সুবীরবাবুর ব্যাগ
রিটাযারমেন্টের তখন মাত্র আর
মাসখানেক বাকি। পেনশন
সংক্রান্ত ঝামেলা ঝঞ্ঝাট সব শেষ করে ফেলতে পেরেছেন বলে এখন
তাঁর শুধু টেনশন বিহীন অপেক্ষা। অনেকটা
সেই রকম, ডেডবডি চুল্লির মধ্যে ঢুকে গেলে যেমন সাময়িক
দায়মুক্ত শ্মশান যাত্রীরা। তখন বসে বসে বিড়ি খায় কিংবা আর
কিছু, যার যেমন জোটে, আর
অপেক্ষা করে, অপেক্ষা শেষের জন্য। যে অকূল পারাবার সামনে পডে আছে তাঁর সন্তান সন্ততি আর বিধবা স্ত্রীর জন্য, সে ভাবনা তখন আসতে পারে না ধোঁয়া, থ্যাতলানো
ফুল আর সস্তা অডিকলোনের সমন্বিত গন্ধ ঠেলে। সুবীরবাবুর গল্প অবশ্য একটু অন্যরকম। পরবর্তী
কালের জন্য যে পারাবার তাঁর সামনে পডে থাকল,
তা অকূল নয়, তার নাগাল দেখতে পাওয়া যায়। সে ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছেন। সমস্যা
কেবল একটাই, অবশ্য আদৌ যদি সুবীরবাবু সেটাকে সমস্যা মনে
করে থাকেন, অসময়ে হওয়া একমাত্র মেয়েটি, নেহাত নাবালিকা এখন সে। সুবীরবাবুর বাবা যে কয়টি কন্যা সঞ্চয় রেখে
গিয়েছিলেন তাঁর জন্য, একের পর এক তাদের বিয়ে থাওয়া দিতে
দিতে সময় আর সঙ্গতি শেষ হয়ে যাওয়ায়, সুবীরবাবুর ঐ মেয়েটির
পক্ষে এর আগে জন্মগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। সুবীরবাবু মনে মনে জানেন, সেইটাও কোনো সমস্যা হবে না তিনি রিটায়ার করলে। আগে থেকেই
অঙ্ক কষে সব ব্যবস্থা তিনি করে রেখেছেন।
দিন যত যাচ্ছে, তত মনে মনে ভেরিফাই করে যাচ্ছেন সুবীরবাবু, ফাঁক থেকে গেল না তো কোথাও, বাদ পড়ে গেল না তো কোনোকিছু! কোথাও ধার বাকি কিছু থেকে গেল না তো! ধার বাকি বলতে লোকের কাছ থেকে কর্জ নেওয়া নয়, হাউস বিল্ডিং লোন, হাউস ফারনিশিং লোন, এইরকম কয়েকটি। ভেরিফাই যত করেন, নিশ্চিন্ত হন তত বেশি। কেবল আর্থিক ব্যাপার নয়, তাঁর অখন্ড অবসরের টাইম ম্যানেজমেন্ট ব্যাপারটাও আগাম ভেবে রেখেছেন তিনি। মেয়েকে কখন কতক্ষণ পড়াবেন, কতক্ষণ সকাল বেলায় হাঁটবেন, কতক্ষণ ক্লাবে গিয়ে তাস খেলবেন, রবীন্দ্র জয়ন্তীর আয়োজন করবেন, ইত্যাদি সব।
কিন্তু রিটায়ার করতে যখন আর মাত্র
দিন সাতেক বাকি, তখন একদিন হাসিমুখে বাড়ি ফিরে ভুল করে
ক্লান্ত সাজতে যখন ভুলে গেলেন, মেয়েটা তখন বাবার মুখের
প্রসন্নতাকে প্রশ্রয় মনে করে সাহস করে এসে হাত গলিয়ে
দিল সুবীরবাবুর ঝোলা ব্যাগটার মধ্যে। এমন কখনো করে না মেয়েটা, সুবীরবাবু নিজেই বার করে দেন যা আনেন মেয়ের জন্য। ব্যাগ হাতড়িযে যখন কিছু পেল না মেয়েটা, সুবীরবাবু
একটু কষ্ট কষ্ট হাসি হেসে বললেন, “ভুলে গেছি রে মা!”
মেয়েটা শুধু বলল, “আচ্ছা”। আর তার বিমর্ষ হওয়া হলো না। এসবও
সুবীরবাবুর গুছিয়ে রাখা। অনেক দিন
ধরে বৌকে আর মেয়েকে বুঝিয়ে আসছেন যে, প্রত্যাশা এবার থেকে
কিছু কিছু করে ছেঁটে ফেলতে হবে, কারণ চাকরি শেষ মানে মাসমাইনে বন্ধ হয়ে যাওয়া। তখন সঙ্গতিতে টান পড়ে। বলেছেন, তাঁর নিজের বেলায় টেনেটুনে চলার
ব্যাপারটা একটু বেশি করে মেনে চলতে হবে, কারণ সংসারে এখনো দায় রয়ে গেছে। সবাই
বুঝেছে সে কথা। মেয়েটাও বুঝেছে নিশ্চয়, না হলে মন অবশ্যই
খারাপ করত যখন কিছু পেল না ব্যাগের ভেতর।
এতক্ষণ যে হাত ব্যাগের ভিতরে অনুসন্ধান করছিল মেয়েটা, সেই হাত দিয়ে ব্যাগটাকে সামনে মেলে ধরে তখন বাইরের চেহারাটা দেখছিল মন দিয়ে। আগে কোনোদিন এমনভাবে দেখবার সুযোগ হয়নি। নকশার সেলাইগুলোর উপর হাত বুলিয়ে বুলিয়ে কী যে দেখছিল মন দিয়ে, তা কে জানে! সুবীরবাবু তখন প্রাথমিক বিশ্রামের পর জামা কাপড় ছাড়ছিলেন। হঠাৎ মেয়েটা বলে উঠল, “ইস্ কী সুন্দর!” ব্যাগটা তার জন্মের আগের, সুতরাং জন্মের পর থেকে এযাবৎ দেখে আসছে সে। সুবীরবাবুকে দেখতে পেলে এই ব্যাগটাও দেখতে পাওয়া যাবে। আর যে দেখেছে সেইই বলেছে, ভারী সুন্দর তো ব্যাগটা! অথচ তা মেয়েটার চোখে পড়ল আজই প্রথম। ব্যাগটা সুন্দর, ব্যাগের উপর শান্তিনিকেতনী নক্সাগুলো সুন্দর। শুনে একটুখানি কষ্ট চিন চিন করে উঠল সুবীরবাবুর বুকের ভিতর। হায়রে, একটা দেখা ফুরিয়ে গেল বলেই কিনা আরেকটা দেখা শুরু হলো! তার আগে হলো না? সুবীরবাবু বললেন মেয়ের কথায় সায় দিয়ে, “হ্যাঁ, মা, খুব সুন্দর!” সঙ্গে সঙ্গে এমনভাবে ঘাড় নাড়ল মেয়েটা, যা ভাষায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “হ্যাঁ, সুন্দরই তো!” সুন্দর তো বটেই তার কাছে, তার যে অনেক কারণ, আগ্রহ করে যা কিছু পাওয়ার তা তো সবই সে পেয়েছে এই ব্যাগের ভিতর থেকেই। প্রায় দিনই সমীরবাবু কিছু না কিছু নিয়ে এসেছেন তার জন্য এবং যা কিছু এনেছেন সবই তো মেয়েটা পেয়েছে এই ব্যাগের ভিতর থেকেই। শুধু কি তাই? মেয়েটা জানে যাদু আছে এই ব্যাগটাতে। হঠাৎ স্কুলের বাক্স গোছাতে গিয়ে মেয়েটা যদি দেখল পেন্সিল নেই বা ব্যবহার করতে করতে ছোট্ট এতটুকু হয়ে গেছে, তাহলে একবার এসে সুবীরবাবুকে বললেই হলো। সুবীরবাবু খাটের উপর বসে বললেন, “দে তো মা ব্যাগটা একটু এনে, একবার দেখি”। তারপর ঠিক একটা পেন্সিল বেরিয়ে এসেছে ব্যাগের ভিতর থেকে। নতুন হয়তো নয়, কিন্তু মোটামুটি আস্ত। মেয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “চালিয়ে নে একটা দিন, কাল নতুন এনে দেব”। এমনি আরো কত কী, যখন যা দরকার হয়েছে সবই।
আজ হয়তো কিছু আসেনি, কিন্তু এ যাবৎ তো অনেক এসেছে - এই ভেবে নিজেকে এখন সান্ত্বনা দিতে পারে মেয়েটা। একটু বড় তো হয়েছে এখন, বয়েসে না হলেও যেমন অনেক সময় মানুষকে বয়ঃপ্রাপ্ত হতে হয় সংকটের মুখোমুখি হয়ে , তেমন তো হয়েছেই। তার জানা হয়ে গেছে যে সবকিছু আর আগের মতোন হওয়ার নয়। মন থেকে সমস্ত প্রচলিত প্রত্যাশা দূর করে দিয়ে সে তৈরি। যা সে এতদিন পেয়ে এসেছে তা আর চাইবে না। যা সে এতদিন দেখে এসেছে, তা এবার চোখ থেকে সরিয়ে ফেলবে সে। এই যে এই ব্যাগটা আজ তার চোখে হঠাৎ সুন্দর হয়ে উঠল, এটাও তাহলে সরে যাবে চোখের সামনে থেকে! তাই এত মমতায় দেখা!
সুবীরবাবু দেখছিলেন। মেয়েটার অমন হয়ে দেখা, তা যেন একটা দ্রষ্টব্য তাঁর কাছে। মেয়েটা যেন বয়েসের তুলনায় একটু বেশি বড় হয়ে গেছে। মেয়েটার শিশুকাল বড় অসময়ে হারিয়ে গেল! শৈশবের আদর আহ্লাদ কোনোদিন তার পাওয়া হলো না! তাকিয়ে দেখছেন মেয়েটার দিকে, মেয়েটা এখন ব্যাগটাকে আদর করছে। তার বয়েসের একটি মেয়ের সম্ভাব্য চাহিদার নিরিখে ব্যাগটা আজকে খালি, ব্যাগটা আজকে একেবারে শূন্য, তবু ব্যাগটা আদর হারায় নি তার কাছে। সুবীরবাবু অবাক হচ্ছেন ভেবে, কবে শিখল মেয়েটা শূন্য আধারকে আদর জানাতে? হঠাৎ বিস্ময়ের সুরে ডাক দিল মেয়েট, “বাবা!” ব্যাগের উপর চলমান ছিল যে হাতটা, সেটা থেমে গেছে এখন। সুবীরবাবু বললেন, “কী হয়েছে রে মা?”
-- দেখেছ, ব্যাগটা কিন্তু এখনও শক্ত আছে, এতটুকু ছেঁড়ে নি কোথাও!
-- তা আছে। ছিঁড়ে গেলে কি আর ওটা নিয়ে অফিসে যেতে পারতাম? ছেঁড়ে নি বলেই তো নিয়ে যেতে পারছি।
-- না না, তুমি দেখো, এই একমাসেও ছিঁড়বে না। এই ব্যাগটা তাহলে যাবে না, বাবা, এটা আমাদের সাথে থাকবে।
-- হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস তো রে মা! ব্যাগটার কথা তো ভাবা হয়নি, ওটা যে অফিসের ব্যাগ, একমাত্র অফিসে যাওয়ার সময়ই সঙ্গে নিই। রিটাযারমেন্টের পর তখন ওই ব্যগটার কী হবে, কী করব ওই ব্যাগটা দিয়ে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন