অপেক্ষা যে করছিলাম না তাই বা বলি কী
করে... এক অনির্ধারিত দিনের জন্য অনির্দিষ্টকালীন অপেক্ষা। অচেনা কারো খুব চেনাভঙ্গীর তিরতির আলোগলা অপরাহ্ণের জন্য অপেক্ষা। দিন তো পাখির
ডানায় ওড়ে, পথও বদলায়। প্রতিদিন প্রতি ঘন্টার ব্রেকিং নিউজের সাথে সাথেই বদলে যাচ্ছে ব্রোকেন
সোসাইটি। বেড়ে যাছে হল্টারনেক-এর উদারতা উইথ রেড পাইপিং। মেয়েরা আজকাল কাজল ছেড়ে
মাশকারায় মশকরায় রত। কাঁধখোলা টপে স্ট্যাপলেস ব্রা জরুরি। সিগারেট হাতে নিয়ে ধোঁয়াদের উল্টে ভড়কে
দিচ্ছে ওয়াক্স কন্যারা...। নিয়মিত ক্লাসে যাবার সময় আড্ডা ছেড়ে ফুটপাতেই র্যাম্প প্র্যাক্টিস করে
তারা... ছবি কিম্বা কোনো বই নিয়ে গল্প এগোয়া না তাদের
বিনা কারণে চড়া মেকআপ। যেন এক্ষুনি কোনো শো হোষ্ট করতে হবে তাদের। এসব ডামাডোলে আমি মানাই না। আমার ম্লান ত্বক ছায়া থেকে আরো গাঢ ছায়ায় প্রবেশ করতে
থাকে। এই ছায়া মনে ঘনায়, চোখে ছাপ ফেলে, কিন্তু মুখের রঙ বদলায় না।
মা কখন যেন টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। রোজ এই এই কাণ্ড হয়। “এখনও ঘুমোয়নি মেয়েটা। যাও শুয়ে পড় এখন। এভাবে প্রতিদিন জাগলে চেহারাটা কী হয় দেখেছ?'” আমি মনে মনে মেনে নিলাম, মুখে বললাম “তোমার মেয়ে কিন্তু ভারী মিষ্টি, দেখ! দেখ, আয়নায় চোখ রাখো!” আমার মায়াবী মা ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নায় চোখ রাখেন, দেখেন তাঁর হারানো দুইবেণী শিশুকন্যাকে, তাঁর তুখোর রেজাল্ট করা মেয়েকে, তাঁর অসময়ে মন ভাঙা মেয়েকে, তাঁর রাতজাগা চোখের তলা দেবে যাওয়া মেয়েকে। আর আমি দেখি মেয়ের চিন্তায় দিনের পর দিন না ঘুমোনো এক মা’কে। মা’কে কি ইদানিং বেশি বয়স্ক দেখায়? দুই প্রজন্মের দুই রমণী প্রিয়তম বন্ধু অনেকক্ষণ জড়িয়ে রাখে নিজেদের। একসময় মা’কে ঘরে ফেরৎ পাঠায় মুমু।
পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকতে না ঢুকতেই মা আমার বিয়ে দিতে অস্থির হয়ে গেলেন। বয়স নাকি অনেক বেশি হয়ে গেছে! বিয়ের বাজারে যা খুব নেগেটিভ পয়েন্ট। তার মধ্যে আবার গায়ের রঙ ময়লা, একঢাল চুল নেই কোমর পর্যন্ত। কী হবে আমার! কোনো বন্ধুর বিয়ে শুনলেই মা কিছুদিন মন খারাপ করে থাকেন, আবার যথাসময়ে ভুলে স্বাভাবিকও হয়ে যান। তাকে মুমুই স্বাভাবিক করে। বলে, “মা ঠিক পেয়ে যাব কোথাও কোনো দুরন্ত নাবিক, দেখে নিও! আমাকে নিয়ে একটানে গুম ভেসে যাবে। বাতাসে আমার কম ঘন চুল দিকভ্রান্ত হয়ে উড়ে যাবে, শুধু কপাল থেকে কুন্দনের টিপটা খুলে সে আমাকে চুমু খাবে”। এইটুকু শুনেই মা বকতে থাকেন, ঙ্কী সাঙ্ঘাতিক রে তুই!” আমি চোখ ভর্তি পানি নিয়ে হাসতে হাসতে মরি। মনে মনে ভাবি – আসবেই! বলবে, ‘ভাগ্যিস তোমার লিপষ্টিক দেবার অভ্যাস নেই! গালে রঙ করা মেয়ে আমি দু’চোখে দেখতে পারি না’।
শেষ করা ডিজাইনটার দিকে তাকিয়ে ফাইন্যাল লুক দিলাম একটা। তারপর হাতে চা নিয়ে জানালার বড় গ্লাসটা খুলে দিলাম। আহঃ সকাল তুমি কী সুন্দর গো! এসময়টা ভোরের সাজগোজ দেখি আমি। আলো ফোটার আগের মুহূর্তটা খুব কষ্টের। কী যেন পেতে ইচ্ছে করে। দূরের কমলা রঙ চিকন রেখা একটু একটু করে আকাশের নাম ধরে ধরে ছড়াতে থাকে। মেঘেরাও আকাশের বুকে আরো কিছুক্ষণ থাকার জন্য রীলেরেস খেলতে থাকে। একসময় চারপাশের কমলা যেন আকাশের ঘোমটা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। নীল নীল মেঘের কষ্টেরা ফিরে যায় গাঢ কষ্টকে সাথে করে। অনাবিল আনন্দ মন্দিরায় দুরন্ত আকাশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। আশেপাশে লোকজনের ইতঃস্তত হাঁটাহাঁটি শুরু হয়। পাশের রেস্টুরেন্টে চায়ের টুং টাং আর হকারদের হাঁকডাক শোনা যায়। শ্রাবণী সেন ঘুম বাদ দিয়ে বসে যান হারমোনিয়াম টেনে। তারা বাংলা'য় আজ সকালে তাঁর নিমন্ত্রণ। আজ মন ভরে তাঁর গান শুনব।
এরকম ভোরেই কথা হতো রোজ। মুমুর সমস্ত কাজের ক্লান্তি কেটে যেত তার কণ্ঠে। কথারা যে কত কথা বলতে পারে! এক ইথারে যা যা ভেসে আসার চলে এসেছিল... ভরাট কন্ঠ আমার সমস্ত ব্যস্ততাকে থামিয়ে দিত। আদিম সুবাসে বড্ড মাদকতা তার, নিবিড় করে কানে আসে চোখে ভাসে, স্পর্শহীন শরীর কোথা থেকে এত স্পর্শ পায়! মন্ত্রমুগ্ধ মুমু ক্রমশ ডুবে যায় কিনারাহীন নির্মাণে। বহন করতে চায় অনিবার্য স্রোত একান্ত অক্ষরে। এরকম কোলাহলে হঠাৎ একদিন থেমে গেল রিংটোন... কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি তা নয়... মুমু বড় সিম্পল, ছবি দেখে ভালো লাগেনি তার মায়ের। মেয়ে নাকি সামান্য লিপষ্টিকও দেয় না। যেখানে স্লিভলেস স্মার্ট মেয়েদের হিড়িক পড়েছে চারিদিকে। এমনটি চান না তার মা ছেলের জন্য।
গত সপ্তাহেও মুমু গেছিল পাত্রপক্ষের সামনে। মাঝে মাঝেই তাকে যেতে হয়। এ বড় বাজারি কারবার। তবু হাসিমুখে সহজ ছিল সে। পরে মুমু বুঝেছে এবারও রিজেক্ট করেছে তাকে। ঘটনা সেটাই - মেয়ে সঙ সাজে না, যুগের অনুপোযোগী। মুমু কষ্ট পায় না। হতে পারে, সে আসলে বেশি আটপৌঢ়ে। কিন্তু দেশে বিদেশে এমন বুদ্ধিমতি বিদূষী কোথাও কি আটকাবে... শুনেছে অফিস তাকে ফেলোশিপ দিয়ে পাঠাবে। তার পাশে এসব মাশাকারা মেয়ের দল কি দাঁড়াতে পারবে? কে জানে!
মুমু মেকীভাব নিয়ে থাকতে জানে না। লিপষ্টিক কালচারে পানি ঢেলে সে শ্রাবণীর গান শুনতে থাকে। ‘...রূপে তোমায় ভোলাবো না, ভা্লোবাসায় ভোলাবো’। শ্রাবণীর প্রাণখোলা গলায় মুমুর বুকটা টনটন করে ওঠে। অসম্ভব শ্যামলিমা মুখ তার, মানতাশা আলোয় আরো স্নিগ্ধ দেখায়, ঝকঝকে দাঁতে দ্যুতিময় নম্র হাসি। সে জানে, এই হাসিকেই কেউ ভালোবাসবে, ব্র্যান্ডেড ম্যাক লিপিষ্টিকের ম্যাট ফিনিশিং ছাড়াই।
চেনা লেখা আবার পড়তে ভালই লাগে।
উত্তরমুছুনএই হাসিকেই কেউ ভালোবাসবে, ব্র্যান্ডেড ম্যাক লিপিষ্টিকের ম্যাট ফিনিশিং ছাড়াই।
উত্তরমুছুন