শুক্রবার, ২২ মে, ২০১৫

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

উইলফ্রেড ওয়েন


কী লিখব ভাবছি! সমস্ত অক্ষর জানা নেই, জীবনের সব পাঠ জানা নেই- এই  অসম্পূর্ণতা আমার মজ্জাগত।
যুদ্ধক্ষেত্রে মারাত্মক আহত সৈনিক উইলফ্রেড ওয়েন, যাঁকে একদা মৃত ভাবা হয়েছিল, সূর্যই যেন তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো প্রাণ। তার পরেও যুদ্ধে গেছেন।  বাঙ্কারে বসে শেল বৃষ্টির মধ্যে কবিতা লিখে চলেছেন যুদ্ধবিরোধী তরুণ লেফটেন্যান্ট। যুদ্ধ করা তাঁর বাধ্যবাধকতার দায়িত্ব অথচ তিনি যুদ্ধবিরোধী। আশ্চর্য! তাঁরই শৈলীতে লেখার চেষ্টা করে তাঁকেই প্রণাম জানাই।

আচমকা গোলা ফাটল-
ধুলো ধোঁয়া ধূসরিত চতুর্দিক।
সূর্যের তাপে উত্তপ্ত করি তোমাকে,
নিঃস্পন্দ শরীরে দেখা দিতে পারে প্রাণের লক্ষণ,
এ এমন অসম্ভব কি,
সূর্যই তো বীজ থেকে মহীরুহ গড়ে নিজস্ব উত্তাপে,
ফিরিয়ে দিতে পারে সব প্রাণ!

কী লিখব ভাবছি!
আমার অসম্পূর্ণতা মজ্জাগত
সমস্ত বেড়া কেউ ডিঙ্গোতে পারে নি,
জানি না কীভাবে বেঁচেছ লিখেছ,
যুদ্ধ বিরোধী চির তরুণ উইলফ্রেড ওয়েন,
পঁচিশ বছরে থেমে গেছে বয়েস।

ইংরেজ কবি Wilfred Edward Salter Owen MC (18 March 1893 – 4 November 1918) যুদ্ধক্ষেত্রে অসমসাহসিকতার জন্য মিলিটারি ক্রস সম্মান পেয়েছিলেন। সময়টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন। ভয়াবহতার বাস্তব চিত্রায়ন ঘটেছে তা লেখায় বারংবার। ট্রেঞ্চের জীবন, গ্যাস যুদ্ধ তার ওপর যথেচ্ছ প্রভাব বিস্তার করেছে। সে সময়ে বা সসময়েই যে যুদ্ধোন্মাদনাকে বারংবার মহিমান্বিত করা হয়, প্রতিরক্ষার দোহাই দিয়ে ভিনদেশ এবং সাধারণ জনতার ওপর অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চাপিয়ে দেওয়া হয়, ওয়েন তার বারবার বিরোধিতা করেছেন। ড্রয়িংরুমের আরামে বসে লেখা তথাকথিত দেশাত্মবোধক কাব্যসাহিত্যের ওপর লড়াইয়ের ময়দান থেকে বাস্তব সৈনিকের এ এক সজোর চপেটাঘাত। তার জনপ্রিয় কবিতাগুলির অন্যতম "Dulce et Decorum est",  "Insensibility", "Futility" এবং "Strange Meeting". এছাড়াও রয়েছে বিখ্যাত সেই Spring Offensive কবিতাটি। এই লেখার উদ্দেশ্য ওয়েনকে কিছুটা বোঝার চেষ্টা। তাঁর কবিতাগুলোর অনুবাদ হয় না, কোনো কবির কবিতারই সেই অর্থে  ভাষান্তর কঠিন। সে চেষ্টাও আমি করিনি। যতটা করেছি, তা কেবলমাত্র ওয়েনকে বোঝার জন্যই করেছি।

Dulce et decorum est pro patria mori:/mors et fugacem persequitur virum/nec parcit inbellis iuventae/ poplitibus timidove tergo.
রোমান কবি এবং সমালোচক হোরেসের এই ল্যাটিন কবিতার ইংরেজি অর্থ How sweet and honourable it is to die for one's country:/ Death pursues the man who flees,/ spares not the hamstrings or cowardly backs/ Of battle-shy youths.

এক কথায় -- অহো দেশমাতৃকার কারণে মরণ কী মধুর গৌরবময়, যতই ভীত  হও পালাবার উপায় নাই। এই মহিমান্বয়ন এবং যুদ্ধের বাধ্যবাধকতাকেই ওয়েন আক্রমণ করেছেন। বোঝাতে চেয়েছেন কতিপয়ের যুদ্ধবিলাস সাধারণের কী অসহায় সর্বনাশ!

DULCE ET DECORUM EST
Bent double, like old beggars under sacks,
Knock-kneed, coughing like hags, we cursed through sludge,
Till on the haunting flares we turned our backs
And towards our distant rest began to trudge.
Men marched asleep. Many had lost their boots
But limped on, blood-shod. All went lame; all blind;
Drunk with fatigue; deaf even to the hoots 
Of tired, outstripped Five-Nines that dropped behind.
Gas! Gas! Quick, boys! – An ecstasy of fumbling,
Fitting the clumsy helmets just in time;
But someone still was yelling out and stumbling,
And flound'ring like a man in fire or lime . . .
Dim, through the misty panes and thick green light,
As under a green sea, I saw him drowning.
In all my dreams, before my helpless sight,
He plunges at me, guttering, choking, drowning.
If in some smothering dreams you too could pace
Behind the wagon that we flung him in,
And watch the white eyes writhing in his face,
His hanging face, like a devil's sick of sin;
If you could hear, at every jolt, the blood
Come gargling from the froth-corrupted lungs,
Obscene as cancer, bitter as the cud 
Of vile, incurable sores on innocent tongues,
My friend, you would not tell with such high zest 
To children ardent for some desperate glory,
The old Lie; Dulce et Decorum est
Pro patria mori.

ক্রমাগত যুদ্ধ মানুষকে ভোঁতা করে দেয়। এমনকি দুঃখ কষ্ট বোধ করার সূক্ষ্মতাও হারিয়ে যায়। ইনসেনসিবিলিটি কবিতাটি একটি দিক নির্দেশকারী সাহিত্যকৃতি।

Insensibility

I
Happy are men who yet before they are killed
Can let their veins run cold.
Whom no compassion fleers
Or makes their feet
Sore on the alleys cobbled with their brothers.
The front line withers,
But they are troops who fade, not flowers
For poets’ tearful fooling:
Men, gaps for filling:
Losses, who might have fought
Longer; but no one bothers.

II
And some cease feeling
Even themselves or for themselves.
Dullness best solves
The tease and doubt of shelling,
And Chance’s strange arithmetic
Comes simpler than the reckoning of their shilling.
They keep no check on armies’ decimation.

III
Happy are these who lose imagination:
They have enough to carry with ammunition.
Their spirit drags no pack.
Their old wounds, save with cold, can not more ache.
Having seen all things red,
Their eyes are rid
Of the hurt of the colour of blood forever.
And terror’s first constriction over,
Their hearts remain small-drawn.
Their senses in some scorching cautery of battle
Now long since ironed,
Can laugh among the dying, unconcerned.

IV
Happy the soldier home, with not a notion
How somewhere, every dawn, some men attack,
And many sighs are drained.
Happy the lad whose mind was never trained:
His days are worth forgetting more than not.
He sings along the march
Which we march taciturn, because of dusk,
The long, forlorn, relentless trend
From larger day to huger night.

V
We wise, who with a thought besmirch
Blood over all our soul,
How should we see our task
But through his blunt and lashless eyes?
Alive, he is not vital overmuch;
Dying, not mortal overmuch;
Nor sad, nor proud,
Nor curious at all.
He cannot tell
Old men’s placidity from his.

VI
But cursed are dullards whom no cannon stuns,
That they should be as stones;
Wretched are they, and mean
With paucity that never was simplicity.
By choice they made themselves immune
To pity and whatever moans in man
Before the last sea and the hapless stars;
Whatever mourns when many leave these shores;
Whatever shares
The eternal reciprocity of tears.

শরীরে রক্তের শিরা থেকে যারা উত্তাপ সরিয়ে দেয়, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত যারা সহানুভূতিতে আক্রান্ত হয় না, তারা ভালো থাকে। আমরা বুঝতে পারি, এই কবি  যাদের কথা বলছেন, তারা এক অপসৃয়মান সেনাদল, সাধারণ কবিকুলের উপজীব্য  ফুলের বাগান নয়। সময় মনে রাখতে হবে- উনিশ শতকের একেবারেই শুরুর দিক। রোমান্টিক আর ভিক্টোরিয়ান কবিতার ধারাবাহিকতা কাটিয়ে এই ধরনে লেখা সত্যিই এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। যদিও কবি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক তথাপি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ঠাণ্ডা লড়াই, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের লড়াই- এগুলোর বীভৎসতা তখনও আসেনি। তবুও তিনি তার কবিতায় বুঝিয়েছেন সৈনিকের নিধন  এক পূরণযোগ্য ক্ষতি এবং তাদের মৃত্যুর হিসেব কেবল সংখ্যার ব্যাপার। তাদের জন্য কারও মাথাব্যথা নেই। সৈনিকেরাও আবেগবর্জিত। নিজেদের নিয়েও ভাবে না, অন্যদের নিয়েও নয়। এরা বেঁচে থাকে ভবিতব্যের ভরসায়, কোথায় কখন শেল ফাটবে তা নিয়ে পরোয়া করে না

কল্পনাবিহীন মানুষ সত্যিই সুখী। বহন করার পক্ষে কল্পনাশক্তি প্রচণ্ড ভারি, এমনিতেই বন্দুক গোলাগুলি আর রসদের গুরুভার সৈনিককে বহন করতে হয়। পুরনো ক্ষত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। রক্ত দেখে চিত্তবৈকল্য ঘটে না, প্রচুর লাল রঙ দেখেছে সৈনিক। ভীতি নামক বস্তু অবলুপ্ত চেতনা ইস্পাত কঠিন। অজস্র মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সৈনিক হাসতে পারে। তারা কামানের গোলার মুখে দাঁড়িয়ে থাকে পাথরের টুকরোর মতোসৈনিক ভাবে না, সে মারা গেলে কেউ কাঁদবে কিনা।

১৯১৮র এপ্রিলে লেখা ইনসেনসিবিলিটি কবিতাটি ওয়েনের একটি দীর্ঘ কবিতা এবং মোটের ওপর তার নিজস্ব জীবনদর্শন।
পরের আলোচ্য কবিতা ফিউটিলিটি বা ব্যর্থতা 

Futility

Move him into the sun—
Gently its touch awoke him once,
At home, whispering of fields half-sown.
Always it woke him, even in France,
Until this morning and this snow.
If anything might rouse him now
The kind old sun will know.

Think how it wakes the seeds—
Woke once the clays of a cold star.
Are limbs, so dear-achieved, are sides
Full-nerved, still warm, too hard to stir?
Was it for this the clay grew tall?
—O what made fatuous sunbeams toil
To break earth's sleep at all?

কবি বলেন, সূর্যের কাছে নিয়ে চল আমাকে। সূর্য তাকে জাগিয়েছে। সর্বদা কী  স্বদেশে ইংল্যান্ডে কী বিদেশে ফ্রান্সে। কিন্তু এই শীতার্ত তুষারাবৃত সকালে সূর্য তাকে  জাগায়নি। কিন্তু সূর্যই পারে, যেমন পারে বীজকে জাগিয়ে মহীরুহে পরিণত করতে বা জাগাতে পারে ঠাণ্ডা নক্ষত্রের মাটিকে। মানুষের শরীর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদি এখনো উষ্ণ। এখনো সে মৃত হয়ে কঠিন হয়ে যায়নি। সূর্যই বাঁচাতে পারে তাকে। কিন্তু তাও হয় না। সূর্য হেরে যায়।

এই কবিতার দ্বিতীয় স্তবকের অন্ত্যমিল লক্ষণীয়। এটা এখানে সামান্য উচ্চারণ  বিচ্যুতি নিয়ে ঘটছে। যেমন stir/star বা tall/ toil. কবিতার প্রারম্ভিক আশাবাদ সূর্য নির্ভরতাও মিলিয়ে যাচ্ছে দ্বিতীয় স্তবকে। কবি মেনে নিচ্ছেন সূর্যের ব্যর্থতা। মৃতকে আর সে জাগাতে পারছে না। অন্ত্যমিলের বিঘ্ন যেন কবির হতাশা আর অন্যমনস্কতাকেই তুলে ধরছে। পরের কবিতা

Strange Meeting

It seemed that out of battle I escaped
Down some profound dull tunnel, long since scooped
Through granites which titanic wars had groined.

Yet also there encumbered sleepers groaned,
Too fast in thought or death to be bestirred.
Then, as I probed them, one sprang up, and stared
With piteous recognition in fixed eyes,
Lifting distressful hands, as if to bless.
And by his smile, I knew that sullen hall,—
By his dead smile I knew we stood in Hell.

With a thousand fears that vision's face was grained;
Yet no blood reached there from the upper ground,
And no guns thumped, or down the flues made moan.
“Strange friend,” I said, “here is no cause to mourn.”
“None,” said that other, “save the undone years,
The hopelessness. Whatever hope is yours,
Was my life also; I went hunting wild
After the wildest beauty in the world,
Which lies not calm in eyes, or braided hair,
But mocks the steady running of the hour,
And if it grieves, grieves richlier than here.
For by my glee might many men have laughed,
And of my weeping something had been left,
Which must die now. I mean the truth untold,
The pity of war, the pity war distilled.
Now men will go content with what we spoiled.
Or, discontent, boil bloody, and be spilled.
They will be swift with swiftness of the tigress.
None will break ranks, though nations trek from progress.
Courage was mine, and I had mystery;
Wisdom was mine, and I had mastery:
To miss the march of this retreating world
Into vain citadels that are not walled.
Then, when much blood had clogged their chariot-wheels,
I would go up and wash them from sweet wells,
Even with truths that lie too deep for taint.
I would have poured my spirit without stint
But not through wounds; not on the cess of war.
Foreheads of men have bled where no wounds were.

“I am the enemy you killed, my friend.
I knew you in this dark: for so you frowned
Yesterday through me as you jabbed and killed.
I parried; but my hands were loath and cold.
Let us sleep now. . . .”

এখানে কবির সঙ্গে এক মৃত সৈনিকের কাল্পনিক কথোপকথন লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই সৈনিককে একদা কবিই হত্যা করেছিলেন যুদ্ধ চলাকালীন। সৈনিক কবিকে চরম শান্তির ঘুমে আহ্বান জানাচ্ছেন। এই সৈনিক যেন কবিরই দ্বিতীয় সত্তা বা অল্টার ইগো। আরও একটি লক্ষণীয় বিষয়, মৃত্যুর পরে শত্রু আর শত্রু থাকে না। তাই  শত্রু এবং সৈনিক একে অন্যের সঙ্গে মিলে যাচ্ছেন বা সম্পূর্ণ হচ্ছেন।

এই কবিতার আর এক কারিগরি বৈশিষ্ট্য ওয়েনের সেই বিখ্যাত বিঘ্নিত অন্ত্যমিল বা প্যারারাইম। অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে এখানে ব্যঞ্জনবর্ণগুলো মেলানো হচ্ছে, শব্দ বা স্বরবর্ণ নয়। ভাবা যায়! কত বছর আগে এক সৈনিক কবি ওয়েন যুদ্ধক্ষেত্রে বসে কবিতার আধার এবং আধেয় নিয়ে এত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যাচ্ছেন! আলোচনার শেষ কবিতা--  

Spring Offensive.

Halted against the shade of a last hill,
They fed, and, lying easy, were at ease
And, finding comfortable chests and knees
Carelessly slept. But many there stood still
To face the stark, blank sky beyond the ridge,
Knowing their feet had come to the end of the world.
Marvelling they stood, and watched the long grass swirled
By the May breeze, murmurous with wasp and midge,
For though the summer oozed into their veins
Like the injected drug for their bones' pains,
Sharp on their souls hung the imminent line of grass,
Fearfully flashed the sky's mysterious glass.

Hour after hour they ponder the warm field –
And the far valley behind, where the buttercups
Had blessed with gold their slow boots coming up,
Where even the little brambles would not yield,
But clutched and clung to them like sorrowing hands;
They breathe like trees unstirred.

Till like a cold gust thrilled the little word
At which each body and its soul begird
And tighten them for battle. No alarms
Of bugles, no high flags, no clamorous haste –
Only a lift and flare of eyes that faced
The sun, like a friend with whom their love is done.
O larger shone that smile against the sun, --
Mightier than his whose bounty these have spurned.
So, soon they topped the hill, and raced together
Over an open stretch of herb and heather
Exposed. And instantly the whole sky burned
With fury against them; and soft sudden cups
Opened in thousands for their blood; and the green slopes
Chasmed and steepened sheer to infinite space.

Of them who running on that last high place
Leapt to swift unseen bullets, or went up
On the hot blast and fury of hell's upsurge,
Or plunged and fell away past this world's verge,
Some say God caught them even before they fell.

But what say such as from existence' brink
Ventured but drave too swift to sink.
The few who rushed in the body to enter hell,
And there out-fiending all its fiends and flames
With superhuman inhumanities,
Long-famous glories, immemorial shames –
And crawling slowly back, have by degrees
Regained cool peaceful air in wonder –
Why speak they not of comrades that went under?

রণক্লান্ত সৈনিকেরা পাহাড়ের ছায়ায় থমকে যায়। আহার্য গ্রহণ করে। তাদের বিধ্বস্ত ক্লান্ত শরীর- হাঁটু আর বক্ষ স্বাভাবিক বিশ্রাম পায়। নিশ্চিন্ত ঘুমে তারা তলিয়ে যায়। কিন্তু পাহাড়ের আড়ালের ন্যাড়া আকাশের দিকে তাকিয়ে পাহারায় থাকে বাকী সৈনিকেরা। তারা জানে, তাদের পা স্পর্শ করেছে পৃথিবীর প্রান্তভূমি। বিস্মিত  আনন্দে প্রকৃতি দর্শনে, পতঙ্গের গুঞ্জন সম্পৃক্ত মে মাসের বাতাসে আন্দোলিত সুদীর্ঘ ঘাসের শোভায় তারা মোহিত হয়ে থাকে।

ক্রমশ তারা তাদের অনুভূতির গভীরে অধিকতর প্রবিষ্ট হতে থাকে। অতিক্রান্ত উপত্যকার ফুলেরা তাদের জুতোয় স্বর্ণরেণু ছড়িয়ে দিয়েছে। ছোট ফুল গাছের কাঁটা ঝোপেরা আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে। যেন পা জড়িয়ে বলেছে দাঁড়াও- আর যেও না!  
হঠাৎ শান্ত বাতাসে যুদ্ধ নেমে আসে। আচমকা শীতল হাওয়ার ঝাপটা আসে। একটি শব্দের ইঙ্গিতেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ফুল এবং ঔষধি গাছের উন্মুক্ত প্রান্তরে সৈনিকেরা ছুটতে থাকে। আকাশ জ্বলে যায় তাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিষোদ্গারে। নরম ফুলের হাজার হাজার কলিরা খুলে যায় তাদের রক্তের ফোঁটা ধারণ করবে বলে।
 
যারা বেঁচে থাকে তারা মৃতদের কথা আর বলে না।

এই কবিতায় ঝড়ের আগের শান্তিকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মানুষ কীভাবে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাচ্ছে, গাছের মতো স্থির হয়ে শ্বাস নিচ্ছে, তা  বলা হয়েছে। “breathe like trees unstirred". এই পাহাড় যে শেষ পাহাড় তা বলা হচ্ছে, সতর্ক প্রহরা জারি থাকছে অর্থাৎ বিপদ কোথাও লুকিয়ে আছে। মে মাসের উষ্ণ বাতাস পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর শীতল ঝাপটায়। প্রকৃতির বর্ণনার সঙ্গে যুদ্ধের বীভৎসতা এবং সাসপেন্স তথা ফেলে আসা নস্টালজিয়া মিলেমিশে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

উইলফ্রেড ওয়েন এক দক্ষ শিল্পী। একবার প্রচণ্ড আহত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেছিলেন। সেনাবাহিনীর হাসপাতালের চিকিৎসার গুণে সুস্থ হয়ে ওঠেন। হাসপাতালের জার্নালে নিয়মিত কবিতা লিখে গেছেন। যুদ্ধের বীভৎসতা, যুদ্ধের প্রতি মানুষের অসহায় আত্মসমর্পণের কথা, মৃত্যুর কথা ফুটিয়ে তুলেছেন দক্ষতায় এবং পরিশীলিত আবেগে। সুস্থ হয়ে পদোন্নতি নিয়ে আবার যুদ্ধে ফিরে যান ওয়েন।

৪ঠা নভেম্বর ১৯১৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ আগে  পশ্চিম ফ্রন্টে ফ্রান্সের Sambre–Oise Canal এলাকায় নিহত হন ওয়েন। তাঁর মা ওয়েনের মৃত্যুর খবর যখন পান, তখন যুদ্ধ থেমে গেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন