মাদারী
কানুদাসের দিনটা সেদিন আর পাঁচদিনের মতোই শুরু হয়েছিল। সকালে উঠে মুখ হাত ধুয়ে কৌটোর দুধ গুলে খাওয়ালো
মা-মরা ছেলেটাকে। তারপর নিজের আর চুন্নু-মুন্নীর
চা-বিস্কুট খাওয়া হলে ডুগডুগী বাজিয়ে খেলা দেখাতে বেরিয়ে পড়েছিল। বাসরাস্তার ধারে নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে।
অনেক বাচ্চা তার উঁচু পাঁচিলের মধ্যে প্রজাপতির মতো খেলে বেড়ায়। ভেতরে ঢোকা যায় না
অবশ্য। গেটের কাছে গেলেই হাঁকিয়ে দেয় দারোয়ান। কিন্তু কানুদাসের লোভ যায় না। কোনো একটা বাচ্চাকে ‘ম্যানেজ’ করে যদি কোনো রকমে
ঢোকা যায় তাহলে প্রচুর আয় হবে। রফিক মস্তানকে শেষ কিস্তির টাকাটা দিয়ে ঝুপড়ির ঘরটা তার নিজের হবে। তখন পদ্মাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে সে। তার নিজের বউ মরেছে ডেঙ্গীতে এক
বছর হলো। তারপর থেকে পদ্মাই তার দুধের শিশুর দেখভাল করে। শক্ত, আঁটসাট চেহারার
পদ্মা সর্দার স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর তাদের বস্তির একটা ভাঙা, খালি ঝুপড়িতে থাকতে আরম্ভ করে। যেমন দাপুটে, তেমনি মুখরা। তার মুখের চোপা
রফিক মস্তানের মতো দুর্দান্ত ব্যক্তিকেও চুপ করিয়ে দেয় সময় বিশেষে। শান্তশিষ্ট
নিরীহ কানুদাস তার প্রতি ভীষণ টান বোধ করে। একবার প্রথম দিকে মিনমিন করে বিয়ের কথা
পেড়েছিল কানুদাস। “যাও তো! মাথার ওপর ছাদ জোটানোর ক্ষ্যামতা নেই কো তায় বিয়া পাতার শখ!” সেই থেকে জেদ চেপে
গেছে কানুদাসের। শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চুন্নু-মুন্নীকে নিয়ে টহল দিয়ে
বেরায়। কোনোদিন ভালো রোজগার হয় তো কোনোদিন ট্যাঁক খালিই থাকে। তায়
চুন্নু-মুন্নীর খরচ। অবলা কেষ্টর জীবদু’টোর অবশ্য কোনো বায়না নেই। মালিক যা দেয়,
যেভাবে রাখে তাতেই খুশী হয়ে লাফানি, ঝাঁপানি, ডিগবাজি দেয়। বড়ো মায়া লাগে
কানুদাসের। আহা! ওরাও তো তার বাবুয়ারই মতো! দেশের বাড়ির জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে বিষাক্ত
কিছু খেয়ে মরে যাওয়া মাদী বাঁদরটার পাশ থেকে কুড়িয়ে এনেছিলো ছানা দু’টোকে। তারপর
কত বছর কেটে গেছে। ওরা এখন নাচতে পারে, নিজের হাতে কালো চশমা পড়তে পারে, সিটি দিতে
পারে, এমনকি চোখও মারতে পারে! সাবালক হয়ে গেছে!
দেখতে দেখতে বড় বিল্ডিংটার একদম সামনে চলে এলো কানুদাস। অন্যদিনের মতো আজও
সিকিউরিটি হাঁকতে আসছিল কিন্তু আজ ‘পেলান’ ঠিক করাই ছিল। চাপাস্বরে বখড়ার কথাটা আগেভাগেই সেরে ফেললো কানুদাস। অবশেষে ভেতরে
ঢুকতে পেল। একটার পর একটা খেলা দেখাতে লাগল চুন্নু-মুন্নী আর জোরে হাততালি দিচ্ছিল
বাচ্চাগুলো। কোনো কোনো মেমসাহেব একটু গাঁইগুঁই করছিল তার খেলা দেখানো নিয়ে কিন্তু
বাচ্চাদের উৎসাহ দেখে থেমে গেল। উজাড় করে খেলা দেখাচ্ছে কানুদাস আর তার শাকরেদরা।
এরা বড়লোক তাই একটাকা দু’টাকা নয়, দশটাকা, কুড়িটাকা পড়তে আরম্ভ করল খেলা শেষে।
বারান্দাগুলো থেকেও পাঁচ দশ টাকার নোট পড়ছে আর চুন্নু-মুন্নী সেগুলো লাফ দিয়ে দিয়ে
ধরছে। হঠাৎই ওপর থেকে উড়ে এলো একটা গোলাপী নো ট— দশ নয়, কুড়ি নয়,
প-ঞ্চা-শ টা-কা। কানুদাস মরিয়া লাফ লাগাল। নোট তবু তার নাগালের বাইরে থেকে গেল। গোলাপী একটুকরো মেঘ যেন উড়ে উড়ে ইশারায় তাকে ডাকছে বড় গেটের
গরাদ থেকে। প্রাণপণে ছুটলো কানুদাস। এমনই ছুটল মেঘ ধরতে যে তার দিকে বড় রাস্তা
দিয়ে ধেয়ে আসা বড় গাড়িটাকে দেখতেই পেল না।
খুব ঝামেলায় পড়েছে পদ্মা সর্দার। আগে শুধু নিজের পেট চালাতে হতো। এখন আরও
তিনটে পেট চালাতে হয়। কানু মরার পর তার ছেলেটাকে নিতে এসেছিল রফিক মস্তান। কানুর
সঙ্গে তার মিথ্যে সাঙার গল্প শুনিয়ে ছেলেটার অধিকার ছাড়েনি পদ্মা। চুন্নু-মুন্নীও
থেকে গেছে। দু’একবার জঙ্গলে ছাড়ার চেষ্টা করেছে পদ্মা। ওরা যায়নি। ছেলেটাকে ভালো
করে দেখতে পারে না পদ্মা। অনেকগুলো বাড়িতে কাজ ধরেছে। খেটে খেটে হাড়মাস কালি। প্রথমে চিন্তা
করত যে সে কাজে বেরোলে ছেলেটাকে কে দেখবে! কিন্তু চুন্নু-মুন্নী আপন
ভাইয়ের মতোই আগলে রাখে ছেলেটাকে। পদ্মা না
থাকলেও দাওয়া পার করে ঘরে ঢোকে কার সাধ্যি! তবে ইদানীং একটা ভাবনা পদ্মাকে ভাবিয়ে
তুলেছে। এত ডাগর হয়ে গেল ছেলেটা অথচ মুখে বুলি ফুটলো না। পদ্মা কথা বলার চেষ্টা
করলে সে দুর্বোধ্য কোনো ভাষায় উত্তর দেয়। সকলে বলে মানুষের সঙ্গ পায় না বলে কথা শেখেনি। পদ্মা
ঠিক করেছে একদিন ছুটি নিয়ে বড় হাসপাতালের ডাক্তার দেখাবে।
তার প্রথম অনুভূতি ছিল একজোড়া কোমল হাতের স্পর্শ। কবে কতদিন আগে তার মনে পড়ে না। তারপর ঈষৎ কর্কশ দুটো
হাত তাকে স্পর্শ করত। নাওয়াতো, খাওয়া্তো আর একটা রোমশ বুকের নিরাপদ আশ্রয়ে ঘুমোতে দিত। সেই স্পর্শও
পায় না বহুদিন। এখন একটা কড়া পড়া শক্ত হাত তার পরিচর্্যা
করে। তার ভালো লাগে না। একটা মোটা গলা তাকে অনেক কিছু বলে। স্বরের তারতম্যে সে বোঝে কোনটা আদর, কোনটা ধমক। কিন্তু তার সাড়া দিতে ভালো লাগে না। কোনও পরিচিত স্পর্শ পায়
না সে। তার আপনজনরা অন্যরকম। তাদের বুক রোমশ। তাদের গা থেকে অনেক কালের ফেলে আসা,
ভুলে যাওয়া গন্ধের ঝলক কখনও সখনও আসে। তারা শাসন জানে না, করে না। তারা তার মতো। হামা দিলে হামা। হাসলে হাসি। ভয়
পেলে, কাঁদলে প্রবোধ। ও তাদের হাত ধরে হাঁটতে শিখেছে। ওর দুর্বোধ্য আদেশ, অনুজ্ঞা,
আব্দার শুধু ওরাই বোঝে। আকারে, ইঙ্গিতে, নিজস্ব ভাষায় ওর আর ওর আপনজনদের এক নিভৃত,
সুরক্ষিত জগৎ আছে। সেখানে কারুর অনুপ্রবেশ চলে না। একেবারেই চলে না।
একদিন বাসায় ফিরে বাসা ফাঁকা দেখে ভয়ে প্রাণ উড়ে গেল পদ্মার। চিৎকার, চেঁচামেচি,
খোঁজ খোঁজ। হইহই রব পড়ে গেল চারদিকে। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না, এমনকি রফিক
মস্তানের ডেরাতেও না।
তখন বসতি থেকে অনেক দূরের একটা বড় রাস্তা দিয়ে
হেঁটে চলেছিল এক অদ্ভুত মিছিল। তিনটি প্রাণী — তাদের একটার গলায় একটা
ময়লা ঝোলা; চলার ছন্দে ঝোলার ভেতর থেকে অদ্ভুত আওয়াজ বের হচ্ছে। ধুক-ধুক... ধুক-ধুক...। যেন ঝোলার ভেতর
বন্দী হয়ে আছে একটা মানুষের হৃদপিণ্ড। তারপর একটা ফাঁকা ফুটপাথে খেলা শুরু হলো। খেলার ধরন এমনই যে, কিছুক্ষণের মধ্যে রাস্তায় সব
বয়সী মানুষের ভিড় জমে গেল। বড়ই আজব সে খেলা! রাস্তার
কালভার্টের ওপর বসে ডুগডুগি বাজাচ্ছে একটা বাঁদর আর তার তালে তালে ডিগবাজী খাচ্ছে বছর কয়েকের এক শিশু!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন