প্রবাহ ৪
স্টেজ। পরবর্তী প্রতিযোগীর নাম ঘোষণা করল সুকণ্ঠী সুমিত্রা। সুমিত্রা পরমেশ্বরের এখনকার প্রিয় বান্ধবীদের মধ্যে একজন। বহু প্রিয়
বান্ধবী। কে যে কখন বেশি
প্রিয় তা একমাত্র পরমেশ্বরই জানে। সুমিত্রা সুন্দর
ভাবে স্টেজ পরিচালনা করে চলেছে। এক একজন করে প্রতিযোগী
আসছে, নিজেদের পছন্দের কোনো সুর বাজাচ্ছে বা গেয়ে শোনাচ্ছে, তারপর
বিচারকদের পছন্দ অনুযায়ী আর একটি। এখনও পর্যন্ত একটিও মেয়ে প্রতিযোগীর দেখা নেই। সবাই কম বয়েসি ছেলে। পরমেশ্বর কি একজনও মেয়ে প্রতিযোগীকে অংশগ্রহণ করতে ডাকে নি! অসংখ্য অ্যালবাম জমা পড়েছিল, পরমেশ্বর নিজে
বাছাই করেছে। এটা ঠিক কোনো
প্রথাগত প্রতিযোগিতা নয়। ফিল্মে মিউজিসিয়ন চাই, নতুন হাত চাই। নতুন ধরনের অডিশনের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। হল ভাড়া করে, টিকিট ছাপিয়ে, প্রতিযোগিতার
আহ্বান করে। ‘এসবের যে কী মানে!’ মনে মনে গজরায়
পরমশ্বরের ক্যামেরাম্যান, বহু পুরনো সাথী সন্দীপদা। ‘পরমেশ্বরের তো দেখা নেই, এই রাজসূয় যজ্ঞ বাঁধিয়ে দিয়ে সে কোথায়, জানো কি কেউ?’ সন্দীপদা টীমের
ছেলেদের জিজ্ঞেস করে। সবাই মাথা নাড়ে, এ ওর দিকে তাকায়। ‘ফোন বেজে যাচ্ছে, ধরছেন না’, বলল একটি ছেলে। ‘এভাবেই নায়িকাদের
অডিশনের আয়োজন হবে না কি? সব্বোনাশ!’ মনে মনে ভাবে সন্দীপদা। দু’দিন ধরে মিউজিসিয়নের অডিশন
চলবে। প্রথম দিন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং ভারতীয় লোকসঙ্গীতের উপর নির্ভর করে। দ্বিতীয় দিন পুরোপুরি পাশ্চাত্য সঙ্গীত। স্টেজ-এ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র রাখা আছে, সঙ্গতশিল্পীরা প্রস্তুত। সুমিত্রা একের পর এক অনুষ্ঠান প্রদর্শনকারীকে উপস্থাপন করছে। দর্শক আসনও প্রায় পরিপূর্ণ। একটা সফল অনুষ্ঠান চলছে বলা যায়। আবার প্রতিযোগিতাসুলভ টানটান
উত্তেজনাও আছে। শুধু
পরমেশ্বরের উপস্থিতি নেই।
‘পরবর্তী পরিবেশক আর্য
উপাধ্যায়’ - সুমিত্রা ঘোষণা করে। একটি ছেলে ধীরে সুস্থে স্টেজে আসে। চোখ মুখে অসম্ভব উজ্জ্বল এক দীপ্তি। ছেলেটির সঙ্গে একজন সহযোগী রুদ্রবীণা বয়ে
নিয়ে এসে ছেলেটিকে দিয়ে যায়। স্টেজে নির্দিষ্ট জায়গায় উপবেশন
করে আর্য উপাধ্যায়। আজকের এই অনুষ্ঠান তথা প্রতিযোগিতায় কেউ রুদ্রবীণা বাজাতে
চাইবে, এটা উদ্যোক্তা বা বিচারকদের
মধ্যে কেউই আশা করেনি। বিচারকদের মধ্যে একটু চাঞ্চল্য। তাঁদের মধ্যে থেকে ব্যান্ডমাস্টার যীশু দত্ত কিছু বলতে
যাচ্ছিলেন ছেলেটিকে। প্রবীণ গায়ক
অমিত চট্টরাজ ইশারা করে থামিয়ে দিলেন। আর্য উপাধ্যায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাজাও তোমার রুদ্রবীণা হে নবীন!’
আর্য করজোড়ে নমস্কার জানায় বিচারক মন্ডলীকে।
নমস্কার জানায় সঙ্গত শিল্পীদের। নমস্কার জানায় সামনের দর্শকদের। গুরুকে স্মরণ করে
তুলে নেয় রুদ্রবীণা। রাগ ‘ইমন’।
সন্দীপদা সহ টীমের সকলেই প্রায় অত্যন্ত অসহিষ্ণু
হয়ে পড়েছে। আর্য উপাধ্যায়ের পর মাত্র কয়েকজন প্রতিযোগী
অবশিষ্ট। সুমিত্রাও
অত্যন্ত অস্বস্তিতে। কেউ না কেউ এসে
ওকে জিজ্ঞেস করছে, পরমেশ্বর কোথায়? কখন আসবে? ও আদৌ জানে না
পরমেশ্বর কোথায়। সেই সকালে
একবার ফোনে কথা হয়েছে। অনুষ্ঠান
পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ে। তারপর
নির্দিষ্ট সময়ে সুমিত্রা হল-এ পৌঁছে গেছে। পরমেশ্বরের হদিশ ও জানে না।
আর্য উপাধ্যায়, এক নবীন মগ্ন
তাপস যেন। স্বর্গলোক থেকে
শাপভ্রষ্ট গন্ধর্ব যেন। তার রুদ্রবীণায় উঠেছে ঝংকার। সুরের মূর্ছনায় ভেসে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন হচ্ছে উপস্থিত সকলে।
বাজছে ইমন। বিলম্বিত বন্দীশ।
রাগ ইমন পরমেশ্বরের বড় প্রিয়। পরমেশ্বরের মিউজিক-এর তালিম
পাশ্চাত্য সঙ্গীতে। ভারতীয় শাস্ত্র
সঙ্গীতে প্রথাগত তালিম নেই। কিন্তু প্রতিটি
রাগের চলন গতিবিধি পরমেশ্বরের স্নায়ুতন্তুতে। পরমেশ্বরের দাদামশায়ের বড় প্রিয় রাগ ছিল ইমন। পরমেশ্বর তার
দাদামশায়-এর ধাঁচে গড়া। তার পছন্দ
অপছন্দ, প্রিয় অপ্রিয় সব বিষয়েই বড় বেশি রকম দাদামশায়ের ছায়াপাত। আর্য উপাধ্যায় একমনে বাজিয়ে চলেছে তার রুদ্রবীণা।
পরমেশ্বরের বড় প্রিয় রাগ। কিন্তু পরমেশ্বর কোথায়?
সূর্যকান্ত সেন, বৃদ্ধ মানুষ।
পক্ক কেশ, দীর্ঘ দেহ, ঈষৎ নুয়ে পড়া। বয়সের ভার। কলকাতা থেকে কিছুটা দূরে একা থাকেন নির্জনে। দেখভাল করার
জন্য রমেন আছে। দীর্ঘদিনের অনুগত। এখন সে সূর্যকান্ত
সেনের একান্ত বন্ধু। আরেকজন মাত্র বন্ধু আছে তাঁর। ছেলেটি আজ আসবে। তিনি জানতেন।
ছেলেটির আজ জন্মদিন। ছেলেটির মা’কে তিনি শাস্ত্রীয়
সঙ্গীতের তালিম দিয়েছেন পরম যত্নে, কন্যাসম স্নেহে। ছেলেটি মায়ের হাত ধরে এসেছে ছোটবেলায়। বড় হয়ে প্রায়ই
চলে এসেছে তাঁর কাছে। ছেলেটির তালিম
পাশ্চাত্য সঙ্গীতে। ভারতীয় শাস্ত্র
সঙ্গীতের টান অগ্রাহ্য করতে পারে কোনো শিল্পী! সহজে আসত না
ছেলেটি। যখনই বড় বিচলিত বড় যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ত তখন ছুটে আসত ছেলেটি তাঁর কাছে। শান্ত হয়ে সূর্যকান্ত সেনের কাছ ঘেঁষে বসে শুনত ভারতীয়
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। সূর্যকান্ত
একমনে গাইতেন অথবা বাজিয়ে যেতেন কোনো বাদ্যযন্ত্র। বিশেষ করে রুদ্রবীণা। ছেলেটির
বড় প্রিয় ইমন রাগ। অগ্রহায়ণের শুরু। শীত শীত আমেজ বেশ বোঝা যায় কলকাতা থেকে কিছুটা দূরে যেখানে সূর্যকান্ত আছেন। ছেলেটি আজ আসবে। বড় কাতর আছে
ছেলেটি। আজ ওর জন্মদিনে
প্রণাম করতে আসবে। বৃদ্ধ
সূর্যকান্তর হাতে রুদ্রবীণায় বেজে উঠবে ম্যাক নামের ছেলেটির প্রিয় রাগ ইমন। ম্যাক, মানে পরমেশ্বর।
অডিশন চলছে জোর কদমে। ওর থাকার দরকার
মনে করেনি। মন চূড়ান্ত অস্থির। অডিশনের সমস্ত
উপযুক্ত ব্যবস্থা ও করে দিয়েছে। বিচারক আর শ্রোতাদের
ওপর ছেড়ে দিয়েছে বাকিটা। পরমেশ্বর গাড়ি
ভাড়া করে সকালেই রওনা দিয়েছে সূর্যকান্ত সেনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। আজ ম্যাক অর্থাৎ পরমেশ্বরের জন্মদিন।
আর্য উপাধ্যায় বাজিয়ে চলেছে রুদ্রবীণা। ইমন রাগের
কসরত ভেসে বেড়াচ্ছে হল জুড়ে। বিচারকদের আসনে তিনজন। নিমগ্ন, নিবিড় হয়ে সুরের মূর্ছনায় ডুবে
আছেন। চতুর্থ আসনটি
খালি। চতুর্থ আসনটি ছিল পরমেশ্বরের। আর্যর বয়স কতই বা, বড় জোর একুশ
অথবা বাইশ। ওস্তাদী হাত
যেন। কোলের রুদ্রবীণাটি
যেন নিবিড় প্রেমিকাটির মতো বেজে চলেছে ছেলেটির হাতে। বৃদ্ধ সূর্যকান্তর কোলের রুদ্রবীণাটি যেমন বেজে চলেছে কত
বছর ধরে। বছর বাইশের
ম্যাক আর চল্লিশ বছরের পরমেশ্বর নিমগ্ন হয়ে
শুনছে সেই বীণার ঝংকার। তার প্রিয় রাগ ইমন। বিলম্বিত বন্দীশ। তরুণ আর্য উপাধ্যায় আর বৃদ্ধ সূর্যকান্তর
মধ্যে পার্থক্য কতটা? কতটা দূরত্ব এই দুই শাপভ্রষ্ট গন্ধর্বের মধ্যে? দু’জন দু’প্রান্তে বাজিয়ে চলেছে
রুদ্রবীণা। একই রাগে। পরমেশ্বর জানে না, তার অডিশন
মঞ্চে একটি অসম্ভব সম্ভামনাময় দৃপ্ত প্রতিভা বাজিয়ে চলেছে একমনে রুদ্রবীণায় তারই প্রিয় ইমন।
শেষ হয় এক সময়। আর্য উপাধ্যায়ের রুদ্রবীণা নীরব হয়। অথচ তার ঝংকার ভেসে বেড়াচ্ছে
সর্বত্র। বিচারক শ্রোতা সকলেই অভিভূত। প্রখর প্রবীণ অমিত চট্টরাজ বিচারক আসন
ছেড়ে উঠে দাঁড়ান, বাকি দু’জন বিচারকও উঠে দাঁড়ান। ‘তোমার জয় হোক হে নবীন’ বলে ওঠেন অমিত
চট্টরাজ। হাততালি ওঠে হল জুড়ে। বিনম্র নমস্কার
জানিয়ে স্টেজ
থেকে নেমে আসে আর্য উপাধ্যায়। ওদিকে একই
সঙ্গে নীরব হয় বৃদ্ধ সূর্যকান্তর হাতে তার প্রিয় সখী বীণাটি। ম্যাকের হাত ধরে ধীরে ধীরে বাইরে
বেরিয়ে আসে।
পরমেশ্বরকে কলকাতায় ফিরতে হবে। সন্ধ্যা পার
হয়ে গেছে। ‘মেয়েটি কোথায়?’ ‘কানাডা’। ‘আহ, আমি চূর্ণি নামের মেয়েটির কথা বলছি’। ‘জানি না’। শীত আসার আগ দিয়ে ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধ্যার অন্ধকারে
পরমেশ্বরের মুখ দেখা যাচ্ছে না। সূর্যকান্তর বীণার সুর তার যন্ত্রণার উপশম ঘটালেও ব্যথা রয়ে
গেছে। গাড়িতে গিয়ে
বসে পরমেশ্বর। ‘জানিও’, হাত নাড়েন বৃদ্ধ
সূর্যকান্ত। নবীন এসে পাশে দাঁড়ায়। ‘তোমার জয় হোক’, বলেন
সূর্যকান্ত। পরমেশ্বরের
গাড়ি স্টার্ট নেয়। নবীনের হাত ধরে ঘরে ফেরেন সূর্যকান্ত। পরমেশ্বরের গাড়ি ধুলো উড়িয়ে, সন্ধের অন্ধকার
ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে ছুটে চলে কলকাতার দিকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন