ফেরা
একের পর এক ফোন আসছে ঘরে ঢোকার পর থেকে। ড্রয়িংরুমের
প্যারালাল লাইনে মেয়েজামাই স্বতঃস্ফূর্ত বিবরণ দিয়ে যাচ্ছে ঘটনার। যেন
প্রত্যক্ষদর্শী!
-“উনি গেছেন
গুন্ডা সাইজ করতে! বুঝে দেখুন! আর্রে বয়েস বাড়ছে না কমছে?”
আধভেজা দরজা গলে প্রতিটা শব্দ তাঁকে ফালা ফালা করে দেয়। মনে মনে নিজেকেই গাল পাড়েন; কেন যে একে খবর দিতে গেলেন! সক্কালবেলা মেয়েকে ভড়কে দিতে চাননি। রজতপ্রভা, তাঁর মেয়ে। এই শহরেরই সরকারী হাসপাতালে শিশু বিভাগের ডাক্তার। উৎসুক জনতার চাপ এড়াতে মেয়েজামাইয়ের সেল ফোনের নম্বরটা দিয়েছিলেন কম্পাউন্ডারকে। সেই থেকে বাবাজী’র মুখে যেন খই ফুটছে। সারা রাস্তা জ্ঞানদানে অস্থির করে
রেখেছিল। বাড়ি ঢুকেই ‘হাঁড়ির খবরপ্রেমী’দের ফোন দিল নিজ গরজেই। ব্যস্! এরপর ফোন বেজেই যাচ্ছে। একটু পরেই হয়তো সব ভিড় করবে বৃত্তান্ত জানতে। প্রকাশ্য দিবালোকে
তাঁর মার খাওয়ার বৃত্তান্ত। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগতে
থাকে তাঁর। কালই হয়তো খবরের কাগজে
উঠবে। তারপর যথারীতি প্রতিবাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষকের গায়ে হাত! তাঁর ছাত্রদের অনেকেই এখন
বুদ্ধিজীবীর তকমা ধারী; বিবৃতি দেওয়ার সুযোগ
হাতছাড়া করবে না।
কাকে তিনি বোঝাবেন? কীভাবে বোঝাবেন? বীরত্ব দেখাতে নয়, প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছিলেন। সতের বছর আগের এক শীতের সন্ধ্যা’র প্রায়শ্চিত্ত। চোখের উপর হাত রাখেন তিনি।জানালার
কার্নিশে ছোট চড়ুইটা নিশ্চয় তাঁর প্রতীক্ষায়! কটা বাজল?
সতের বছর আগে তাঁর কব্জিতে জোর ছিল; এত সহজে শরীর টাল খেত না। অনেক নির্ভরতায় রজতপ্রভা ছেলেটাকে
দেখিয়েছিল। নিশ্চিত ছিল বাবা কিছু একটা করবেই; নিদেনপক্ষে কৈফিয়ত চাইবে। কিছুই করেন নি তিনি। মেয়েকে নিয়ে
দ্রুত রিকশায় চড়ে বসেছিলেন। আঠার বছরের রজতপ্রভা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে।
তিনি চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন। মেয়েটা সেই যে দূরে সরে গেল আর ফিরে এলো না। রমলা চলে
যাওয়ার পরেও সম্পর্কটা সহজ হলো না। চুপচাপ একই ছাদের নিচে। কো্নো আবদার নেই, কোনো অনুযোগ নেই। তাই যেদিন বলল, “বাবা আমি অনুজকে বিয়ে
করব”, সে’দিন তিনি
জানতেও চাননি, ‘অনুজ’ কে? মেয়ে যে তাঁকে জানাল তাতেই খুশি। কিন্তু কেবল ঐটুকুই। তাঁকে কিছুই করতে
দিল না। রেজিস্ট্রি সেরে চলে গেল নিজের মতো থাকতে। সেইদিন
ঘর অন্ধকার করে অনেক কেঁদেছিলেন।
রমলার মৃত্যুতেও এতটা কষ্ট হয়নি। ঘোলাটে সে অন্ধকারে ঘুরে ফিরে সতের বছর আগের সে
ঘটনাই পাক খাচ্ছিল, সাপের মতোন।
‘অলিয়ঁস ফ্রসেজ’এ ফরাসি শিখত রজতপ্রভা। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা বসে যেত।
তিনিই আনতেন। সেদিন ইউনিভার্সিটির কী এক জরুরী কাজে
আটকে গিয়েছিলেন; যেতে পারেননি। সেল ফোনের সুবিধে ছিল না তখন। ভার্সিটি থেকে শহরে লাইন
পাওয়ার হ্যাপা অনেক। বাড়ি ফিরে শুনলেন, মেয়ে কেবল কেঁদেই যাচ্ছে। অনেক চাপাচাপির
পর জানা গেল, গলির মোড়ে রকবাজদের কেউ জোর করে রিকশা থামিয়ে কাগজ গুঁজে
দিয়েছিল হাতে। চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘জবাব দিও ডার্লিং’। সবাই দেখেছে, কেউ আসে নি। তাঁর রাজকন্যা
মেয়েকে কেউ এমন করতে পারে স্বপ্নেও
ভাবেন নি। রাগে টগবগ করছিল ভেতরটা। কিন্তু মিইয়ে গিয়েছিলেন একটু পরেই; সোঁদা মুড়ির মতো। সময়টা তখন এসিড
সংস্কৃতির; একটু এদিক ওদিক হলো তো জ্বালিয়ে দাও! অজানা আশংকায় কেঁপে উঠেছিলেন।
বুকে কেমন চাপ চাপ লাগছে! তাঁর এই দ্বিতীয়বার হেরে যাওয়ায়
রমলা কি মুখ টিপে হাসত? নাকি স্তোক দিত? যেমন তিনি দিয়েছিলেন সতের বছর আগে সেই রাতে!
-“এগুলো নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে
ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই।”
রমলা বিছানা থেকে নেমে মেয়ের ঘরে চলে গিয়েছিল। তারপর এক
সুনসান দুপুরে ভাত ঘুমের ভেতরে চলেই গেল
চিরতরে।
সকালে বাজার করে ফিরছিলেন। সুভাষের মা পইপই করে বলে দিয়েছিল, “দাদাবাবু একটু কাঁচা সুপুরি আনবেন!” বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। রমলা নেই; এখন সুভাষের মা’ই গতি। অগত্যা পাড়ার
দোকানে থামলেন। বাজারটা ভালোই হয়েছিল। মনটা ফুরফুরে। কৈ মাছ
কিনেছিলেন। বেশ বড় সাইজের। রজতপ্রভার প্রিয়। ভেবেছিলেন বাড়ি ফিরেই ফোন
দেবেন। রাতে খেয়ে যেতে বলবেন।
সুপুরীর দাম দেওয়ার সময় ছোকরা দোকানদারের দৃষ্টি অনুসরণ করতেই
মেয়েটাকে দেখলেন। তারপর
দেখলেন ছেলে দু’টোকে। মেয়েটা
শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেখলেন- সকালবেলার
মিঠে রোদ্দুরে অচেনা শ্যামলা কিশোরীর অপমানিত মুখ। সুন্দর পৃথিবীটা
এই ফুটফুটে মেয়েটার কাছে কী দ্রুত কুৎসিত হয়ে জমে যাচ্ছে - সতের বছর
আগের সেই শীতের সন্ধ্যা’র মতো। হঠাৎ কী যে হলো! নিজের
অজান্তেই নেমে এসেছিলেন রাস্তায়।
তারপরের ঘটনাগুলো এতটাই দ্রুত ঘটল যে এখনো মাথা ঝিম ঝিম করছে ভাবতে।
ক্ষয়া চেহারার যে ছেলেটা তাঁর মুখের উপরে ধোঁয়া ছেড়ে
চাঁটগার আঞ্চলিকে বলেছিল, “আঁরার লয়
মাস্টারি ন খইজ্জন (আমাদের সাথে মাস্টারি করবেন না)”, তাঁকে তিনি চড়টা লাগাননি। তখনও মেজাজটা
বশেই ছিল। উস্কানিটা দিল পাশের জন। অশ্লীল গানটা গেয়েই যাচ্ছিল যেন তিনি নেই। মাথায় দপ্ করে
আগুন ধরে গেল। সতের বছরের
চাপা আগুন। কষে চড়
লাগালেন। তড়িৎ রিফ্লেক্স ছেলেটার; মুহূর্তের মধ্যে ঘুরিয়ে ঘুসি লাগিয়ে দিল তাঁর চোয়ালে। তাল রাখতে পারলেন না; একদম রাস্তায়।
ভাগ্যিস্ মাথায় লাগেনি! হাতে ধরা বাজারের ব্যাগ ছিটকে পড়ল। আধ ডজন কৈ কে
যে সেঁটে দিল?
জটলা হয়ে গিয়েছিল নিমেষে। মাগনা শো! এমনকি উদল গায়ে কলের ধারের লোকটাও ভিজে
কাপড়ে সাবানের ফেনা সমেত উঠে এসেছিল। ছেলেগুলো খিস্তি আওড়াতে আওড়াতে ধীরে সুস্থে মোটরসাইকেল
ঘুরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে চলে গেল। দোকানি ছেলেটাই
উঠিয়েছিল তাঁকে। ডাক্তারখানায়ও সে’ই নিল। শুক্রবার ছুটির
দিন। বেশ বেলায় আসেন ডাক্তারবাবু। ছোকরা কম্পাউন্ডার ছড়ে যাওয়া জায়গাগুলি সেভলন দিয়ে পরিষ্কার করে
ব্যান্ড-এইড লাগাতে লাগাতে বলল,
-“এদের কাছে
যন্ত্র থাকে দাদু। আপনি যে বেঁচে আছেন, শোকর করুন।”
‘দাদু’! খট করে কানে
লেগেছিল। সাতষট্টি পুরোবে সেপ্টেম্বরে। দাদু
হওয়ারই বয়েস। জীবন-তরীর মাঝির এখন তীরে ভেড়ার তাড়া। ইন্সুলিন ছাড়াও শরীরের
ছন্দ ঠিক রাখতে পাঁচটা গুল্লি গিলতে হয়। সময় কী দ্রুত বদলে
যায়! কব্জির জোর দেখাবারও একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। আহা! সব কিছু যদি আবার শুরু করা যেত!
দরজার ফাঁকে কে ও? সুভাষের মা। বেচারী ঘাবড়েছে ভীষণ। একটা কাক ডাকছে কোথাও বিচ্ছিরি করে।
- “দিদিমনির ফোন!”
মাথার পাশে এক্সটেনশনটা তোলেন তিনি।
-“বাবা!”
তিনি শোনেন। মেয়ে হু হু করে কাঁদে। কেঁদেই যায়।
কতদিন পর মন থেকে এই ডাক! চোখ ভিজে যায় তাঁরও।
অপ্রস্তুত সুভাষের মা জানালার পর্দা সরায়। দুপুর রোদে ভেসে যায় মেঝে। জানালার কার্নিসে চড়ুইটা দ্বিতীয়বার ঘুরে আসে দানার খোঁজে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন