এডগার অ্যালান পো ও
মৃত্যুকামুকতা - একটি অননুমেয় উদ্ভাস
মৃত্যুর প্রতি কোনো মানুষের ক্রমস্ফুরিত
আনুগত্যকে আমরা কী বলব? অসুস্থতা! বিকৃতি!
নাকি, জীবন - সে আগাগোড়াই মৃত্যুর আদিম উচ্চাঙ্গে ঘন, সুগ্রথিত। এডগার
অ্যালান পো-র সার্বিক সাহিত্যকল্পে জীবন যখন উদ্বৃত্ত আর মৃত্যু দানবিক তখন বারবার
এ সামান্য প্রশ্নই আমাদের তাড়া করে ফেরে। একটি সাধারণ ব্যক্তি ও তার উত্তরব্যক্তি সাহিত্যিক সত্তাকে মিলিয়ে
দেখতে গিয়ে চোখের সামনে ভেঙে পড়ে জীবনের নিয়মিত সংজ্ঞা আর গড়ে ওঠে এক অস্পষ্ট
পৃথিবী; যার অত্যন্ত ঘরোয়া অবধি পৌঁছতে গেলে আমাদের ভিস্যুনারি ফ্যান্সি বা
ইমাজিনেশনকে নিয়ে যেতে হবে পো-এর যাপনের আরও কিছুটা মাইক্রোন্যারেটিভে। পো-এর মতো একজন মৃত্যুর নেশাখোর লেখকের সার্বিক সন্ধিসূত্র পেতে গেলে ফিরে
যেতে হবে কিছু সংশয়ী প্রশ্নের কাছে। ছোট খাটো এবড়ো খেবড়ো
প্রাথমিক বিচ্যুতিগুলোর কাছে। আলো ফেলতে হবে পো-এর ব্যক্তিগত জীবনের ওপরে
কিছুটা, যেখানে কোথাও কেবল
এক হেরে যাওয়া তাড়িত করছে একটি জীবনকে জীবনের বিরুদ্ধে মধুর প্রতিশোধ নিতে, প্রাত্যহিক
পরিত্যক্ততা উসকে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত যাপনের উদাসীনতাকে। জীবন এক ডাল থেকে অন্য ডালে
দৌড়ে বেড়ালেও মৃত্যু যেন তাকে ধরে ফেলছেই। যাপনের পরিহাস থেকে সাদা
পোশাকে উঠে আসছে মৃত্যুর মতো এক ট্রাজিক ক্যাথারিসিস। পো-এর অধিকাংশ গল্পেই আঁকড়ে ধরার অসহয়তা থেকেই মৃত্যু
উঠে আসছে এক চরম প্রতিস্পর্ধী হয়ে। “I
was sick-sick unto death with that long agony; and when they at length unbound
me, and I was permitted to sit, I felt that my senses were leaving me. The
sentence-the dread sentence of death-was the last of distinct accentuation
which reached my ears”- তার গল্পে যে লোকগুলো পাঁচ ফুট মাটি খুঁড়ে
ফেলছে মানুষের পবিত্র গুঞ্জন লুকিয়ে রাখতে, ছয় ঋতুর চিহ্ন লুকিয়ে রাখতে সে লোকগুলোই
শেষপর্যন্ত হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ছে বিস্মৃত গর্তের হাঁ মুখ খোলা রেখে, হাত থেকে কোদালগুলো
ফেলে রেখে। জীবন মৃত্যুর একটা অ্যালুশান অফ চেন-জীবন মৃত্যু মৃত্যু জীবন- পো যেন দু’ হাতে মিশিয়ে
দিচ্ছেন ভবচক্রের প্রশ্নগুলোকে আর
বিড়বিড় করছেন, অনুপস্থিতির ভেতর দিয়েই অনুভূতির প্রতিলিপি খুঁজে চলেছেন...
আসলে পো-এর পীড়া ক্লান্তি আঘাত আনন্দ প্রহেলিক অথবা প্রত্যক্ষ সব কিছুই একটা অসুখের
বাতাবরণে একটা পোকায় কাটা প্রতীত সময়ে একটা ইনভ্যালিড স্ট্রাগলের সাজগোজে বেড়ে ওঠা।
১৮৪১এ তাঁর সাহিত্য তত্ত্ববধায়ক রাফাস উইলমট
গ্রিসওল্ডের কাছে পো পাঠিয়ে দেন
তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী, যা থেকে জানা যায়
মাত্র আড়াই বছরেই ক্ষয়রোগে ভ্রাম্যমান
নাট্যকর্মী মা বাবাকে হারান পো আর তারপর থেকেই তাঁর আশ্রয় ভার্জিনিয়ার তামাক ব্যবসায়ী জন
এ্যালানের বাড়িতে। দত্তক পিতা হলেও আইনসম্মত দত্তক নেননি এ্যালান
কোনোদিনই, আর দত্তক পিতার সাথে
সম্পর্কের অবনতি ক্রমাগত তাঁকে একা করে তোলে, সহায়হীন সম্বলহীন
উচ্ছৃংখল জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তোলে। ১৮২৮এ জ়েফার্সন
বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে আসেন পো ঋণের বোঝা নিয়ে যা মেটাতে অস্বীকার করেন জন
এ্যালান, বাড়ি থেকে পালিয়ে যান পো, যন্ত্রণার কষ্টিপাথরে
ক্রমাগত যাচাই হতে থাকে তাঁর যাপন। উইলমট গ্রিসওল্ডকে পাঠানো তাঁর জবানীতে পো বলছেন-“Mr
A refused to pay some of the debts of honor, and I ran away from home without a
dollar on a quixotic expedition to join the Greeks, then struggling for
liberty”। এ কোন দৌড়? কোন স্বাধীনতার! নাকি জীবন থেকে
স্বেচ্ছা নির্বাসনের! পরবর্তীকালে তাঁর একাধিক চরিত্ররা যখন মৃত্যুর দিকে তাদের ‘ম্যাজিক ল্যান্টার্ণ’ জ্বালিয়ে রাখে তখন টের পাই
একজন মৃত্যুহীন লেখক অনেক আগেই মৃত্যুর সবকটা জানালা খুলে রেখেছিলেন
তাঁর ঘরে। শুরু থেকেই পো-এর জীবনে আমরা এই অস্থিতি
লক্ষ্য করতে পারি, ভাড়াবাড়ির দরজা খুলে
সম্পূর্ণ ফাঁকা রাস্তাগুলির দিকে বারবার বেড়িয়ে পড়া। ১৮২৯এ পো ফিরে আসেন
পুনরায় কিন্তু ততদিনে বিমাতা মিসেস এ্যালান মারা গেছেন এবং জন এ্যালান পুনরায় বিয়ে
করেছেন পঁয়ষট্টি বছর বয়সে। ঝগড়া হতো দত্তক বাবার সাথে, তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের
স্ত্রীর সাথে, সারা বাড়ি ঘৃণা আর
বিতৃষ্ণার গন্ধে তীব্র হয়ে উঠত। পো-এর সার্বিক জীবনেই
এই লড়াই এই ছটফটানি। চল্লিশ বছরের এক দারিদ্র্য বিধ্বস্ত সাহিত্যিক
জীবন যার কৈশোর ও বয়ঃসন্ধি রিচমন্ডের
থেকেই জীবনের সম্ভাবনা খুঁজে ফিরেছে বারবার আর বারবার আতসবাজীর মতো জ্বলে গেছে আনন্দের
সাময়িকীগুলো, তার শেষ নিভৃত
নিশ্চিত বোধহয় স্ত্রী ভার্জিনিয়ার সমাধির পাশে বাল্টিমোরে শুয়ে থাকা, তাঁর অন্তিম
অনুরণনগুলো সেখানেই স্থির সেখানেই মৃত্যুত্তীর্ণ, সেখানেই শুয়ে আছে একক আর
বিস্তীর্ণ হয়ে। দাঁড়ানোর জায়গা যে পাননি পো, স্রেফ দৌড়ে গেছেন একটা সহযোগিতাময় দৃশ্যের জন্য
আর আঘাত তালিকায় উঠে এসেছে তাঁর নাম, অন্ধকার উৎসবে উঠে এসেছে তাঁর নাম। শুরু থেকেই অভিভাবকদের রোমাঞ্চকর ভাবপ্রবণ নাটকের শিকার পো। শৈশবের এক বিরূপ
বিকৃত আর আতংকিত সংস্করণ। এডগার পো-এর প্রকৃত বাবা এবং মা
ডেভিড ও এলিজাবেথ পো দুজনেই ছিলেন নাট্যকর্মী। মাত্র ২১ বছরের
জীবনে এলিজাবেথ চাঞ্চল্য ফেলে দিয়েছিলেন ‘দ্য মিস্ট্রি অফ দ্য ক্যাসেল’ নাটকে তাঁর অভাবনীয় অভিনয়ের
জন্য। মৃত্যুর আগে দু’ দুবার বিয়ে
করেছিলেন, প্রসব করেছিলেন তিন
তিনটে সন্তান। যেহেতু সে সময়ের
আমেরিকায় একজন পুরুষের আশ্রয়ে থাকাই ছিল মহিলাদের সামাজিক সুরক্ষার নির্ধারক, তাই ১৮০৫এ
প্রথমপক্ষের স্বামী হপকিনস মারা যাওয়ার পর এলিজাবেথ বিয়ে করেন তাদেরই নাট্য
সংস্থার অপর কর্মী ডেভিড পো কে। তবে কোনো অংশেই নাট্যগুণে ডেভিড এলিজাবেথের
উচ্চতার ছিলেন না যা ক্রমাগত সাংসারিক কোঁদলের
কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৮০৭এ তাঁদের প্রথম সন্তান
উইলিয়াম হেনরি আর ১৮০৯এ
এডগার পো। ১৮১০এ ডেভিড-এর শেষ অভিনয়ের তথ্য
পাওয়া যায় ‘Grieving’s a Folly’ নাটকে এবং তারপর
থেকে পো-এর প্রকৃত পিতা সম্পর্কে আর
কোনও বৈধ নথি নেই। এক নিঁখোজ কাহিনীর মতো সংশয়ী হয়ে থেকে যায় পো-এর জীবনের এই
অধ্যায়। কেউ কেউ বলেন, অক্টোবর ১৮১০এ
ডেভিড পো-এর মৃত্যুর কথা, কিন্তু সেটাও
অনিশ্চিত। ধারণা নির্ভর।
শৈশব থেকেই পো-এর প্রথাবিরুদ্ধ
ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার পেছনে, ইনএ্যাডিকোয়েট
সাইকোপ্যাথের পেছনে সমাজ ও মানুষের এই ত্যাজতা অবশ্যই অন্যতম কারক। এলিজাবেথ সংঘাত করে
গেছেন। রিচমন্ড থেকে
শার্লটন হয়ে নরফ্লক দৌড়ে গেছেন তাঁর নাটক তাঁর সন্তানদের নিয়ে, চেহারা ভেঙে গেছে, মানসিক অবক্ষয় এসেছে। ২৯এ নভেম্বর ১৮১১, স্থানীয় সংবাদপত্রে ‘টু দ্য হিউমেন হার্ট’ শীর্ষক বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ
পায়- “Mrs
Poe, lingering on the bed of disease and surrounded by her children, asks your
assistance and asks it perhaps for the last time”। সাহায্যের হাত ক’টা এগিয়েছিল সে সম্পর্কে
জানা যায় না, তবে শেষের কয়েকটা লাইনের
সত্যতা প্রমাণ করে যায় ১৮১১এর বিচ্ছিন্ন
তীব্রতাহীন ডিসেম্বর। মারা গেলেন এলিজাবেথ। এ অবধিই বলা যেতে পারে পো-এর প্রকৃত শৈশব, তার পরেরটুকু মেনে
নেওয়ার গল্প মানিয়ে নেওয়ার গল্প। থেমে যাওয়া শৈশব থেকেই উঠে
এসেছে পো-এর বাক্সবন্দী স্বপ্ন, রুঢ় বাস্তবতা আর
পৃথিবীর মতো এক বধ্যভূমিতে তিনি যেন সারাজীবন দাঁড়িয়ে ছিলেন
সেই একখন্ড স্বপ্নের তাগিদে আর তাই ছিল মৃত্যুকে দেওয়া তাঁর জীবনের একমাত্র উপহার। “elenora”তে পো বলেছেন- “They
who dream by day are cognizant of many things which escape those who dream only
by night. In their gray visions they obtain glimpses of eternity, and thrill,
in waking, to find they have been upon the verge of the great secret”। গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে পো–এর এই স্বপ্নকাণ্ড এই শূন্য
ভ্রমণ। নোনা মাংস থেকে যন্ত্রণা থেকে উঠে এসেছে ‘স্বপ্ন হয়ে মৃত্যুকে অতিক্রম করার’ খেলা। মনোবিজ্ঞানী ইয়ুং বয়ঃসন্ধি
কালের যে সাইকিক বার্থের
ধারণা দিয়েছেন, পো কোথাও তাঁর শৈশবেই এসে পড়েছিলেন সেই
নিঃসঙ্গতার কাছাকাছি, সেই পরিত্যজতা সেই
বর্জন তাঁর আচরণে গড়ে তুলেছিল জীবনধারণ সম্পর্কে একটা
সাইনাইড পৃথিবী, ‘তীব্র বেগে লম্বা
লম্বা দৌড়ে’ যা বার বার হারিয়ে দিয়েছে পো-কে। একা ফেলে দিয়েছে।
ইয়ুংএর তথ্যই হলো মানুষের আচরণ কোনো সম্ভাবনাকে মাথায় রেখেই বেড়ে ওঠে
অর্থাৎ প্রতিটা আচরণের লক্ষ্য থাকে, উদ্দেশ্যকে বাদ দিয়ে
কোনো আচরণ হয় না, যা ফ্রয়েডের
যান্ত্রিক আচরণ বা অহং দ্বারা পরিচালিত আচরণের থেকে ভিন্ন, সেখানে দাঁড়িয়েই
আমাদের মনে হতে পার্ শৈশব থেকেই পো তাহলে কোন
সম্ভাবনার তাগিদ খুঁজেছিলেন? আঁকছিলেন কোন সাজঘরের দেওয়াল? শৈশবকালীন বাসনায় পো-এর সহচর বলতে এক তাল
শূন্যতা, এক তাল সাদা কাগ্ যেখানে কল্পনার
মাধ্যমে লুকিয়ে রাখা অদম্য ভালোবাসার পিপাসা, শিশুকালের সুপ্ত
স্নায়ুতে লুকিয়ে থাকা অবদমিত বাসনাকুসুম, যা বারবার কিশোর যুবক বা পূর্ণবয়সের পো-এর চোখ বন্ধ করে ঘর অন্ধকার
করে হারিয়ে গিয়েছে অভিজ্ঞতার নির্লিপ্ত উদাসীন জগতে। স্পর্শ বর্ণ রং সবই
সেখানে দূরপ্রবাসী, সবই সেখানে নিলামে
উঠেছে শৈশবের নিরাপত্তাহীন এক বিযুত মিশ্রণের জগতে। ‘Alone’ কবিতাতে পো-এর মানসিক দ্বন্ধতার বা
শৈশবকালীন এই অসম্পূর্ণতার এক সম্পূর্ণ ছবি আমরা পাই- “From
childhood’s hour I have not been /As others were—I have not seen /As others
saw—I could not bring /My passions from a common spring— /From the same source
I have not taken /My sorrow—I could not awaken /My heart to joy at the same
tone—/And all I lov’d—I lov’d alone— /Then—in my childhood—in the
dawn /Of a most stormy life—was drawn/From ev’ry depth of good and ill /The
mystery which binds me still— /From the torrent, or the fountain— /From the red
cliff of the mountain— /From the sun that ’round me roll’d /In its autumn tint
of gold— /From the lightning in the sky/As it pass’d me flying by— /From the
thunder, and the storm— /And the cloud that took the form /(When the rest of
Heaven was blue)/Of a demon in my view—“। আর এখান থেকেই উঠে আসে ফ্রয়েডের ‘রিপিটেশন-কমপালশান’এর ধারণা। শৈশবের প্রত্যক্ষ ও
নিয়মিতকে জীবনব্যাপী বহন করার মনঃসমীক্ষণ। যে ফরগটেন পাস্ট আর
রিপিটেশনকে ফ্রয়েড তাঁর পরীক্ষায় প্রয়োগ করেছিলেন মনোরোগের চিকিৎসার প্রেক্ষিতে, সেই অতীত স্মৃতি
আসলে পো-কেও ধাওয়া করে গেছে আজন্ম। শৈশবে প্রিয়
মানুষগুলোর মৃত্যুদৃশ্য বা বিভ্রান্ত স্মৃতি তাঁর কাঁধে হাত দিয়ে নিচু গলায় তাকে
বুঝিয়ে গেছে সাদা আলো আর নীল পৃষ্ঠাকে খোলা রেখে একে একে ফিরে যাওয়ার পরিণতি, যাপনের প্রশ্নে কেবল
দুঃখ আর নৈরাশ্যের একঘেয়ে উত্তর। অবচেতনে পড়ে থাকা
বাল্যকালের নির্যাতিত নার্সিসিজম যা পরবর্তী কালে ট্রান্সফেরেন্স পয়েন্ট খুঁজে
পেয়েছে তাঁর গল্পে কবিতায় সামগ্রিক সৃষ্টিতে। চরিত্রগুলোর মৃত্যুদৃশ্যের মধ্য দিয়ে, কালো রক্তে মাখা
মুখগুলোর মধ্যে দিয়ে পো যেন অতীতের বিকৃত শিরাগুলো থেঁতলানো স্নায়ুগুলোকেই অনুসরণ
করছিলেন। তারঁ বি-পিতা জন এ্যলানের কাছ থেকেও পো পেয়েছেন অনিবার্য দূরত্ব, একটা তাপ্পি মারা
জীবন যার ভেতরের পাতায় সমাজ সম্বন্ধে সম্পর্ক সম্বন্ধে
অতিকায় অনীহা, ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ
অশান্ত ঘৃণিত এই সাইকোবায়োগ্রাফিকাল অবচেতনই উঠে এসেছে ‘ঘন্টাঘরের শয়তান’ হিসেবে, কালো বেড়ালের হত্যাকারী হিসেবে কিংবা ফর্চুনেটোর
হাত ধরে সমাধি কক্ষে নেমে যাওয়া সেই আলখাল্লা পরা রক্ত ঘাম অশ্রুর ক্ষরণ হিসেবে।
সারাজীবন দারিদ্র
তাড়া করে ফিরেছে পো-কে। তাড়া করেছে বিতর্ক
আর বিচ্ছেদ। জাপটে ধরেছে নুলো এক জীবন। ১৮৩৬এ বিয়ে করেন
সম্পর্কিত বোন ভার্জিনিয়াকে অথচ যক্ষারোগে তিনিও মারা গেলেন বিয়ের মাত্র ১১ বছর
পর। ভার্জিনিয়ার সাথে পো-এর গভীর সর্ম্পকের
চিহ্ন হিসেবে ১৮৪৬এর ১৪ই ফ্রেব্রুয়ারী ভ্যালেন্টাইন ডে তে পো কে লেখা ভার্জিনিয়ার
একমাত্র কবিতাটিই যথেষ্ট। কবিতাটির প্রতিটা বাক্যের প্রথম অক্ষর দিয়ে ভার্জিনিয়া
এডগার অ্যালানের নাম লিখেছিলেন-
“Ever
with thee I wish to roam-
Dearest
my life is thine
Give me
a cottage for my home
And a
rich old cypress vine,
Removed
from the world with its sin and care
And the
tattling of many toungues
Love
alone shall guide us when we are there
Love
shall heal my weakend lungs;
And Oh
the tranquil hours we’ll spend,
Never
wishing that others may see
Perfect
case we’ll enjoy, without thinking to lend
Ourselves
to the world and its glee-
Ever Peaceful
and blissful we’ll be”...
ভার্জিনিয়া জেনে গেছিলেন তাঁর আসন্ন মৃত্যুর কথা, ক্রমাগত ক্ষয়ে
যাওয়ার কথা, আর তাই হয়তো মেনেও নিয়েছিলেন
তৎকালীন কবি ফ্যানি ওসগুডের সাথে পো-এর দু’ বছর ব্যাপী
বিতর্কিত সম্পর্ক, পো-এর তত্ত্বাবধানেই
ব্রডওয়ে জার্নালে সেসময় ‘ইকো সঙ’ বা ‘স্ল্যান্ডার’এর মতো ওসগুডের বিখ্যাত
কবিতাগুলো একের পর এক প্রকাশ হয়ে চলেছে। তীব্র বিতর্ক আর এলিজাবেথ
ইলেটের মতো তৎকালীন কবিদের কুৎসা ১৯৪৭এ পো আর ওসগুডের
সম্পর্ক ছেদ করে দেয় এবং দুর্ভাগ্যক্রমে ভার্জিনিয়ার মতো ওসগুডও মারা যান
যক্ষা রোগে ১৯৫০এ। পো-র পুরো জীবনটাই এমন ‘অনুর্বরতা আর বন্ধ্যাত্বে ভরা’। সেখানে সৌন্দর্য বড় একা, সেখানে ঘাস আর বালিতে আসলে মৃত্যুকামুকতা আর জীবন সেখান ভিক্ষা
চাইছে জীবনের কাছেই! আর অদ্ভুতভাবে
মনঃসমীক্ষণগত আলোচনা চালালে দেখা যাবে, প্রতি মুহূর্তে নিজেকে অস্বীকার করতে চাইছে পো-এর চরিত্ররাও, সেকি শরীরের অপূর্ণতা মনের ব্যর্থতাকে
ঢাকতে, নাকি আখ্যানের এই আর্তনাদ লেখকের নিজস্ব অন্ধকারেই আক্রান্ত! ‘দ্য লাইফ অ্যান্ড ওয়ার্ক অফ
এডগার অ্যালান পো’-এ সাইকোলজিকাল ইন্টারপ্রিটেশনেরর রচয়িতা মারি
বোনাপার্ট দাবি করেন যে, যে কোনো সাহিত্য
রচনার সাথেই লেগে থাকে সাহিত্যিক বা লেখকের যাপিত জীবনের অনুরণন, যাপিত স্বপ্নের সুতো
ধরে ছায়া ধরে আসে একজন পর্যবেক্ষকের প্রাথমিক অবস্থান। অর্থাৎ ভাষার গঠন
সেখানে লেখকেরই আবহে লালিত লেখকেরই বৌদ্ধিক উৎকন্ঠায় প্রকাশিত। দুটো ঘটনার উল্লেখ করেন বোনাপার্ট যা আসলে
আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে মৃত্যুর প্রতি, রক্তাক্ত ভেঙে পড়ার প্রতি, নিরুপায় শুকিয়ে আসার প্রতি
অ্যালান পো-র সমর্থনের-আশ্রয়ের-সঙ্গের যৌক্তিকতার। এক, তাঁর মৃতা জননীর দৃশ্য এবং তৎপরবর্তী অবস্থায়
জননীর প্রতি মোহাচ্ছন্ন হওয়া এবং আরও একটি ঘটনা- একটি রাত তাঁর যক্ষারোগগ্রস্ত এক
আত্মীয়ার সাথে একই ঘরে কাটানো এবং তীব্র কামনা
দ্বারা দগ্ধ হওয়া। শিশু অবস্থায় যেখানে
শিশু তার মায়ের মধ্য দিয়েই খুঁজে নেয় তার প্রতিচ্ছবি তার একাত্মবোধ, সেখানে পো-এর কাছে মায়ের ভালোবাসা
স্নেহ এক অলীক আস্বাদ হয়ে রয়ে গেছে যা পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে তার স্নায়ুপীড়া। সচেতনভাবে পো যেন
তাঁর অভিভাবকদের কখনই ছুঁতে পারেননি, প্রতীয়মান হয়ে ওঠেনি সংঘের মতো ভালোবাসার মতো কোনো ধারণা। ১৮৩৫এ ব্রেভারলি
ট্রাকার-এর লেখা এলিজাবেথ পো-এর স্মৃতিচারণা মূলক এক চিঠির
জবাবে পো লেখেন- “In speaking of my mother you have touched a
string to which my heart fully responds. To have known her is to be the object
of great interest in my eyes. I myself never knew her — and never knew the
affection of a father. Both died
. . . within a few weeks of each other. I have many occasional
dealings with Adversity — but the want of parental affection has been the
heaviest of my trials”। মায়ের মৃত্যুপরবর্তী পো-এর যাপনে আমরা লক্ষ্য করতে
পারি একের পর এক নারী সংস্পর্শ, যার মধ্যে দিয়ে পো খুঁজে ফিরেছেন ‘মায়ের মতো’ কিছু একটা গভীর বিশ্বাস। তা সে সৎমা মিসেস অ্যালান হোক, অথবা মারিয়া ক্লেম, পো-এর মাসি এবং পরবর্তী
কালে তাঁর শাশুড়ি (ভার্জিনিয়া পো-এর মা), মিসেস স্রিউ, পো-এর পারিবারিক
ফিজিশিয়ান নার্স, সে সময়কার কবি মিসেস
হুইটম্যান, যাঁর প্রতি পো-এর আকর্ষণ ছিল এবং
ভার্জিনিয়ার মৃত্যর পর পো কখনও
স্ত্রী হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন, অথবা মিসেস অ্যানি রিচমন্ড নামের বিবাহিত সেই
নারী, যাঁর প্রতি পো আকর্ষিত
ছিলেন কিংবা ছোটবেলার প্রেমিকা এলমিরা
রয়েস্টার শেলটন- প্রায় সবার মধ্যেই
পো খুঁজেছিলেন শৈশবের অস্তিসংকট। অবদমিত মাতৃস্নেহ কোথাও
সুপ্তাবস্থায় রয়েই গেছিল পো-এর সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে। ১৮১১তে দত্তক নেওয়া
থেকে শুর করে (যদিও সরকারী ভাবে মিঃ এ্যলান পো এডগারকে দত্তক কোনোদিনই
নেননি) ১৮৩৩এ মৃত্যু অবধি ‘মা’ বলেই ডাকতেন মিসেস পো কে
এবং পো যে তাঁর দত্তক বাবা অপেক্ষা তার মায়ের প্রতি বেশি সংবেদনশীল ছিলেন, তা মৃত্যুর পর তাঁর লেখা চিঠি থেকেই
অনুভব করা যায়। ফ্রাঁসিস
অ্যালানের মৃত্যুর সময় ওয়েস্ট ফ্রন্ট থেকে পো তাঁর সৎ বাবাকে লেখেন- “আমি বাড়ি আসছি এবং এটা তুমি মনে
রাখবে। কবর দেওয়ার এই রাত্রি তুমি মনে রাখবে। আমি বাড়িতে
থাকাকালীন যদি মা মারা যেত আমার ততটা দুঃখ হতো না, যতটা এখন এতদূরে থেকে। তোমার প্রতি আমার সে
অর্থে ভালোবাসা নেই, কিন্তু আমি আজও বিশ্বাস করি
তিনি আমাকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন”। ফ্রাসিস এ্যালনের মৃত্যুর পর মাতৃত্বের উষ্ণতা
খুঁজতে পো-এর আস্তানা বাল্টিমোর, মাসি মারিয়া ক্লেমের কাছে। এসময় পো মাদকাসক্ত
হয়ে পড়েছেন, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে
বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। এই মারিয়া ক্লেমের সাথেই
থাকতেন পো-এর পঙ্গু দিদা এলিজাবেথ পো। জন্মাবস্থা থেকেই পো-র কাছে তিনি পঙ্গু ও
বিছানায় শয্যাশায়ী, তাই তাঁর সাথেও পো-এর তেমন আর্দ্র
সম্পর্ক কোনোদিনই গড়ে ওঠেনি। কেবলমাত্র কিছু মানবী স্নেহ
ভালোবাসার জন্য পো-র সার্বিক জীবনে
একাধিক নারীর এই অজস্র আসা যাওয়ায় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মারিয়া
ক্লেমের উপস্থিতি। পো
পরবর্তীকালে ‘Sonnet to My Mother’ শীর্ষক কবিতা লেখেন মারিয়া ক্লেমকে উপলক্ষ্য করে। মারিয়া ক্লেম ও
ভার্জিনিয়া যে পো-এর চল্লিশ বছরের
জীবনে কতখানি আকুতি হয়ে ছিল, ভরা আলিঙ্গন হয়ে ছিল, তা পো-র লিখিত গল্প ‘Eleonora’ বা ‘ইলিওনোরা’তে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ ছবি
হয়ে ধরা পড়ে।
‘ইলিওনোরা’ গল্পে স্মৃতি আর সাক্ষী দুইয়েরই উত্তরকথক হয়ে পো যখন বলেন- “যৌবনে যাকে আমি ভালোবাসতাম, যাকে নিয়ে এই স্মৃতি-কথা আমি লিখছি শান্ত মনে, স্পষ্ট ভাষায়, সে আমার বহুকাল আগে মৃত মায়ের একমাত্র বোনের
একমাত্র কন্যা... আমরা সবর্দাই বাস করেছি ‘বহুবর্ণ তৃণময়
উপত্যকা’য় গ্রীষ্মমণ্ডলের সূর্যের নিচে। কোনও চলতি পথ তার কাছাকাছি
পর্যন্তও পৌঁছয়নি। আমাদের সেই সুখের বাড়িতে যেতে হলে বনের হাজার
হাজার ডালপালাকে সজোরে ভেঙে ফেলতে হতো, লক্ষ লক্ষ সুগন্ধ ফুলকে মাড়িয়ে দিতে হতো পায়ের তলায়। এইভাবেই আমরা-আমি, আমার বোন ও তার মা - একান্তে বাস করতাম। উপত্যকার বাইরের
জগৎটার কিছুই জানতাম না”।(অনুবাদ মনীন্দ্র দত্ত)। পো এখানে সেই চেনা যৌবনের কথাই বলেছেন। ভার্জিনিয়া আর মিসেস
ক্লেমের সাথে কাটানো তাঁর কুড়ি বছরের পীতপ্রবাসের কথা। একের পর এক নারী
চরিত্র নিঃসঙ্গতা আক্রমণ করে ঢুকে পড়েছে পো-র গভীর বিশ্বাসে। একটা ম্যাজিক
প্রিজনের মধ্যে শৈশবের সাদা পাজামা ছেড়ে পো-ও মেখে নিয়েছেন যৌবনের জাফরান। ‘ইলিওনোরা’ গল্পে ভার্জিনিয়ার সাথে পো-এর সম্পর্কে কিশোর
কিশোরী থেকে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে দেখা যায় প্রেমের আবাস, নিষিদ্ধ ফল হাতে উঠে
আসে যুবক যুবতী, সাদা ডেইজি ফুল শুকিয়ে
গিয়ে মাথা তোলে লাল এসকোডেল, দীর্ঘদেহ চক্রবাক পাখি উড়ে যায়। পাইরস ও ইলিওনোরর মধ্যে
দিয়ে আমরা যেন পো আর ভার্জিনিয়াকেই এজ অফ ইনোসেন্স থেকে ক্রমাগত ঢুকে পড়তে দেখি এজ
অফ এক্সপেরিয়েন্সে। গোটা ‘ইলিওনোরা’ গল্পেই কোথাও একজন সম্পূর্ণ মানুষকে হারিয়ে যেতে দেখি। গেঁজিয়ে উঠতে দেখি
যাপনের অনন্ত পিকনিক। পো-এর সম্পূর্ণ জীবনটাকে যদি
আমরা চীনালণ্ঠনের আলোর নিচে রেখে পড়তে থাকি, খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেখা যাবে হাসিখুশি
উজ্জ্বল এক পাহাড়ের চূড়ার ক্রমাগত ঘন মেঘে হারিয়ে যাওয়া, শোনা যাবে বরফ পড়ার শব্দ। যেন এক পিচবোর্ডের অস্তিত্ব, চ্যাপ্টা তাকে হতেই
হবে, পালাবার উপায় নেই। ইলিওনোরা, পো-এর একমাত্র সিরিয়াস
রোমান্টিক গল্প যার একটা হ্যাপি এন্ডিং আছে। অথচ পাশাপাশি এই
গল্প কেবল ভালোবাসার গ্রোথকেই চিহ্নিত করে না বরং রোমান্টিক
লাভ আর ম্যারেড লাভের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া
পো-র অস্তিত্বের ঠান্ডা যন্ত্রণাকেও কোথাও তুলে ধরে। মারিয়া ক্লেম বা ভার্জিনিয়ার সাথে বিয়ের
আগে যে সম্পর্ক পো-এর ছিল, যে আইডিয়ালিক লাইফ সেখানে ছিল প্রশ্বাসের বাতাস, বহুবর্ণ তৃণময়
উপত্যকা আর অতিকায় এক আনন্দের পথ (পাইরস আর ইলিওনোরার প্রেমে তাকেই ব্যক্ত করছেন পো), আবার ইলিওনোরার মৃত্যুর
পর নিজেকে স্থির না রাখতে পেরে ভয়ংকর সৌন্দর্যের কাছে হেরে গিয়ে স্বর্গীয়
এরমেনগার্ডের কাছে পাইরসের নিজেকে আত্মনিবেদনে হয়তো সুখ আছে, কিন্তু সেই অননুদিত
শান্তির জন্য স্বর্গলোকই হয়ে উঠেছে দীর্ঘশ্বাসের
বাড়ি, স্মৃতির চারণভূমি। চতুর্দশী
ভার্জিনিয়াকে পো ‘Sissy’ নামে ডাকতেন আর তিনি ছিলেন ভার্জিনিয়ার প্রিয় ‘Eddy’। ভার্জিনিয়াকে নিয়ে মারিয়া ক্লেমের
তার বিত্তশালী আত্মীয় নেলসন পো-এর কাছে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে পো-এর লেখা চিঠি থেকেই অনুভব
করা যায় ভার্জিনিয়ার প্রতি পো-এর অনুরাগ, যা ভারসাম্য নাড়িয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের- “My
Love, My own sweet Sissy, My Darling little wifey, think well before you break the heart of your
cousin-“Signed: “Eddy””। আশ্চর্যভাবে বিবাহ কিন্তু পো-কে দাঁড় করিয়ে দেয় ধূলো
রঙের একগোছা ক্ষয়ের মুখোমুখি। যে ভালোবাসার জন্য তার
ঘাসফুলগুলোকে ক্রমাগত বড় করে তুলছিলেন পো, সেই কুমুদলতার
আশ্রয়ই হয়ে উঠল সীমাহীন বিলীন মরুভূমি। প্রিয় বন্ধু জন
ম্যাকেঞ্জীকে রিচমন্ডে থাকাকালীনই জানিয়েছিলেন তাঁদের এই বিয়ে সুখকর হয়নি আর গত দু’বছর ধরে তারা যেন
পরস্পর ভাইবোনের মতোই রয়েছেন। পাশাপাশি বিয়ের
মাত্র ছ-বছরের মধ্যেই অতিরিক্ত
মদ্যপানে ভার্জিনিয়া যক্ষারোগগ্রস্থ আর শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে তাঁদের সম্পর্ক কেবল
নিঃসঙ্গ অজুহাতে পরিণত হয়। ১৮৪২এর জানুয়ারীতে
কাশতে কাশতে রক্ত বেরিয়ে এলো ভার্জিনিয়ার কন্ঠনালী দিয়ে, এ যেন তার
সন্ধ্যাতারার দেশে ফেরার ইঙ্গিত, সাইপ্রাস আর পোড়া ঘাস একা রেখে ফেরার ইঙ্গিত। ভার্জিনিয়া ক্রমশই
হেরে যাচ্ছিল ব্যথার কাছে, চিরায়ত চোরাবালির
কাছে। মস্তিষ্কের ভেতর নেমে আসছিল গাঢ় ছায়া, ফিকে হয়ে আসছিল সবুজ
গালিচার রং। ১৮৪৬এ নিকোলাস দম্পতি পো-এর ‘Fordham
Cottage’এ ভার্জিনিয়াকে দেখে
এসে যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, তা অনেকটা এরকম-
“The
autumn came, and Mrs. Poe sank rapidly in consumption, and I saw her in her
bedchamber. Everything . . .
was so neat, so purely clean, so scant and poverty-stricken. . .
There was no clothing on the bed, which was only straw, but a snow white spread
and sheets. The weather was cold, and the sick lady had the dreadful chills
that accompany there [[the]] hectic fever of consumption. She lay on the straw
bed, wrapped in her husband’s great-coat, with a large tortoise-shell cat on
her bosom. The wonderful cat seemed conscious of her great usefulness. The coat
and the cat were the sufferer’s only means of warmth, except as her husband
held her hands, and her mother her feet. “
১৮৪৭এর ৩০শে জানুয়ারী মারা গেলেন ভার্জিনিয়া, মাত্র পঁচিশ বছর
বয়সে। বাল্টিমোরে সমাধি দেওয়ার প্রাক্কালেও পো বিশ্বাস
করেননি মৃত্যু পরবর্তী ভালোবাসায়, বিশ্বাস করতে চাননি
অবয়বহীন মনোরম আদরের কথা। অথচ কবরখানা থেকে ফিরে এসে
ফাঁকা বাড়ি ঠান্ডা মেঝে আর অপেক্ষারত খোলা দরজা অবধি যেতে যেতেই পো বুঝতে
পেরেছিলেন, দূরত্বের নির্বিকার সহলিপি তাঁকে ঘিরে ধরছে ক্রমশ, হারিয়ে যাওয়া
নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া ভার্জিনিয়াকে ভালোবেসে ফেলছেন তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে, সচেতন অচেতন গোটা
পরিধি দিয়ে ঘিরে ফেলতে চাইছেন মৃত্যু রূপান্তরিত শূন্যতাগুলোকে। মৃত ভার্জিনিয়ার
মুখের দিকে তাকাতে পারেননি পো, কেবল পেছন ফিরে পৃথিবীর
অনন্ত নাড়াচাড়ায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন- মৃত্যু, তার আনন্দ আছে অথচ তার দুঃখ সবটুকু থাকাকে ঝাঁকুনি দিয়ে
যায়। ঠিক এর পরই আমরা পো-কে একজন ম্যান অফ
ক্রাউড হিসেবে পাই যে যাত্রাপথে খুঁজে চলেছে এক এবং একমাত্র লস্ট ওয়ানকে। তিনি একা হতে চাইছিলেন, শূন্যতাকে স্পর্শ করতে
চাইছিলেন, একরকমের ‘বৃত্তাকার ধ্বংসাবশেষে’ দাঁড়িয়ে অসংখ্যের ছেড়ে
যাওয়া টুকরোগুলোকে কুড়িয়ে নেওয়াই ছিল পো-এর বাকি জীবনের স্তব্ধলোক। হ্যাঁ, ভার্জিনিয়ার মৃত্যু
কোথাও পো-কে দাঁড় করিয়ে গিয়েছিল
স্থির এক অনিবার্যের মুখোমুখি, কান্নার ভেতর দিয়েও তিনি যেন ছুঁতে পারছিলেন
অভিনব কোলাহলকে, উচ্চারিত মিথ্যের
ভেতর দিয়ে বানিয়ে তুলতে চাইছিলেন অনুচ্চারিত সত্যকে। কিন্তু এই সেপারেশন
এই বিচ্ছেদ তাঁর বেদনাকেও শতগুন বাড়িয়ে দেয়, কোথাও নিশ্চিত হয়ে
যান আকাঙ্ক্ষিত মানুষগুলোকে এক দিন না একদিন পৃথিবীর ওপাশে এক
আপোষহীন শয়তান তাড়িয়ে নিয়ে যাবে। নিয়ে যাবেই। তারই নাম মৃত্যু। যার কাছে অসহ্যতম
দুঃখই স্বাদু। দীর্ঘ মৃত্যুর পর পড়ে থাকবে প্রিয়জনের রঙিন আঁশে
ঢাকা ঝিল্লিময় দু’চারটে ডানা, আর কেউই বুঝতে
পারবে না মাটি আঁকড়ে রয়ে যাওয়া শরীরটার ওপর আদতে
ঝকঝকে সাদা একটা মড়ার খুলি আঁকা, শরীরের ওপরই ব্যবচ্ছেদ করে রাখা একটা শবদেহের। কেউই জানতে পারবে না জানালার শার্সি বেয়ে যে
মাকড়সা জাল বুনছে, সে আসলে পলাতকের দলকে রেখে
যাচ্ছে জীবন নামের এক প্রহসনের
কাছাকাছি। পো-এর মনোভূমিতে যে বিষাদস্বর তাও আসলে একজাতীয় আত্মনিগ্রহ। বেঁচে থাকার খেলায়
বঞ্চিত হয়ে ‘ব্র্যাকেটজীবনের’ প্রকৃত আয়তনের মাপ খোঁজা। জীবন নামের এক নিরবিচ্ছিন্ন
দোটানাতে খাজনা মেটাতে চেয়েছেন পো আর ভেতরঘরে জমা হয়েছে দুঃখ ও নৈরাশ্যের
অনুষঙ্গগুলি।
কেবল মারিয়া ক্লেম, ভার্জিনিয়া বা তার সৎ মা ফ্রাঁসিস
এ্যলানই না, ভালোবাসার উচ্চারণে পো বারবার ধাক্কা
দিয়ে খুলেছেন তাঁর নীরব জানালাগুলোকে, আশ্চর্য অমিলন ধূলো
সরিয়েছেন প্রিয়তা খোঁজার তাগিদে। শৈশবে ফ্রাঁসিস এ্যলানের পর
রিচমন্ড স্কুলে তাঁর বন্ধু রবার্ট স্ট্র্যানার্ডের মা জেন স্ট্রিথ স্ট্যার্ণাড
প্রবলভাবে পো-এর শৈশবে অনুরাগের
প্রতীকী হয়ে ওঠেন। ত্রিশোর্ধ মিসেস
স্ট্র্যানার্ডের প্রতি দুর্বল ছিলেন চোদ্দ বছরের পো। এমনকি ভার্জিনিয়ার
সাথে কথা কাটাকাটির মুহূর্তগুলোতে দৌড়ে চলে যেতেন মিসেস স্ট্র্যানার্ডের কাছে, যেন ঢেউ থামিয়ে
দেওয়ার জন্য কিছুটা উঁচু বালিতে ঢুকে পড়া। পো-এর জীবনের অন্যান্য নারীর মতো মিসেস স্ট্র্যানার্ডও
তাঁকে ছেড়ে চলে যান
মহাকালের যাত্রাপথে, রেখে যান অপার
সৌন্দর্যের স্মৃতি, অভুক্ত স্নেহ ও
ভালোবাসার ছায়ামূর্তি। স্ট্র্যানার্ডের মৃত্যুর
কিছুদিনের মধ্যেই ‘To Helen’ কবিতায় যে
সৌন্দর্যের প্রকাশ করেছেন পো, তা মিসেস স্ট্র্যানার্ডের
চেনা শরীর আর অচেনা সমগ্রতার শব্দগুলো কুড়িয়েই-
“Helen,
thy beauty is to me
Like those Nicean barks of yore,
That gently, o’er a perfumed sea,
The weary, way-worn wandere bore
To his own native shore…”
প্রথম পংক্তিগুলোই বলে দেয় মিসেস এ্যালনের মৃত্যুর পর
ক্লান্তি আর অবসাদের গভীরে ডুবে যাওয়া পো যেন তাঁর অবিশ্বাস্য হিম
মাথা তুলে দিতে চাইছেন জেন স্ট্রিথ স্ট্যার্ণাডের কোলে। পো যেন বারবার এমনই
স্পিরিচ্যুয়াল ভালোবাসার কাছে এসে হেরে গেছেন, এমনই এক নৈব্যর্ক্তিক স্নেহের প্রতি ঝুঁকে গেছে তাঁর
অবহেলিত ভুবন। স্ট্যার্ণাডের দৈহিক সৌন্দর্য্যকে হেলেন অফ
ট্রয়ের সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে পার্থিব ভালোবাসাকে অনুসরণ করিয়েছেন হোলি
ল্যান্ডে, একটা বৃহত্তর
অবকাশে। ১৮৪৮এ মিসেস হেলেন হুইটম্যানকে তাঁর অস্থির তামসিক
শৈশব সম্পর্কে বলতে গিয়ে পো বলেন- “I wrote this poem in my
passionate boyhood, to the first,purely ideal love of my soul”। ভার্জিনিয়ার মৃত্যর পর পো-এর জীবনে একের পর এক
নারী আসেন, মিসেস ওসগুড, মিসেস হুইটম্যান বা
মিসেস ইলেট, যারা প্রত্যেকেই পো-এর কাব্যিক সন্মোহনে
সমর্পিত ছিলেন, যাদের কেউ কেউ পো-কে ব্যবহার করেছিলেন
শিল্পের সিঁড়ি হিসেবে। আবার মিসেস হুইটম্যানের মতো কেউ বিয়ে করতে
গিয়েও পিছিয়ে এসেছিলেন
সমাজ ও সংস্কারের অযাচিত কৌতুহলের কাছে। ভার্জিনিয়ার মৃত্যু
পো-কে ভেতর থেকে ভেঙে চুরমার করে গেছিল যার ফলে তিনি
কোথাও পরিবর্ত অন্য এক ভার্জিনিয়ার কাছে খুঁজে ফিরছিলেন অসংলগ্ন আশ্রয়, অস্থিত মানুষের
অনুসরণ। প্রেম এবং পো-এ যেন এক মহাজাগতিক ঠাট্টা! জীবনের শেষ দিন অবধি
তিনি প্রেমের মাঝে নিশ্চয়তা খুঁজেছেন, খুঁজেছেন বাঁচার সংগোপন অথচ আধো কুয়াশার ভেতর
দিয়ে ফিরে এসেছে অস্বীকৃত অসহায় এক মানুষ, নিজের শরীরে দাঁড়িয়েও যিনি সম্পাদনা করতে পারছেন না তাঁরই অস্তিত্ব। এমনকি
একসময় তিনি সদ্য বিধবা ছোটবেলাকার
প্রেমিকা এলমিরা রয়েস্টার শেলটনকেও বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুর এক মাস আগে
শাশুড়ি মারিয়ে ক্লেমকে লেখা তাঁর শেষ চিঠিতেও পো যেন নিজেই নিজের গায়ে মাথায় হাত
বুলিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন, তিনি এখনও জীবিত। প্রমাণ করতে চেয়েছেন একজন
জন্মান্ধ প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরও অনুমতি আছে ভেতরবাড়ির অমিত প্রসাধনের
কাছে যাওয়ার। “May God forever bless you,
my dear dear Muddy — Elmira has just got home from the country. I spent
last evening with her. I think she loves me more devotedly than any one I ever
knew & I cannot help loving her in return. Nothing is definitely settled,”। অথচ অক্টোবর ১৮৪৯তেই তাঁর প্রিয় ‘বাল্টিমোর বোট’এ উঠে পড়লেন পো। এক অনন্ত যাত্রার
আনন্দ নিতে, যে আনন্দের কূলকিনারা পাওয়া যাবে
না। হ্যাঁ মৃত্যুই কোথাও মুক্তি দিতে পারত পো-কে, বীতশোক মানুষের বিজন
ঘন্টাধ্বনি বাজিয়ে মৃত্যুই তো মুছে দিতে পারে ‘হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকা যন্ত্রণাকে’। এই মৃত্যুর জন্যই পো যেন তাঁর
দীর্ঘ চল্লিশ বছর জানালার পর্দা টেনে ঘুমাননি, দীর্ঘ চল্লিশ বছর
অপেক্ষা করেছেন ‘লাল মৃত্যুর শৌখিন
অভিনয়’ দেখার জন্যই। যাপনের ঘরগুলোর সাথে
তাল মিলিয়ে মিলিয়ে কাচের রং বদলেছেন অথচ লাল মৃত্যু সে অন্ধকারে চোরের মতো এসে পড়েছে টুকরো টুকরো কাচের
শব্দ ছড়িয়ে।
মৃত্যুর মাঝে কোনো স্বর্গীয় সুষমা নয় বরং গথিক হররকে জড়িয়ে
রেখেছেন পো, প্রতিটা অন্ধকারের
সাথে প্রতিটা অস্তিত্বের সাথে, কালো মদে ডুবিয়ে রেখেছেন ক্ষতচিহ্নের খসড়া। মোমবাতির আলোয় পড়া
পো-এর মৃত্যু, সেখানে সূর্যালোক
নিষিদ্ধ। কথক এবং পর্যবেক্ষক অথবা কথক ও অপরাধী অথবা কথক
এবং শিকার এই তিনভাবেই এডগার অ্যালেন পো-এর সাথে সাথে আমরা ক্রমশ ঢুকে পড়ি তাঁর এই থকথকে যন্ত্রণা আর নিঃশব্দে ঘর
গুছিয়ে নেওয়া মৃত্যুর মাঝামাঝি। ‘The Cask of Amontillado’ বা ‘এমন্টিলাডোর
সুরাপাত্র’তে ফর্চুনাটোকে জ্যান্ত দেওয়ালে গেঁথে দেওয়ার আগে যে অমানুষিক অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে
কথক নিয়ে চলেন, নিচু টিলা আর গভীর
গুহার মধ্যে মশালের কমে আসা আলোয় যেভাবে লম্বা ঘোরানো সিঁড়ি থেকে সমাধিক্ষেত্রের
দিকে স্যাঁতসেঁতে ঠিকানার দিকে মাংসের শোভাযাত্রা উঠে আসে কিংবা ‘The fall of the house of Usher’এ ধ্বংসস্তুপের শেষ
টুকরোগুলোর উপর দাঁড়িয়ে সেই যে শবাধার
খোলার ধাতব ঝন ঝন শব্দ, দরজার বাইরে মৃত্যু
দরজার ভেতরে মৃত্যু শরীরের গন্ধে মৃত্যু স্মৃতির গঠনে মৃত্যু যেন প্রতিটি
প্রশ্বাসে উচ্চারিত হচ্ছে আড়মোড়া ভাঙা মৃত্যুর ফোঁপানি। সূক্ষ্ম ফাটল খুঁজছে, ঘুমের ভেতর আকস্মিক
ধাক্কা দিচ্ছে কেবল একটা ভয়াবহ ফেরা, দেহের সর্বত্র ছেয়ে থাকা একটা শবসমাজ – সে যেন বার
বার মৃত্যুর প্রতি পো-এর এক অনন্ত আকর্ষণ
চিহ্নিত করে যায়। মনে হয় কফিনের ভেতর থেকেই কথা বলছেন পো, শোকরত মানুষের দিকে
এগিয়ে দিচ্ছেন মৃত্যুর মৌন সম্মতি। এক অদ্ভুত চিৎকারের মধ্য
দিয়ে চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করছেন পো, একটা বধির
প্রতিধ্বনির ভেতর ঝনঝন করে ভেঙে ফেলছেন জীবনের আয়নাটা। মাঝে মাঝে
মৃত্যুদৃশ্যগুলির বিবরণের ভয়াবহতা অবাক করে তার মানসিক সামঞ্জস্যগুলির প্রতি, মনসমীক্ষণজাত সমালোচনাগুলিতে
উঠে আসে পো-এর ‘disillusionment
with life’ মতো ব্যাখ্যাও। জীবনের প্রতি মোহহীনতাই কি
টলমল করছে জীবন পর্দার পেছনে গড়ে ওঠা এই সব
চরিত্রে! অতিরিক্ত মাত্রায় ঋজু খোলা আর্তকন্ঠের দৃশ্যগুলির চয়নে পো খুঁজে পান তাঁর ফ্যাসিনেশন অফ ডেথ! আবার ‘Premature Burial’এর শেষপর্বে এসে যখন তিনি
বলেন- “There are moments when, even to the sober eye of
Reason, the world of our sad Humanity may assume the semblance of a Hell….Alas!
the grim legion of sepulchral terrors cannot be regarded as altogether fanciful
….they must sleep, or they will devour us-they must be suffered to slumber, or we
perish”। তখন কি মনে হয় না, মৃত্যু আসলে তাঁর কাছে সেই একমাত্র
উত্তর একমাত্র উত্তরণ, মীড় তুলে তুলে ছেড়ে
যাওয়া মগজের মেঘলা প্রহসন! একমাত্র স্পর্শযোগ্য কিছু
একটা যা একতাল কাদামাখা ফ্যাকাশে সাদা জীবনের থেকে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে একটু একটু
করে। পো-এর সাহিত্যকর্মগুলো নাড়াচাড়া করলেই বোঝা যাবে, তাঁর প্রশ্ন ছিল
গুটিকয়েক এবং খুবই সামান্য খুবই সহজ, বেঁচে থাকার অর্থই ছিল তাঁর একমাত্র বিস্ময় ও
হেঁয়ালি, যাপনের যন্ত্রণাই যেন বারবার তাঁকে তীব্র কটাক্ষ করত
আর নির্দেশ দিত একটা মূক বিবশ আত্মসমর্পণের।
১৮৪৯এ মাত্র ৪০ বছর বয়সে মৃত্যুর ঠিক আগে বাল্টিমোরের সরকারী
হাসপাতালে যখন পো-কে নিয়ে আসা হলো তখন তাঁকে আবিষ্কার করা
হয়েছিল শহরের আবর্জনা ও নোংরা ফেলার
ডাস্টবিন থেকে। অচেতন অবস্থায় ছিন্ন ভিন্ন পোশাকসহ পড়ে ছিলেন
পো। বিধ্বস্ত পরিত্যক্ত হেরে যাওয়া বিশ্বাসাহিত্যের
এক তুখোড় কথাসাহিত্যিকের মৃত্যুকে স্বীকার করা হয়েছে হাজার রকমের জল্পনায়। কেউ বলেন অতিরিক্ত মদ্যপানে তাঁর মৃত্যু, আবার কেউ বা
জলাতঙ্ককে মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। আবার কেউ কেউ তাঁর মৃত্যুর পেছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রেরও হাত
দেখেন। রিচমন্ড, ভার্জিনিয়ার এডমন্ড
এ্যালান পো সংরক্ষণাগারে তাঁর মৃত্যুর প্রতিটা আনুমানিক কারণ যুক্তিসহকারে
সংরক্ষিত থাকলেও এ কথাটা পরিষ্কারভাবে
প্রমাণিত যে, স্নোডগ্রাস নামের যে ভদ্রলোক আঠারোশো ঊনপঞ্চাশের তেসরা
অক্টোবর অচেতন অবস্থায় পো-কে খুঁজে পান এবং
ওয়াশিংটন কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দেন, তার বেশ কিছুদিন আগে
থেকেই পো নিঁখোজ ছিলেন। পো-এর মৃত্যুরহস্য নিয়ে
লেখা ‘দ্য পো শ্যাডো’ গ্রন্থে লেখক ম্যাথিউ পার্ল বিস্তারিত
অনুসন্ধান চালান মৃত্যুর কারণগুলিকে নিয়ে। তাঁর বইতে মৃত্যুর কারণ হিসেবে মস্তিষ্কের
টিউমার ঘটিত রোগকেই দায়ী করেছেন ম্যাথিউ
পার্ল এবং পো-এর মৃত্যুকালীন
চিকিৎসক জন মোরানের সাথে যোগাযোগ করে কোনো কার্যকারী তত্ত্ব না পেয়ে কবর খুঁড়ে পো-এর মৃতদেহ তুলে দেখার এবং
পরীক্ষার দাবীও করেন তিনি। কিন্তু সমাধিস্থল ভেঙে কাজটা করতে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় পো-এর সমাধির মতো বিখ্যাত একটা
দার্শনিক স্থানের স্থানান্তরের প্রসঙ্গটি। ম্যাথিউ পার্ল তাঁর পরবর্তী
অনুসন্ধানে আবিষ্কার করেন মৃত্যুর ২৬ বছর পর অর্থাৎ
১৮৭৫ সালেই পো-এর মৃতদেহ নতুন সমাধিক্ষেত্রে স্থানান্তরিত করতে কবর থেকে তোলা হয়েছিল এবং ‘দ্য বাল্টিমোর গেজেট’ বা পরবর্তীকালে ১৮৭৮এ ‘সেন্ট ল্যুই রিপাবলিকেশন’এ এখবর প্রকাশ পায়। তারিখহীন এক চিঠিতে ‘দ্য বাল্টিমোর গেজেট’এর সম্পাদকের প্রতি জনৈক
চিকিৎসক জানিয়েছিলেন- মৃতের মস্তিষ্কে কোনোরকম পচনের চিহ্ন নেই
কেবল আকৃতিগতভাবে তা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। চিঠিতে আরও
জানানো হয়- “That the brain of the poet Poe, on the
opening of his grave….was in an almost perfect state of preservations.”। এই তত্ত্বই খারিজ করে দেন অস্বাভাবিক মৃত্যু বিশেষজ্ঞরা
এবং তাঁদের মতে সমাধির পঁচিশ বছর পর মস্তিষ্কের পচন অবধারিত, কেবল টিউমার জাতীয়
অংশগুলিই আকারে হ্রাস পেয়ে অবিকৃত থেকে যায়। পরবর্তীকালে এই
তথ্যের ওপর ভরসা করে ম্যাথিউ অনুসন্ধান করে দেখেন ডাঃ মোরানও পো-এর মৃত্যুকালীন কারণ হিসেবে শংসাপত্রে
মস্তিষ্কের অধিক রক্তক্ষরণই নথিভূক্ত করেছিলেন। তবুও পো-এর মৃত্যুসম্পর্কীয়
জল্পনাগুলি কোনোদিনই হয়্তো সমাধান হওয়ার নয়, সেও প্রেতের মতো মূর্তি গড়ে তাঁর চারপাশে ঘুরে বেড়্যয় হিম হেমলক
নিয়ে ঠিক যেভাবে মৃত্যুসম্পর্কীয় চেতনার বয়ানেই পো তাঁর চেতনবীক্ষার আশ্রয় খোঁজেন, তাঁর শেকড়সমেত শরণাপন্ন হন মৃত্যুর
ভূমিটিকে মান্যতা দিয়েই।
মৃত্যুকে যে তিনি
কী ভীষণ সম্ভাবনাময় করে তুলেছেন তা পো-এর দু’ মলাটের লেখাগুলিই
সমর্থন করে যায়। ফিরে যাওয়ার পিছন পিছন থেকে যাওয়ার এক শূন্য
কোলাহলকে বাজিয়ে তুলতে কেবল ভয়াবহ আবহের উস্কানি নয় রংকেও বোধারিক্ত স্পেস
দিয়েছেন। তার হাজারো বয়ান যেন দুলে দুলে বলছে – তুমি কেবল এক শান্ত
পর্যবেক্ষকমাত্র এই এত বাহুল্য এত সৌন্দর্য্যের মাঝে নিজেরই মৃতদেহের এক সামান্য
সাক্ষী মাত্র। রঙের ভাবার্থ ও প্রতীক বিষয়ে ধীমান দাশগুপ্ত
তাঁর ‘রঙ’ বইতে ভাব বা অর্থের
প্রকাশে বিভিন্ন রঙের ব্যবহার প্রসঙ্গে যে খসড়া তালিকার উদাহরণ দিয়েছেন তাতে রঙের আভ্যন্তরীন বিশ্বাসের মধ্য
দিয়ে ভাষা পেরিয়ে আলো পড়ে মনস্তাত্ত্বিক বিশেষণগুলোর ওপর। নীল রং রোমান্টিসিজম, কমলা রং মানে প্রাণ কিংবা
মুক্তি, সবুজ প্রকৃতি, লাল প্রেম আনন্দ সৌন্দর্য আর সাদা সহনশীলতা বা পবিত্রতা আলো
প্রেম; আর অবশ্যই কালো হতাশা শোক বা নির্জীবতার প্রতীক, সে তো সাদার বিপরীত তাই
কুশ্রীতা বিকৃতির জবানী সে। বর্ণতত্ত্বের এই পরস্পর বিরোধীতা বা ঘনত্বের অসামঞ্জস্যের
প্রসঙ্গ আনার একটাই কারণ, পো তাঁর গল্পের গায়ে খুলে রেখেছেন এমনই কয়েকটা
রঙীন চিলেঘর যেখানে অভিনয়ের আগে মূর্তিগুলোকে, নগ্ন মানুষগুলোকে এক মুহূর্তের জন্য নিয়ে আসা
হচ্ছে, আলো ফেলা হচ্ছে
তাদের আতুঁড়ঘরে তাদের জংলা বাড়ির পেছনদিকে তাদের রুগ্ন মুখের মহাশূন্যে। গল্পের গণিতে কোথাও লেখক পো-এর পাশাপাশি আমরা নির্দেশক পো-কে
খুঁজে পাচ্ছি যিনি গল্পের বাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে ভেতরে গিয়ে একের পর এক শট নিয়ে
চলেছেন নিভৃত অন্দরগুলোর যেখানে
একটা খোলা জানালাই জীবনের ভরসা যেখানে একটা ভারী ধাতব শব্দ
মিনিটের কাঁটাটা ঘুরিয়ে দিচ্ছে হিরন্ময় মৃত্যুর দিকে। গল্পের ভেতরের
অন্ধকার বানানোকেও পো উপভোগ করেছেন পরিপূর্ণভাবে, ক্যামেরা নয় তাঁর কলম লুক
থ্রু করছে এক ধরনের অসহনীয় স্মরণকে, জাঁকজমকপূর্ণ মুখোশের ভূমিকাসহ
চিত্রনাট্যটির নীরবে। এবং সেখানে চরিত্রের হাত
ধরে, চিন্তনের সিঁড়ি বেয়ে
গড়িয়ে নামছে রং, চোখ ধাঁধানো
বৈষম্যের মাঝে রংগুলো যেন প্রতারণা করছে আবার প্রলেপও দিচ্ছে। ‘The Masque of the Red Death’ বা ‘লাল মৃত্যুর শৌখিন
অভিনয়’এ মৃত্যুকে হারিয়ে দিতে যুবরাজ প্রস্পেরো সুউচ্চ
প্রাকারবেষ্টিত যে দুর্গসদৃশ বানিয়েছেন তার মাঝে সাত সাতটি ঘরকে সাজিয়েছেন সাত
সাতটি ভিন্ন রঙে যা আসলে বারবার ব্যস্ত মানুষকে বিশ্রাম দিচ্ছে মৃত্যুর দিকে পিঠের
কুঁজটি খুলে রেখে। কাচ তুলে দিচ্ছে যেখানে সূর্যাস্ত ঝুলছে, সমর্পণ ঝুলছে, শূন্যতা ঝুলছে আর শূন্যতা
থেকে আসলে কেউই আসছে না কেবল সাত রঙের পর্দা
ঝুলিয়ে দিচ্ছে শূন্যতা ঢাকতে। পোশাকে-আশাকে, পর্দায়, প্রাকারের
প্রত্যেকটি আলোক বৈচিত্র্যে কাহিনীর মধ্যেই পো গড়ে তুলছেন এক ধরনের ইল্যুউমিনেটিভ
ইকো, তারা ছড়িয়ে পড়ছে
গল্পের পরিসরে আর পরিসরের প্রজাতি ছাড়িয়ে দমিত বাসনাকে, দ্বন্দ্বের মাত্রাকে, গল্পের গায়ে লেগে
থাকা প্রস্তাবহীন বিস্ময়কে উসকে দিচ্ছে পাঠকের দিকে। চোখ বন্ধ করতেই রঙের
অনুভবে সে প্রত্যক্ষ ও নিয়মিত করতে পারছে কিছু বিচ্ছিন্ন মানসিকতা, মগ্নচৈতন্যপ্রবাহী
কিছু আলো তাপ আর অতীতের ভয়েজ-আউট। আর্তির ভেতর অন্ধকারের ভেতর দিয়ে পাঠকও কোণাকুণি এগিয়ে দিচ্ছে তার
নিজস্ব যাপনের উদাসীন কিছু নগ্নতা। ঠিক যেভাবে প্রস্পেরো সাজিয়েছেন
তাঁর প্রথম ঘর সম্পূর্ণ নীল রঙে, তার জানালাও নীল। দ্বিতীয় ঘরের সাজগোজ
রক্তিম অর্থাৎ লাল, তৃতীয় ঘর সবুজে ঢাকা, তার পর্দাতেও
সবুজের পরত, চতুর্থ ঘর কমলা আর
পঞ্চম ঘর সাদা, ষষ্ঠ ঘর বেগুনী। কেবল মাত্র সপ্তম
ঘরের পর্দা কালো - দেওয়াল কালো। যেন ছ-ছটি ঘরের আরোগ্যকে এক টানে
পো এগিয়ে নিয়ে চলেছেন সপ্তম ঘরের ভৌতিক রক্তপাতের দিকে, সংক্রমণের দিকে, মৃত্যুর সাথে
মোলাকাতের আগে এ যেন মদজীবনের এক অলীক মশকরা। ঘরের আলো থেকে শুরু
করে ধাতব ঘন্টার শব্দ অবধি পো সাজিয়েছেন নিখুঁত দক্ষতায়। গল্পের আঙ্গিকে
চিত্রনাট্যের ভাষ্য দিয়েছেন যা ক্রমশ চরিত্র ও অন্তর্মুখ বিষয়গুলিকে তাদের
গূঢ়োক্তিসমেত ধরে রেখেছে একটা বহুভাবনীয় থিম্যাটিক ফ্রেমে। মূল রচনার থেকেও ইন
দ্য মার্জিনে লেগে থাকা সেই ফাঁকগুলো, বেড়াপেরোনো ইকোলজিগুলো আর শব্দের ভার থেকে
ভয়েডের নির্মাণগুলোতেই পো পরিবৃত্তমূলক অস্থিতি খুঁজেছেন
বারবার। মৃত্যুকে স্বীকৃতি দিতে তাঁর সাহিত্যকর্মের
কাঠামো ঘটনাস্থল বা জলহাওয়ায় মৃত্যুরই ভাষাকে সেরা বিষয় করে তুলেছেন, চরিত্রগুলোকে তাদের
যথাযথে পৌঁছতে জাগাতে চেষ্টা করেছেন ঘুমন্ত মৃত্যুকে। যেন মৃত্যুর কাঁধে হাত রেখেই
গরম রক্তের দাগটা চিনতে চাওয়া। ‘দ্য কাস্ক অফ এমন্টীলাডো’তে ফর্চুনাটোর হাত ধরে কথক কার্ণিভালের মরশুমে সঞ্চারিত
করেছেন জাদুগরী ওমেগা পয়েন্ট, ভূগর্ভ কুঠুরি, খিলান, সোরা আর ছত্রাকের গন্ধ গড়িয়ে আসা গুহার ছাদ
চুঁইয়ে কিংবা দেওয়াল বরাবর নরকংকাল
স্তুপীকৃত হয়ে ছাদ অবধি উঠে যাওয়া – এসবের মধ্য দিয়ে কার্যত এক ভয়াবহ গথিক থিয়েটারের
প্রেক্ষাপট তৈরি করেছেন পো। সেখানে যেন
মানুষগুলোর হাতেই মৃত্যু, মানুষগুলোর হাতে
মরচে, সমস্তটুকু পরিবেশ
মৃত্যুরই প্রচারমূলক, মৃত্যুরই অভিপ্রেত
একটা নির্বিকার বাহারবাগানকে রচনা করে দেয়। থেকে যাওয়ার চকিত
হাসি ভেদ করে সেখানে ফিরে যাওয়ার নিঃশব্দ পদচারণা। সূর্যাস্ত রঙের এক মিথিকাল
মনোরমে পো থেমে থেমে তাঁর গল্পের গাঁথুনি রাখছেন, মশলা দিচ্ছেন, কর্ণিকের সাহায্যে কী নিঁখুত কাল্পনিক অনুমতি পেয়ে যাচ্ছে শরীরের গভীরে শায়িত শবের
উচ্চগ্রাম। কেবল ‘দ্য কাস্ক অফ এমন্টিলাডো’ বা ‘দ্য মাস্ক অফ দ্য রেড ডেথ’-ই না, ‘কালো বেড়াল’ বা ‘দ্য ব্ল্যাক ক্যাট’ গল্পের চরিত্রগুলোতেও
নিঃসঙ্গতা আর শূন্যতাবোধের শাঁসজল ক্র্যাফট
করেছেন পো। প্রিয় বেড়াল প্লুটো বা তার মৃত্যুর পর মিল পাওয়া
নতুন বেড়ালকে নিয়ে গল্প যত এগিয়েছে ততই বেড়েছে বর্ণনার বীভৎসতা, বাঞ্চিত বিশ্বের
মাঝে অবাঞ্চিত ভয়ের জগতটি ক্রমাগত বৃহত্তর হয়ে উঠেছে। বিড়ালটির একটি চোখ
নেই, বিড়ালটির সারা গায়ে
কালো লোম, অথচ বুকের কাছে সাদা লোমে ঢাকা এবং সাদা লোমটাও
ফাঁসি দড়ির আকারপ্রাপ্ত, যে ফাঁসি দড়িতেই
কথক তার প্রিয় বিড়াল প্লুটোকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল প্রতিহিংসার
প্রবৃত্তিতে। মৃত্যুর মাঝে কোনো ফাঁক রাখতে চাননি পো। রক্তের কাছাকাছি এসে
তাঁর চরিত্রদের অধিকাংশই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, পুড়িয়ে দড়ি দিয়ে
ঝুলিয়ে বা থেঁতলে হত্যা করছে উদ্দেশ্যসাধক কোনো এক জীবন্তকে আবার ভেঙেও পড়ছে এক রকমের করুণাহীন শীতলতার সামনে
দাঁড়িয়ে। গলা ফুলে উঠছে অপরাধীর নিজের। আসলে পো তাঁর চরিত্রগুলোর সেই
লুকোনো হাতগুলিকে ধরতে চেয়েছেন যেগুলি
অতৃপ্ত, অসন্তুষ্ট। তীব্র হতাশার শিকার প্রস্পেরো, বেরেনিস বা এম ভলডিমারের মতো একাধিক চরিত্র। এ হতাশার সীমানা নেই, কালো, ভয়ংকর ও সুউচ্চ এ
জরাগ্রস্থ ব্যক্তিমানুষগুলো, দ্বান্দ্বিক সংঘাতের সামনে
তারা মূঢ়, ভৌতিক কুয়াশার মধ্য
দিয়ে তাদের আরম্ভ আছে শুরু আছে, শেষ নেই। এক অদ্ভুত
নির্যাতন গুঢ়ৈষার সামনে দাঁড়
করিয়ে দিয়েছেন পো। মৃতদেহকে বারবার নির্যাতন করে যেন পাপমুক্ত করতে
চাইছেন, যন্ত্রণামুক্ত করতে চাইছেন, কাদা থেকে উপড়ে
ফেলতে চাইছেন মৃত্যুর সাথে সমঝোতা করে বেঁচে থাকার সুপ্ত কোলাজগুলিকে। এডগার পো-র গল্প থেকে কয়েকটা সংলাপ
আমরা বিচার্য করতে পারি, মৃত্যুর ভয়াবহতা প্রসঙ্গে প্রতিহননার শীতলতা প্রসঙ্গে তাঁর বিশ্বাস তাঁর
অনুভূতি তাঁর দ্বন্দ্ব তাঁর উদ্যম মনোভাবগুলিক ব্যাখা করতে। প্রতিটি প্রাণঘাতনের
মধ্যে এক নিঁখুত বরফভাষা, উদ্ধারহীন
স্নায়ুতন্ত্রে বসে আছে প্রসন্ন ফাঁসিকাঠ। ছোট এক খুপরির থেকে যেন জীবনকে
দেখছেন পো, যেখানে টাটকা সজীব বাতাস লাগার উপায় নে্ উপায় নেই জ,নালা ভেঙে ঝাঁপ মেরে
বেরিয়ে পড়ার, স্রেফ
মৃত্যুকামুকতাই ঝুঁকে আছে পেটে ভর দিয়ে ঘন ঘন পুঁজ নিয়ে...
১- ‘দ্য ফ্যাক্ট ইন দ্য
কেস অফ এম ভলডিমার’- “চোখ দুটো আপনা থেকেই খুলে গেল। মণি দুটো দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। চামড়াটাতে একটা বিশ্রী
সাদাটে রং ফুটে উঠল। আর দুই গালের ঠিক মাঝখানে যে গোলাকার জ্বরঠোসা দুটি স্পষ্ট দেখা
যাচ্ছিল সেটা সংগে সংগে মিলিয়ে গেল। কথাটা বললাম এই কারণে যে ঠোসা দুটো
মিলিয়ে যাবার সংগে সংগে হঠাৎই আমার মনে পড়ে গেল এক ফুঁতে একটা
মোমবাতি নিভিয়ে দেবার একটা দৃশ্য। সেই সংগে উপরের ঠোঁটটা শুকিয়ে গিয়ে দাঁতের
পাটিটা বেরিয়ে পড়ল, আর নিচের চোয়ালটা
ঠুক করে একটা শব্দ করে এমনভাবে ঝুলে পড়ল যে ফুলে ওঠা কালো জিভটা সম্পূর্ণ দেখা
যেতে লাগল”। (অনুবাদ - মনীন্দ্র দত্ত)
২- ‘দ্য ব্ল্যাক ক্যাট’- “ একদিন সকালে
বেড়ালটার গলায় একটা ফাঁস পরিয়ে দিয়ে তাকে
একটা গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিলাম। সে কাজ করতে আমার
চোখে অশ্রুর ধারা বয়ে গেল। তিক্ততম অনুশোচনায় কেঁদে উঠল আমার অন্তর; তাকে ফাঁসিতে ঝোলালাম কারণ আমি জানতাম সে একদিন
আমাকে ভালবাসত, আরও বুঝতাম যে সে
আমার প্রতি কোনো অন্যায় করেনি। তাকে ঝুলিয়ে দিলাম কারণ আমি জানতাম এই কাজটা করে
আমি পাপ করছি- যে পাপ এতই মারাত্মক
যে তার ফলে আমার অমর আত্মা এতদূর বিপন্ন হয়ে পড়বে যে- যদি তার কোনও সম্ভাবনা থাকে- পরম দয়ালু ও ভয়ংকর
ঈশ্বরের অপার করুণাও তার কাছে কোনও দিন
পৌঁছবে না”।(অনুবাদ - মনীন্দ্র দত্ত)
স্মৃতি–সম্পর্ক-স্বাধীনতা জীবনের চৌহদ্দিতে
লেগে থাকা এমন প্রতিটা বিশ্বাসই পো-এর কাছে এসে ফিরে গেছে
বারবার। প্লেটোর ‘অ্যালেগরি অফ কেভস’এর বন্দীদের মতো পো-কেও জীবন বন্দী করে রেখেছে
আলোর বিপরীতে, ভূগর্ভস্থ গুহার
ভেতর তাকে দেওয়া হয়েছে ছায়ার আনন্দ। গুহার দিকে মুখ করে যেন
দেখে যাচ্ছেন ছায়াদের বেরিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই, গুহার অনুরাগে কেবল এক
গর্ভস্তব্ধ ভাষা যা ছায়া আর গুহার দেওয়ালে
এসে পড়া আলোর অনুরণনে গড়ে তুলেছে আদিতম সংগীত। প্লেটোর এই
গুহাবন্দীদের আলোর কাছে ফেরত নিয়ে এলেও যেমন তারা ছিটকে ফিরে এসেছে ছায়ার
চক্রব্যুহে ঠিক তেমনই তাঁর চল্লিশ বছরের জীবনে প্রতিনিয়ত পাখিধরা ফাঁদে পড়েছে পো-এর প্রত্যাশা, তাঁর প্রতিদিনের
জীবনময় প্রার্থনা। ভার্জিনিয়ার শারীরিক
অসুস্থতার সময়গুলোতেই লিখে ফেলেন তাঁর কিছু বিশ্বখ্যাত কাব্য। ‘নেভারমোর’ ‘নেভারমোর’ এই অশুভ বার্তাবহ এক পাখিকে দিয়েই বলিয়ে নেন তাঁর
সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘দ্য র্যাভেন’ (The
Raven)। আসলে ভার্জিনিয়ার মৃত্যুর পর থেকেই পো কোথাও যন্ত্রণাকে ভয় পাচ্ছিলেন, যন্ত্রণাকে এড়িয়ে যেতে
চাইছিলেন, অপলক চোখে দেখতে
পাচ্ছিলেন আরও একটা অন্ধকার আরও একটা ঝড় আরও একটা কয়লার মতো জ্বলন্ত ছেঁকা
এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। ‘দ্য র্যাভেন’(The
Raven) কবিতাটি যা বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ তার বিশ্লেষণেও ‘দ্য ফিলোজফি অফ কম্পোজিশনে’ পো দুঃখবিলাসিতাকেই সঙ্গচারী করছেন। যেন সব আনন্দ ঘুমিয়ে
রয়েছে অবধারিত বিষাদের স্বরে। যেন প্রসাধনের হাওয়া লাগলেই
অর্জনের গঠনে ফুটে উঠবে এক তীব্র বর্জনের স্পর্ধা। আর এই পরিবর্জনেই পো খুঁজে
চলেছেন সেই নিরায়োজন যা শৈল্পিক মৌলতা
অবধি নিয়ে যাবে জীবন নামের অস্থিতিকে, জেগে থাকার মিথ্যেকে, যাপনের বানানো
প্রক্রিয়াকে, যেন মৃত্যুকে নিয়েই
দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা, যা দেখছি চারপাশে
সবই তো উড়ন্ত সবই তো উপেক্ষার, আর কবিতার মাঝে বসে তাই যেন বারবার স্পষ্ট করে
তুলছে আশ্রয়ের সন্ধানে আসা এক দাঁড়কাক। তাঁর দর্শনকে খুঁজতে
আলো ফেলে ছায়াকে উসকে দিয়েছেন পো, ঠিক যেমনভাবে শরীর ছেড়ে মেতেছেন শবকামুকতায়। ‘দ্য র্যাভেন’(The Raven)এর শেষ পংক্তিতে
উত্তম পুরুষ ‘আমি’, যে আসলে পো নিজেই, যখন বলেন -
“And
the Raven, never flitting, still
Is sitting, still is sitting
On the Pallid bust of Pallas just
Above my chamber door;
And his eyes have all the seeming
Of a demon’s that is dreaming
And the lamplight o’er him
Streaming throws his shadow on
The floor;
And my soul from out that shadow
That lies floating on the floor
Shall be lifted-Nevermore”-
তখনই বোঝা যায় কিছুতেই বাস্তবের সীমাকে অতিক্রম করা যাচ্ছে না, অতিক্রম করা যাচ্ছে না জগতের জড়িতকে। ‘দাঁড়কাক’ হিসেবে নিজের
অবচেতন মনকেই প্রশ্নকর্তা করে
নিজের সামনে হাজির করেছেন পো, আর সেই মৃত্যুর কাছে হারিয়ে যাওয়া নায়িকা লেনরের
মধ্য দিয়ে তাঁর মৃতপ্রায় স্ত্রী ভার্জিনিয়াকেই ফ্যানটাসাইজ করছেন। স্বপ্নদৃশ্যের মতো জা্নালা খুলে
দিয়েছেন দাঁড়কাকের আধারে তাঁর অবচেতন আধাচেতন কল্পনাকে জারিত করার জন্য, একের পর এক প্রশ্ন
করে গেছে কবিতার মূল চরিত্র, আর প্রতিবারই পাখিটার কাছে থেকে উত্তর এসেছে ‘নেভারমোর’ ‘নেভারমোর’। বারবার এই শব্দের পুনরাবৃত্তি
তাঁর ভেতরের নীরব বিষাদগ্রস্ততাকেই জাগিয়ে তোলে, জাগিয়ে তোলে ধূলো রঙের কিছু মহাশূন্যের কথা। ‘দ্য র্যাভেন’(The raven) কবিতাটির
সমান্তররাল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে laura Conde বলছেন, সম্পূর্ণ কবিতাতেই কোথাও আগাগোড়াই রয়ে গেছে পো-এর নিজস্ব অ্যালিয়েনেশন। প্রতীক শৃঙ্খলা
পেরোলেই পো-এর অন্তর্দশনের
প্রতিফলন। যেমন-
ন্যারেটর
|
পো
|
ঘরের ভেতর নিমগ্ন ছাত্রটিকে কিছুতেই স্থির হতে দিচ্ছে
না দাঁড়কাকটি।
|
আসলে নিজস্ব জীবনবোধই পো-কে ছেড়ে গেছে
কোলাহলময় প্রত্যাখানে যা থেকে কিছুতেই খুঁজ়ে পাচ্ছেন না বেঁচে থাকার রসদ।
|
লেনর প্রতি মুহূর্তে ভেবে যাচ্ছে তার
মৃত স্ত্রী/প্রেমিকার কথা।
|
ভার্জিনিয়া এ সময় মৃত্যু
পথযাত্রী আর পো জেনেও গেছেন সে সত্য, বার বার আশঙ্কিত হচ্ছেন বিচ্ছেদের
কথা ভেবে।
|
জানালায় ঝাপটের শব্দ
এলেও প্রাথমিকভাবে সে বিশ্বাস করেনি কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে।
|
পো-ও সাদা হাসি নিয়ে
প্রাণের লক্ষণ নিয়ে শুরু থেকে ভেবে
ছিলেন ভার্জিনিয়ার দ্রুত আরোগ্যর কথা। ভেবে ছিলেন
সর্বত্র এক পরিচিত আনন্দ অথবা অতিরিক্ত কিছু।
|
বারংবার ‘নেভারমোর’ উত্তর থেকেই শেষ
অবধি প্রেমিকটি বুঝতে পারে মৃত্যুস্পর্শিত এক জীবন কিছুতেই তার ঋণ মেটাবে না।
|
পো-ও বুঝতে পারেন
কেবল অন্ধকার অন্ধকার আর কিছু নয়, কেবল স্বপ্ন, স্বপ্ন আর কিছু
নয়। অনুভব করতে পারেন প্রতিটা রাত্রি কোনো না কোনো
উপকূলে কেউ না কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে। মুঠোয় ধরিয়ে যাবে শূন্য এবং স্বপ্নের নুয়ে
পড়া অবস্থানকে।
|
তাঁর সামগ্রিক যাপনের দিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে কীভাবে
বারবার প্রতিপ্রশ্নে জর্জরিত করেছেন নিজেকে, কীভাবে তাঁর ভয় তাঁর দুশ্চিন্তা হয়ে উঠেছে
একমাত্র পথ্য। ‘নেভারমোর’ শব্দটির সাথে সাথেই
যেন ধরা পড়েছে তাঁর শিথিল হয়ে যাওয়া গ্রন্থিগুলো। ক্ষয়ে যাওয়া ভেঙে
পড়া সূক্ষ্ম শব্দগুলো। মৃত্যু তাঁর কাছে
সেই প্রকৃত ভগ্নাংশ যা বিষণ্নতা দুঃখ পাপ সব কিছুর
অংশীদারিত্বে তাঁর সাথে চুক্তি করেছে, বধ্যভূমিতে নিয়ে
যাওয়া এক ব্যক্তিগত সত্য। ইনএসকেপেবল ডিলেম্মা। অ্যালান পো-র মুহূর্তগুলি ধরা আছে যেন
এমনই এক ‘কখনোই না’ শব্দবন্ধে। তাঁর কবিতার
গল্পের অত্যন্ত ঘরোয়া প্রেক্ষাপটেও মৃত্যু এসেছে অতিথির মতো, দ্রুত অন্ধকার করে
দিয়েছে প্রতিদিনের ব্যালকনি। এমনই মহার্ঘ্য কিছু সমাপ্তির অপেক্ষা করতে থাকে
পো- র মগ্নচেতনা, তাঁর আবিষ্কার আদতে সেই আকারহীন সত্য যেখানে
দাঁড়িয়ে বিকৃত হয়ে যাচ্ছে বেঁকে যাচ্ছে আমাদের এই থাকা, এই ভয়ংকর থাকা। সব কিছুই তো আসলে বিচ্ছিন্ন, বেঁচে থাকার অর্থ
তাঁর কাছে কেবল এক বায়বীয় আত্মনিগ্রহ ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি জানেন এই যে
পাথর বসিয়ে পলেস্তারা বসিয়ে মানুষ খুঁজে নিচ্ছে মানুষকে, খুঁজে নিচ্ছে তার
আস্তিক মনোজিনক্ তা আসলে এক শেষের গল্প, তাদের অভীপ্সা হচ্ছে শেষকে আটকানো, এক অসম্পূর্ণ দেওয়ালের ফোকর দিয়ে
মশলা গলিয়ে দিয়ে এক
মিথ্যে স্নানঘর বানানো যা আসলে সমাধিক্ষেত্র, বড় বেশি ঠান্ডা এক সমাধিক্ষেত্র। এক বন্দী শিবিরে
অভিনয় করছে পো-র চরিত্ররা। একা নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ হওয়ার অভিনয়। শ্রয়ডিঙ্গারের
বেড়ালের মতো তাদেরকে দেওয়া হয়েছে কেবল কিছু সম্ভাবনা, কিছু বিচ্ছিন্নতার
সমস্য্ কিছু বিষণ্নতার উচ্চা্রণ, তারা জানে মৃত্যুর
কাছে ঋণ অশেষ, ফেরার কাছেই একটানা জলের শব্দ অথচ তাকে হাড় আর
চামড়া দিয়ে তৈরি এক বাক্সে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘মুখর হৃদপিন্ড’ দিয়ে, যতক্ষণ না ওই বাক্স থেকে
তাকে বের করে আনা হচ্ছে ততক্ষণ তাকে শেকড়ের কথা বোঝানো
হচ্ছে, বোঝানো হচ্ছে তুমিই সেই মানুষ যে মৃত দরজা থেকে
পেরেকগুলো কিছুতেই খুলবে না। কিছুতেই না।
যে কোনো একটি প্রবন্ধ বা
একাধিক প্রবন্ধই পো-র সাহিত্যজিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পাওয়ার যথেষ্ট নয়, কারণ পো-র পুরো
জীবনটাই এক কুহককাহিনী। তবে প্রায় প্রতিটি প্রবন্ধের
প্রতিটা আলোচনার শেষে যে প্রশ্ন উঠবেই, তা তার গল্প কবিতায়
মৃত্যু মানে কেবলই কি হত্যা? নাকি মৃত্যু আসলে এক আশ্রয়! একটা প্রাণপণ অন্বেষণ বিশুদ্ধ স্বাধীনের! পিলপিল মানুষের বেদনাহীন
পর্যটন! ইনএক্সজটেবল হ্যাপিনেস! নাকি ইটারনাল
সাফারিংগস? আসলে একটা আস্তিক ডায়ালেকটিকে দাঁড়িয়ে এ যেন
ক্ষয়ে যাওয়া মানুষের পূর্ণতা বোঝাতে চাওয়া। ভীষণ জোরে জোরে ডানা
নাড়া সম্পূর্ণ ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার
আগে। নিজেকেই নিজে বলে ওঠা – “I
will sink into oblivion for eternal peace”। প্রশ্ন উঠবেই পো-এর মানসিক চরিত্র নিয়ে, প্রশ্ন উঠবেই তাঁর
চরিত্ররা কি মৃত্যুর মধ্য্ দিয়ে মুক্তি খুঁজছেন! নাকি, জীবনপ্রাচুর্য্যে ব্যর্থ মানুষগুলো মেনে নিচ্ছে
মৃত্যুর মতো কিছু সহজতম প্রাপ্তি! কিছু নিরাময়যোগ্যতা! তবে কি প্লেটোর
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পৃথিবীকে অতিক্রম করতে চাইছেন না পো! পার্থিব জগতের সব কিছুকে যেখানে
প্লেটো বলছেন ইমপারফেক্ট কপি বা অসম্পূর্ণ নকল এবং যেখানে অস্তিত্বের প্রতিরূপ খুঁজে
ফিরছেন পৃথিবী অতিক্রম করে আদর্শ এক ধারণার জগতে সেখানেই অতীন্দ্রিয় বা অলৌকিক আনন্দের বাইরে পো যেন জাগতিক বাস্তবের মাঝে মৃত্যুতেই
স্পষ্টভাবে তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস ব্যক্ত করছেন। সাহিত্যের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে
একটা সময় ছিল মানুষের অর্জনের বাইরে অমরতা নামের একটা অতন্দ্র এগিয়ে যাওয়া ছিল, যে অতন্দ্রতার প্রতি
মোহময়ী কাতরানি নিয়েও দান্তের উগোলিনো গড়াগড়ি দিয়েছে একচিলতে সুন্দরের প্রতি, যে পিপাসা নিয়ে
পার্থিব অ্যাসাইলাম থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছে নরকে দন্ডপ্রাপ্ত মুখগুলো, সেই প্রবেশের পথ
কিন্তু খুঁজ়ে পেতে চাননি পো। খুঁজে পেতে চাননি অধ্যাত্ম
অথবা দর্শন বরং প্রকট হয়ে উঠেছে ঈশ্বরের অসারতা, জীবনদেবতার প্রসঙ্গগুলি হয়ে
উঠেছে অপ্রাসঙ্গিক, কেবল বেঁচে থাকার
মধ্যেই পো-এর বিশ্বাস এক
মর্মভেদী দুর্ভাগ্যের প্রতি। ঈশ্বরের মহানতা চাননি পো
বরং সূক্ষ্ম ক্ষীণ
এক যন্ত্রণার ভস্মভূমায় পা ডুবিয়েছেন, পরগাছা হয়ে তাঁর
চরিত্ররা জড়িয়ে গেছে মানবজন্মের নিঃসাড় অর্থহীনতার সাথে। তাদের আইডেনটিটি
আকস্মিকতায় আকীর্ণ, না হলে কোনো ঘৃণার থেকে ক্ষোভ
থেকে অসহায়তা থেকে পালাচ্ছে যুবরাজ প্রস্পেরো! কেন জীবিত হয়েও দরজা
বন্ধ করে এক অবচেতন ভূগোলে, অ্যাবসার্ড স্বপ্নে বার বার ফিরে যাচ্ছে বেরেনিস! অস্তিত্বকে ঘিরে রয়ে
যাচ্ছে কেবল অস্পষ্ট হবার লম্বা সরু অত্যন্ত সাদা এক
স্পষ্টতা। ‘বেরেনিস’ গল্পের মধ্যে পো প্রধান চরিত্রের মুখ দিয়ে উল্লেখ করিয়েছেন
মনোম্যানিয়া নামের এক ব্যাধির, এক মানসিক বিকৃতির, যার আভিধানিক নাম অভিনিবেশ মানে ঢুকে পড়া মানে এক
গহন নিশীথের দিকে ফেরা, গোপন আশ্রয় চাওয়া বাহ্যিক অবস্থানের মাঝেই। এ
এক অভিনব অস্থিরতা, শরীরের ভেতররেই বয়ে
চলে সময়হীন বরফঠান্ডা স্রোত। মনোম্যানিয়ার বৈশিষ্ট্যের
সাপেক্ষে বেরেনিসের ভাইকে দিয়ে বলিয়েছেন- “ঘন্টার পর ঘন্টা ক্লান্তিবিহীন ভাবে একটা বইয়ের কোনও
অকিঞ্চিৎকর অলংকরন বা অক্ষরের দিকে অখন্ড মনোযোগের সঙ্গে তাকিয়ে থাকা।
গ্রীষ্মকালের প্রায় সমস্তটা দিন ঘরের পর্দা বা মেঝের উপর তির্যকভাবে ছড়িয়ে পড়া
ছায়ার দিকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে কাটানো; একটা বাতির স্থির শিখা অথবা অগ্নিকুন্ডের একটা
জ্বলন্ত অঙ্গারের দিকে তাকিয়ে সারাটা রাত নিজেকে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলা; একটা ফুলের গন্ধের স্বপ্নে
বিভোর হয়ে সারাটা দিন কাটিয়ে দেওয়া; বার বার একটি অতি সাধারণ কথাকে উচ্চারণ করে
করে শেষ পর্যন্ত তার
অর্থটাকেই হারিয়ে বসে থাকা; দীর্ঘ সময় ধরে
একটানা শরীরটাকে সম্পূর্ণ শান্ত করে রাখার ফলে গতির বা দৈহিক অস্তিত্বের ধারণাটাকেই হারিয়ে ফেলা”। সুখী জীবন ছিল না পো-এর, পাশাপাশি ছিল এক
রহস্যময় ক্লান্তি, জোর করে তল্লাশি
চালিয়েও সেখানে খুঁজে পাওয়া যেত না উৎসাহের অজুহাত, তাঁর চল্লিশ বছরের
স্বল্প জীবনে নিজেকেই থেঁতলে ভেঙে দিয়ে ‘বর্ণমালার শেষ অক্ষরে বসে’ ছিলেন পো, যেন এক কালজীর্ণ মানুষ যার গোপন আস্তানা কেউ জানে না। যার স্যাঁতসেঁতে নির্জন বাস
একেবারে নিঁখুত আর মৃত্যু যার কাছে মন্ত্রণাদাতা, সে তো শুনতে পাবে
না আনন্দের কথা, তামাশার কথা বরং
প্রকৃত অন্ধকারে তাঁর কৌতুহলী প্রবৃত্তিই হবে সেই আদিম আর্তনাদের খোঁজ।
একের পর এক কবিতায় গল্পে চরিত্রদের মাঝে খন্ড খন্ড পো-কে পাওয়া গেলেও অস্তিত্ব
সম্পর্কীয় তাঁর অনপনেয় সংশয়ের গ্রন্থিমোচন হয়তো সত্যিই আজও সম্ভব
নয়, কারণ জীবন নামের কোনো সমগ্রতায়
যে বিশ্বাস ছিল না পো-র। বিচ্ছিন্ন সত্ত্বাগুলোকে নিয়ে
তিনি জীবনের প্রতিরূপ খুঁজেছেন মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। আবার মৃতদেহটাকে
লুকিয়ে রাখতে চেয়েও লুকিয়ে রাখতে পারেননি, তক্তা ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে আমাদের দেহ গেহ আর
শারীরিক তন্তুসমবায়ের অসংযোজন। বেঁচে থাকার শাশ্বত
শোভাযাত্রায় আলো ফেলেছেন দন্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত মানব অস্তিত্বের দুর্বোধ্যতায়। ভাঙা
কালো পানপাত্রের দিকে টলতে টলতে হেঁটে গেছে যারা; যারা কালো ঠোঁটের মৃত্যুর
বিরুদ্ধে যারা দাঁড়ায়নি। দাঁড়াতে
চায়নি যারা। জীবনের সাথেই ধুয়ে ফেলতে
চেয়েছে জাগরণ। মঁতায়াগের সেই পরিহাস- “The
continuous work of our life is to build death.এর মতোই ক্ষতের খেলাতে বারবার
পো-আবিষ্কৃত হয়েছেন পৃথিবীর
শ্রেষ্ঠতম পরিবর্জন থেকে। খড়ির গুঁড়ো ছড়িয়ে
ছড়িয়ে আমরাও তো চলেছি পো-এর সাথে, একটা না হওয়ার সাথে, আলোর মতো পিপাসার সাথে অথবা
কেবল একটি সহজ অন্ধকারের সাথে। অন্ধকার তবু চেনা যাছে না কোথাও!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন