শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৫

লিপিকা ঘোষ

প্রবাহ ৩

‘একের পর এক মিউজিক অ্যালবাম জমা পড়ছে দাদা, ফোন আসছে অজস্র’, চিন্ময় ছেলেটি জানায়সব তো রাবিশ, মুখ না তুলে জবাব পরমেশ্বরের
সামনে অসংখ্য ফাইল – নায়িকা নির্বাচনেরঅসংখ্য প্রোফাইল এসে জমা পড়েছে। এসব অসহ্য পরমেশ্বরের কাছে। সবাই পেশায় মডেল। স্বপ্ন অস্কার উইনার হওয়ার। অথচ চোখ, নাক, ঠোঁট সব মেকি। যেন ধার করে এনে বসিয়ে দিয়েছে। একটু পরেই মেকআপম্যান এসে খুলে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেবে অন্য একটা মুখে 

‘কবে থেকে অডিশন শুরু করছ?’ সন্দীপদা’র প্রশ্ন। ‘কিসের মিউজিকের? কাদের অডিশন নেব? ঠিকঠাক পিয়ানো প্লে করতে পারে ক’জন?’ কর্কশ উত্তর পরমেশ্বরের। ‘আহা, নায়িকাদের ভায়া, একটা মুভিতে এতগুলো সুন্দরী মহিলা চরিত্র, কাকে ছেড়ে কা’কে দেখবে দর্শক?’ ‘আহ ছ্যাবলামি কোরো না সন্দীপদা’ আরও ক্ষেপে যায় পরমেশ্বরতবু তুমি চলতি নায়িকাদের একজনকেও নেবে নাপ্রোডিউসার তো টাকা ঢালতে রাজি ভায়া’। ‘আমার নতুন মুখ চাই একফোঁটা অভিনয় না জানা মুখ। সব ক’টি মহিলা চরিত্রে’। পরমেশ্বর তীব্র‘পথে পথে ঘুরে বেড়াও নায়িকা ধরার জন্য!’  সন্দীপদা বিরক্ততাই বেড়াবরাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকব’‘ক্যালাবে পাবলিক তোমাকে, ফিল্ম তৈরি মাথায় উঠবে’ সন্দীপদা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের কাজে মন দেয় আসলে সন্দীপদা ক্যমেরাম্যান, পরমেশ্বরের সবগুলো ডকু’র
‘আর তোমার নায়ক?’ কৌস্তভ ছেলেটি হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢোকে‘ঠিক হয়ে গেছে, কথা হয়ে আছে ফর্মালিটিজ পরে কমপ্লিট করা হবে‘মানে? আমরা কেউ কিচ্ছু জানলাম না, কে তিনি?’ ‘যখন জানার তখন জানাব’। পরমেশ্বরের জবাব ‘অ, সিক্রেট রাখছ, দারুণ কিছু সারপ্রাইজ আছে তাহলে!’ কৌস্তভের চোখে কৌতূহল ‘মেইল চেক করোনি তিন দিন ধরে। কোন এক মহিলার অদ্ভুত মেইল এসেছে। জীবন, মুগ্ধ, সুন্দর ইত্যাদি শব্দ লেখা। মাথার ওপর দিয়ে গেল মাইরি’ কৌস্তভ জানায়। ‘ন্যাকামি করিস না, নিশ্চয়ই সেই মেয়েটি, তুইই তো আমার পার্সোনাল নাম্বার দিয়েছিস’পরমেশ্বর কঠোর ভাবে বলে‘আমি! ওহো তাহলে শ্রাবস্তী দিয়েছে’, কৌস্তভ জানায়। ‘সেটা আবার কে?’ ‘আমার তের নম্বরি, কিছুদিন আগে আবার রিলেশনে ফিরেছেমাইরি পরমেশ্বরদা, থার্টিন আমার চিরকাল লাকি নাম্বার’। ফাজলামো কৌস্তভের‘থাম, যত রাবিশ! তোর চোদ্দ পনের সকলের কাছে আমার  পার্সোনাল দিয়ে দিয়েছিস কেন?’ তীব্র অসন্তুষ্ট পরমেশ্বর‘সকলকে দিই নি তো, এই তের নম্বরকে আমি হারাতে চাই না দাদা, জেদ করল। ওর কোন দিদি না কি চেয়েছে সিধা তোমার বেডরুমে আসতে চায়? কবে? জানিও’। তীব্র ফাজলামো কৌস্তভের‘আহ, ছ্যাবলামি থামা’বিরক্ত পরমেশ্বর। ‘ক্ষেপে যাও কেন? এই নতু পিস এর নাম আবার চূর্ণি’। খুকখুক করে হাসে কৌস্তভকী নাম?’ ‘চূর্ণি’

পরমেশ্বর স্থির হয়ে বসে থাকে। চারপাশে কে কী বলছে ওর কানে ঢোকে না টেলিফোনের ওপ্রান্তে চূর্ণি ছিল! ম্যাক বেমালুম বুঝতে পারেনি! ওর সেই কমলা পাড় ঢাকাই? যার জন্য ওর অধীর প্রতীক্ষাতিনদিন ধরে ও মেইল চেক করেনিকিছুটা বিরক্তি মেশানো ক্লান্তি ছিলএই কৌস্তভের কাছে পাসওয়ার্ড থাকে ওর মেইল আইডিরকাল ফিরেছে চেন্নাই থেকে
‘এই নাটুকেপনার কোনো প্রয়োজন ছিল কি?’ আপন মনে বলে ওঠে পরমেশ্বরতীব্র কর্কশ ও, চোয়াল শক্তটীম-এর সকলে খুব অবাক হয়ে তাকায় ওর দিকে
‘চিন্ময় রাবিশ অ্যালবামগুলো দাওআর কিছুদিন আগে দাড়ি গোঁফওয়ালা একটা ছেলে দেখা করতে এসেছিল, তোমাকে গীটারে কিছু বাজিয়ে শোনাচ্ছিল, ওর অ্যালবামটাও দিও’পরমেশ্বর বলে চিন্ময়কে। ‘ও তো কোনো অ্যালবাম জমা দেয়নি। ছেলেটা খুব নিডি’। চিন্ময় অনুচ্চ গলায় বলেযেন একটু সুপারিশই করেও জানে ছেলেটি মিউজিকটা যথার্থ অর্থে বোঝে‘শালার আমিও তো নিডিপৃথিবী জুড়ে সব্বাই শালা নিডির বাচ্চা। মিউজিসিয়ান হতে চায় অথচ একটা অ্যালবাম তৈরি করে দিতে পারে না। যত্তসব ভ্যাগাবন্ড’। রীতিমত ক্ষেপে গেছে পরমেশ্বরমিউজিক নিয়ে কোনো ছেলেখেলামো সহ্য করতে পারে না পরমেশ্বর ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ম্যাক-এর একটা ব্যান্ড ছিল। সুরকার ছিল ও। লিড সিঙ্গার অরূপ বণিক, ওর বেস্ট ফ্রেন্ডকোটিপতি বাপে একমাত্র ছেলে। আহ ট্যালেন্ট! বন্ধুত্বের বন্ধন, সুর আর তালের যুগলবন্দী ওদেরসেই যুগলবন্দীর নাম সুন্দরী তন্বী। ম্যাক-এর তন্বী ঝকঝকে উচ্ছ্বল, চঞ্চল তন্বীইউনিভার্সিটির সবাই জানত তন্বী ম্যাক-এর সুর তাল লয়। তন্বী ম্যাক-এর প্রতিটি গানের কথাতন্বী ছিল বেস্ট ফ্রেন্ড অরূপ আর ম্যাক- এর মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি ঝরনা। তন্বীর শরীর ঘিরে সুর। তন্বী বাঁধন না মানা মুক্তি, তন্বীর উচ্ছৃঙ্খলতায় ম্যাক-এর গানের কথা তাল লয়। আর অরূপ? অরূপের গলায় জাদু। তন্বী সেই জাদুর মায়ার মায়াদুটি সুরপাগল ছেলে আর একটি চঞ্চল ঝর্নার অবিশ্রান্ত বয়ে যাওয়া। মিউজিক মিউজিক! সব মনে পড়ে ম্যাক-এর

‘এটা কি ঠিক করছ পরমেশ্বর? তোমার প্রথম মুভি। বিগ বাজেট। মিউজিসিয়ানও নতুন হাত নেবে?’ সন্দীপদার কথায় অতীত থেকে ফেরে পরমেশ্বর‘নেব’। সংক্ষিপ্ত জবাব পরমেশ্বরের ‘তোমার মুভিতে কোনো গান রাখছ না নায়ক নায়িকার গলায়? নিদেন পক্ষে আধখানা রবীন্দ্রসঙ্গীত?’ আকুল প্রশ্ন সন্দীপদা’র
‘সন্দীপদা ননসেন্স কথাগুলো কেন যে বল? পুরো মুভিটা জুড়ে গানদর্শক, শ্রোতা না শুনতে পেলে শুনবে না। সেসব হাবা কালাদের জন্য এ ফিল্ম নয়। আমি আজ চল্লাম, তোমরা সুটিং লোকেশনগুলো নিয়ে ভাবো’ 
‘তুমি তো পুরো ইতিহাস তুলে আনতে চাইছ হে’! সন্দীপদা
‘কিন্তু এটা কোনো ঐতিহাসিক মুভি নয়’ পরমেশ্বরের জবাব।
‘তা নয়কিন্তু তোমার নায়ক কে হে? তা তো বলে যাও’
সামনের কম্পিউটার দুটো শাট ডাউন করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় পরমেশ্বর। ‘মঞ্চ অভিনেতা। ফিল্ম করেন নি একটাও’
হাঁ হয়ে থাকে টীমের সবাই
‘চললাম’। বেরিয়ে পড়ে পরমেশ্বর

রাস্তায় নেমে মিনিট দশ-এর অপেক্ষা। একটা ট্যাক্সিতে চেপে বসেগড়িয়ামোবাইলে চূর্ণির নাম্বারে দুবার ডায়াল করে কেটে দেয়আর একবারও ফোন করল না মেয়েটমেইল-এর রিপ্লাই না পেয়ে তো বোঝা উচিত ছিল, পরমেশ্বর মেইল চেক করেনি। রাগ, অভিমান, ক্ষোভ - অসহ্য এক যন্ত্রণা মোচড় দিতে থাকে পরমেশ্বরের মগজেপড়ন্ত বিকেলএকটু পরেই ঝলমলিয়ে জেগে উঠবে রাতের মহানগরীকলকাতা ঘুমোয় কখন, ম্যাক জানেরাতের পর রাত ম্যাক দেখেছে ঝলমলে মহানগরী যেন পরপুরুষের কণ্ঠলগ্না হয়ে নিদ্রার নেশায় ঢুলে পড়েছেম্যাক দেখেছে ... আহ! আজ রাতে আবার কানাডা থেকে ফোন আসার কথাদিন কয়েক আগেই মেইল জানান দিয়ে গেছে‘অসহ্য – অসহ্য – লাস্যময়ী কলকাতা তুমি অসহ্য’। বিড়বিড় করে বলে পরমেশ্বর। ট্যাক্সি ড্রাইভার ঘাড় ঘুড়িয়ে বলে, ‘জি বোলিয়ে!’  ‘নেহি কুছ নেহি’। ট্যাক্সির সিট-এ হেলান দিয়ে চোখ বুজে থাকে পরমেশ্বর

নিভন্ত বিকেললানো সোনা নেমে আসছে চারপাশ বেয়ে। একটু পরেই ঝলমলিয়ে উঠবে চারপাশ, যখন দিন ডুবে যাবেচূর্ণি দাঁড়িয়ে আছে যোধপুর পার্কের পোস্ট অফিসের গলিতে। হলুদ টিউটোরিয়াল হোম-এর সামনেকী এমন যন্ত্রণা আছে ওখানে, ওকে জানতে হবে। মেইল-এর রিপ্লাই করলেন না পরমেশ্বর। ব্যস্ত মানুষ। হয়তো মেইল চেক করেন নি চূর্ণি ফোন করতে পারত। তিন বার ডায়াল করে কেটে দিয়েছে। কী বলত ও? ‘আমি চূর্ণি বলছি’? এই নাটুকেপনাটা সহ্য করতেন কি পরমেশ্বর? নিজের কাছেই কেমন মেলোড্রামা লাগছে। নিশ্চয়ই ফোন করবেন উনিঅন্ধকার নেমে আসছে। জেগে উঠছে চারপাশ। আর একা একা এসে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক নাযদিও দূরে ওর গাড়ির ড্রাইভার দাঁড়িয়ে। চূর্ণি গাড়িতে গিয়ে ওঠে
‘চল’
‘গড়িয়া ফিরবেন তো?’
‘হ্যাঁ’
‘আর কোথাও যাবেন না?’
‘না, আজ থাক’       


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন