কোনো নিউ কামার এসেছে তো নিজেই আগ বাড়িয়ে তার পাশে গিয়ে বসেছি। আমার তো জানতে হবে তার নাম কী, তার বাড়ি কোথায়, কয় ভাইবোন এসব না জানলেই নয়। কথার বিলি কেটেই দিন যায় 

সেবার এসএসসি
'র পর প্রথমবারের মতো কক্সবাজার রওনা দিচ্ছি। সাথে মাদারিং (মানে আম্মা) তো আম্মা সুখী মানুষ, ট্রেন চলা মাত্রই ঘুমানো  অভ্যাস, তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি মুখের সামনে কী যেন একটা ম্যাগাজিন ধরে  পড়ছি। ট্রেনের কাজ হচ্ছে ধরে ধরে ঝাঁকানো, সে আমাকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে নিয়ে যাচ্ছে এতে করে হাতের চা লকে গায়ের ওপর নাচতে নাচতে পড়ছে বইয়ের লেখা  থেকে মন জানালা দিয়ে উড়ে দূরে গাছপালা ঘেরা এক ছোট্ট গ্রামের একচালা ঘরের সামনে টিপের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকা খড়ের গাদার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে আমি ট্রেনে আছি, আবার ট্রেনে নেই।

দুচোখ জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলেও তিন নম্বর চোখ আমার সাথেই আছেতাই দিয়ে দিব্যি দেখা যাচ্ছে আমার ঠিক উলটো পাশের কোণার সিটে একজন মনযোগ দিয়ে আমারই মতো মুখের সামনে বই ধরে, আমাকেই দেখছে। আমি ঝট করে দৃষ্টি  সরিয়ে নিলাম কোন্‌ আক্কেলে যে তাকিয়ে ছিলাম, সে তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে। চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে পাশে আম্মার গায়ের উপরে অনেকটা সরে এলাম মা  বেচারা দলামোচড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে তাকে ছেড়ে আবার সোজা হয়ে বসলাম কী আর করবে! বেশি ঝামেলা করলে ইচ্ছামতো শুনিয়ে দেব।

তারপর দু
তিনদিন তুমুল বেড়ালাম। সকালে হিমছড়ি তো বিকেলে ইনানীবিচ পাহাড় ডিঙাতে ডিঙ্গাতে আর জলের মার্কারি রঙ আর রূপের তোড়ে ভাসতে ভাসতে সেই  গভীর চোখের ছেলেটার কথা বেমালুম ভুলে গেছি। হুডখোলা জীপে দাঁড়িয়ে দুরন্ত খোলা হাওয়ায় উড়তে উড়তে আমি তখন শুধু সাগরের আশকারা মাখছি।  

এই করে দিন ফুরিয়ে গেল শেষদিন মন খারাপ বিকেলে শেষবারের মতো পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছি। পা ভর্তি সুন্দরী বালু তারা সবাই একসাথে সরে যায় না,  আমাকে চোখে চোখে রাখে। দু’চোখ সাগরের মতোই টলটল করছে। পাথরগুলোর সাথে কদিন খুব বন্ধুত্ব হয়েছে। তাদের ছুঁয়ে আছি। ফিসফিস করে বলছি, আবার আসব সত্যি’নূড়িপাথরের সাথে হাতে উঠে এসেছে শামুক, কী যে সুন্দর আর শান্ত  সে  ভয়ে নড়ছে না, নাকি ধীরে ধীরে নড়ছে, আমি টের পাচ্ছি না, তাও বুঝতে পারছি না। সে আমার হাতে থেকেও গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। দুহাতে পাথর আর  শামুক  আর সাগর আর ঝিনুকের মালা, আর মালা বিক্রি করতে আসা মিষ্টি মেয়েটা এসব ছেড়ে চলে যাচ্ছি ভেবে  লাগাতার চোখের জল পড়তে লাগলো আমি সামলাতে পারছি না। আমার একা কান্না অভ্যাস। আশে পাশে কেউ নেই আমি মনের সুখে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকি।

হঠাৎ কাউকে দেখে কান্না থেমে গেছে, সেই ছেলেটা না? হ্যা সেই ছেলেটাই তো! দূরে বড় পাথরটার ওপর দাঁড়িয়ে পায়ের আঙ্গুল দিয়ে কী যেন লিখছে। লিখছে না ঢং, খুঁজে খুঁজে ঠিকই আমাকে বের করে ফেলেছে। আমি দ্রুতই সরে গেলাম। ঝাউবন পেছনে ফেলে বালুর ওপর পা মেখে মেখে হোটেলে ফিরলাম। মনে হলো সে অনেক কথা বলতে চাইছিল। কিন্তু আমি চাইলাম না।

পরদিন দুপুরে খেয়েই রওনা দেব তাই আর সৈকতে যাইনি। ঢাকায় ফিরব, রওনা হচ্ছি। ফেরার কোচ পর্যন্ত নেবার জন্য গাড়ি এসেছে। এসময় হোটেলের রিসেপসনিস্ট এসে একটা ম্যাগাজিন আমার হাতে দিলআপনি ফেলে এসেছিলেন, একজন দিয়ে গেলআমি মুহূর্তে বুঝে ফেললাম যা বোঝার। ট্রেনেই ম্যাগটা ফেলে এসেছিলাম। আর সেটা নিয়ে সেই ছেলেটা ঠিকই হোটেল খুঁজে দিয়ে গেছে আচ্ছা মানুষ তো! কে বলেছে তাকে এটা দিয়ে যেতে! হয়তো এটা দিতেই কাল সৈকতে গেছিল
তারপর ঢাকায় ফিরে ভর্তির পড়াশোনা নানা ঝামেলায় ম্যাগাজিনটার কথা ভুলেই  গেছিলাম কিছুদিনের জন্য চাপা পড়ে থাকল সমুদ্র, পাথর, শামুক, ট্রেনের সেই চোখ সব কিছুইআচ্ছা ছেলেটা একটা কথাও বলেনি কেন

গল্পটা এই পর্যন্ত শুনে তুমি চেঁচামেচি শুরু করে দিলে। ‘কোন চিঠি চিরকূট দিয়ে শেষ কোরো না তো! কিচ্ছু বলার দরকার নেই। কথা হয়নি, ব্যাস। এভাবেই শেষ  হোক। গাদাগাদা গল্প এরকম চিঠি দিয়েই শেষ হয়, ধুর!’ বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে   তুমি লেখাটা শুনে রায় দিলে। হাতে চায়ের কাপ আর মুখভর্তি আচারের তেল মাখা মুড়ি। তোমার চোখে ছেলেমানুষী, তুমি অন্য কারো ভালোলাগা শুনতে চাও না। কখনই না। আমি থেমে গেলাম। কিছু বললাম না। এটা কি আসলে কোনো গল্প ছিল? থাক, ধরে নিলাম ম্যাগাজিনে ছেলেটা লিখেছিল বটে, কিন্তু আবার বলপেন  দিয়ে গোল গোল ঘষে ঘষে ঢেকে দিয়েছে। আমি কিছুই পড়তে পারিনি। সে মুখে  কিছু বলেনি, চোখ হয় তো কিছু বলেছে আমি তাকাইনি। শামুকের মতোই তার নিজেকে গোটানো স্বভাব সে ক্ষিপ্রতার সাথে কিশোর বয়সের আনন্দকে, অনন্ত চাহনিকে গুটিয়ে ফেলেছে। আমি আর কখনও তাকে দেখিনি।


1 টি মন্তব্য: