দিনের শেষে
ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ খবরটা এলো। এমনটা হবে জানাই ছিল, তবুও মা’কে জানাতে পারেনি প্রবাল।
ডাক্তারবাবু বেশ কিছুদিন ধরেই আগাম বলে রেখেছিলেন, আর ধরে রাখা সম্ভব না। মা’কে মানসিক ভাবে তৈরি রাখার
কথাও বলেছিলেন। তাও মা’কে জানাতে পারেনি। এখন তো
জানাতেই হবে! ফোনটা নামিয়ে বাবা-মায়ের ঘরের দিকে এগোলো প্রবাল।
মায়ের শরীরটাও ইদানিং ভালো যাচ্ছে না। সুগার বেড়েছে, প্রেসারটাও ওপরের দিকেই
থাকছে। রিনি বকাবকি করে মা’কে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছে না, নিয়ম করে ওষুধ খাচ্ছে না। এসব কিছুই না! রিনি কতটুকু দেখেছে! প্রবাল তো জানে মায়ের জীবনে বাবা কতখানি। ছোট থেকে দেখছে বাবা তার অফিস, ক্লাব,
বন্ধু নিয়ে হুল্লোড় করে বেড়াচ্ছেন আর মা ঘর সামলাচ্ছে, বাবাকে সামলাচ্ছে। মাঝে
মাঝেই বাবা উধাও। আগে থেকে না জানিয়ে অফিস থেকেই চলে গেছেন কতবার। জঙ্গলে, পাহাড়ে, সমুদ্রে বন্ধুদের সঙ্গে। তখন তো ফোন ছিল না, অফিসের
পিওনকে পাঠিয়ে দিতেন জামাকাপড় নিতে, সঙ্গে খবরটাও পাঠাতেন। মা রাগারগি করত, আবার ব্যাগ গুছিয়ে পাঠিয়েও দিত। বাবার পছন্দ মা’র মুখস্থ ছিল। ফিরে এসে
বাবা মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়াতেন। দু’ চারদিন মা অন্তপ্রাণ। আড্ডা ক্লাব সব বন্ধ, মার পিছন পিছন ঘুর-ঘুর করছেন। তারপর আবার
যে কে সেই। মা’ও বাবাকে হাসি মুখে যেতে দিত। বলত - তোমাকে ঘরে মানায় না। মা যতদিন রান্না করেছে, বাবার পছন্দের খাবার বানিয়েছে। শরীর খারাপ হবার পর থেকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সীতাকে দিয়ে বাবার পছন্দের
দু’ একটা পদ বানাতো। ইদানিং আর পারছিল না। রিনিকে বলে দিয়েছিল, রোজ রান্নার আগে যেন
বাবাকে জিজ্ঞেসা করে নেয় কী খাবে। মাঝে মাঝে প্রবাল রাগ করত। সব সময়
শুধু বাবা আর বাবা, তোর বাবা এটা পছন্দ করে, ওটা করে না। বাড়িতে ওই একটি মানুষেরই
প্রবল অস্তিত্ব, বাকি লোকেরা শুধু যেন তার ছায়া!
রিনি এসেও এ নিয়ে গোপনে হাসাহাসি করেছে। মা বাবাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে। বাবার
কোনো ভুল চোখেই দেখে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। রিটায়ার করার মাস দুইয়ের মাথায় প্রচন্ড জ্বর নিয়ে বাবা বাজারে গেলেন। এই
একটা ব্যাপার, বাজারটা বাবা কারো হাতে ছাড়েন নি। প্রবালের স্কুল, ডাক্তার-বদ্যি, ব্যাঙ্কের হিসাব, আত্মীয়- স্বজনের দেনা-পাওনা,
সংসারের যাবতীয় কাজ মায়ের ভাগে। শুধু বাজারটা বাবার। খেতে ভালোবাসতেন খুব। সেদিন বাজারে গিয়ে আর ফিরলেন না। মা
আর প্রবাল অভ্যস্ত। রিনি তখন নতুন। ও ছটফট করছে। জ্বর নিয়ে গেছেন বলে মা একবার বললেন বটে, এই যা! রিনি একটু অবাকই হয়েছিল। দুপুর তিনটে নাগাদ ফোন এলো, তিনি পুরুলিয়াতে গেছেন প্রশান্তকাকু আর তাঁর ক্লাবের কয়েকজনের সঙ্গে। রিনি তো রাগে ফেটে পড়ল। মায়ের সদা হাস্যময় মুখ।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করল প্রবাল। জানাতে তো হবেই। ঢুকে দেখল মা এত সকালেও জানালার পাশের চেয়ারটাতে বসে আছে। মুখোমুখি
চেয়ারটাতে বসার লোক আর নেই।
- কখন উঠেছ?
- অনেকক্ষণ, হসপিটালের ফোন ছিল?
- ও! তুমি শুনতে পেয়েছ?
- কী খবর? সব শেষ?
- না মানে, ডাক্তারকাকু
সবাইকে নিয়ে একবার যেতে বললেন।
- তোরা যা, আমি আর যাব না।
কথা তো আর বলবে না। দেখে কী করব?
একটু অবাকই হলো প্রবাল। অনেকদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখেছে, মা কাঁদছে। বাবাকে ছেড়ে থাকতে মায়ের কত কষ্ট হতো, প্রবাল ছাড়া বেশি কে জানে! শরীরটা বোধহয় খুবই খারাপ
লাগছে। এবার বাবা হসপিটালে যাবার পর মা একদিনই গিয়েছিল। তাও বাবা ডেকেছিল বলে।
শরীর দ্রুত ভাঙছে। এ নিয়ে এখন আর কিছু বলল না। মাকে একা থাকতে দেওয়াই ভালো।
মা উঠলেন। ধীরে সুস্থে
কাচের আলমারি থেকে বাবার ডায়েরি বের করে তার থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে প্রবালের হাতে দিয়ে
বললেন-
- এই ঠিকানায় একটা খবর দিও।
ফোন নম্বরও আছে। শেষ দেখাটা দেখে যাক।
- কাদের ঠিকানা?
- সে বলতে পারব না। তোমার
বাবা অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর কিছু হলে এই ঠিকানায় যেন খবর দেওয়া হয়।
- ও! বাবার কোনো কাছের বন্ধু
হবে তাহলে। ঠিক আছে। কাল পরশু ফোন করে দেব। না হয় কাউকে পাঠিয়ে দেব।
- না, আজই, এখুনি খবর দাও। ওই
ফোন নম্বরে ফোন করে হসপিটালে আসতে বল। ওদের তো অশৌচ পালন করতে হবে!
প্রবাল আকাশ থেকে পড়ল। এ কী বলছে মা! কোথাকার কে, বাবার মৃত্যুতে তারা অশৌচ পালন করবে কেন? বাবার না থাকার শোকে মায়ের বোধ কাজ করছে না। চুপচাপ বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। বাবার বন্ধুদের,
আত্মীয় স্বজনদের খবর দিয়ে সাতটা নাগাদ
হসপিটালে গেল বাবাকে নিয়ে আসতে। রিনিকে বলে গেল মার দিকে একটু বিশেষ নজর রাখতে।
একটু পরেই লোকজনের আসা শুরু হলো। রিনি অবাক হলো। তার শ্বশুর মশাইকে এত লোক এত ভালোবাসত। ওরকম একটা বাউন্ডুলে
মানুষ এত লোকের এত উপকার করেছেন। এখন বুঝতে পারছে, মা বাবাকে কেন এত ভালোবাসেন। লোকজনের ভিড়ে মায়ের কথা ভুলেই
গিয়েছিল। ঘরে উঁকি মেরে দেখল, আকাশের দিকে তাকিয়ে একমনে কী যেন ভাবছেন। একটু যদি
কাঁদতেন!
- মা! সবাই আপনার খোঁজ করছেন।
বাইরে আসবেন একটু?
- আমাকে একা থাকতে দাও রিনা।
- আচ্ছা বেশ। একটু সরবত করে দেব? খাবেন? ওষুধ খেতে হবে তো!
- দাও। কটা বাজল? সীতা রান্না
করতে আসে নি?
- হ্যাঁ এসেছে। কিন্তু এ
অবস্থায় কী করবে বুঝতে পারছে না।
- চল আমি যাচ্ছি।
রিনা দেখল ধীরে সুস্থে সকলের সঙ্গে কথা বলে মা
রান্নাঘরে গেলেন। সীতাকে বললেন - ফ্রিজে চিংড়ি মাছ আছে, ওল দিয়ে রান্না কর।
বুবুনের জন্য রুইমাছ ভেজে দেবে, ডাল দিয়ে খাবে। চচ্চড়ি কর।
ব্যাস এখন আর কিছু করতে হবে না। দাদার ফিরতে
সন্ধ্যে হয়ে যাবে। মাংসটা রাতে করে দিও। তারপর রিনাকে ডেকে বললেনঃ
- রতনকে দিয়ে দই মিষ্টি আনাও। এঁরা সব এসেছেন। দইয়ের শরবত আর মিষ্টি দাও সকলকে। আমাকেও দিও।
বসার ঘর থেকে কাগজটা নিয়ে তিনি বুবুনকে ডাকলেনঃ
- বুবুনসোনা! আটটা বেজে গেছে। এখন তোমার পড়ার
সময় না! চল তুমিও পড়বে আমিও পড়ব।
রিনা সীতা বাকি সকলে হাঁ করে দেখল নাতির হাত ধরে ঠাকুমা ঘরের
দিকে যাচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন