মুখাবয়ব : বহমান সময়ের ভাষ্য এবং রিয়ালিটির আত্মদর্শন
(৪)
প্রতিকৃতির ক্ষেত্রে বহু আগের আঁকা জন ভারমিরের গার্ল
উইথ আ পার্ল ইয়ারিং (১৬৬৫-৬৬) আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব পছন্দের ছবি। হল্যান্ডের এই
শিল্পীর আঁকা মুক্তো কানের মেয়ের প্রতিকৃতি হারিয়েই গিয়েছিল সময়ের গর্ভে, কিন্তু
পরবর্তীতে তাঁর মাত্র চল্লিশটির মতো ছবি আবিষ্কৃত হয়, যা রেমব্রান্ট সমগোত্রিয়
উচ্চতায় তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করার পক্ষে ছিল যথেষ্ট। চূড়ান্ত দুঃখ দুর্দশার মধ্যে
শিল্পীর জীবন কাটলেও কানে মুক্তোর দুল পড়া, মাথায় স্কার্ফ এই মেয়ের ছবি চিরস্মরণীয়
হয়ে থাকবে ছবির ইতিহাসে। এই ছবিটি আমার অত্যন্ত প্রিয় প্রতিকৃতির মধ্যে একটি হলেও,
যেমন রুবেন্সের সুজেনা ফোরমেন্ট, যেমন মোনালিসা; সমস্যা হলো এসবই পুরুষের চোখে
দেখা মানবী মুখ। যেখানে মনোমুগ্ধকর মায়াবী প্রকাশই সর্বাধিক মান্যতা প্রাপ্ত
হয়েছে। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করে, নারী শিল্পীর চোখে দেখা মেয়েদের জগত ঠিক কীরকম?
সেখানে রিয়াল ও ফ্যান্টাসির যৌথতার রূপই বা কীভাবে প্রকাশিত? রিয়াল সেখানে কী
পর্যায়ে, কোন সময়ের ঘাত প্রতিঘাতে রূপ পেয়েছে?
***
আর এই তাগিদ থেকেই সবশেষে যার ছবি নিয়ে আলোচনা তিনি
প্রতিকৃতি এঁকেছেন আত্মস্থ হয়ে, নিজের অর্থাৎ আত্মপ্রতিকৃতি। এক্ষেত্রে ফ্রিডার
সহজ সরল স্বীকারোক্তি, জীবনের সব চাইতে বেশি সময় কাটিয়েছি নিজের সঙ্গে, তাই
নিজেকেই প্রকাশ করেছি। আর সেইসব প্রকাশিত সত্ত্বা হয়ে উঠেছে আমাদের বর্তমান
যাপনেরই কথা। ফ্রিডা নিজেকে কখনও এঁকেছেন ভাঙা শিরদাঁড়ায়, কখনও হাত ধরাধরি করে দুই
মানবী পাশাপাশি বসে আছেন। আসলে তা তো একজনই – দ্বৈত সত্ত্বা। এইভাবে নিজেকে
ভেঙেচুড়ে আমরা ক’জনই বা নিজেদের দেখি, দেখতে পাই বা দেখতে চাই! নিজের মধ্য দিয়ে
শিল্পের, জাতির ইতিহাসকে সংস্কৃতিকে তুলে ধরার তাগিদ ক’জন শিল্পীই বা অকপটে, নিবেদিতভাবে
প্রকাশ করেছেন? নিজেকে সম্পূর্ণ প্রকাশ করার সাহস ও দক্ষতা এক অসীম প্রতিভা; এবং
তা অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠে, যখন এই প্রকাশিত আমি শিল্পের হাত ধরে ইন্ডিভিজুয়ালিটিকে
ছাড়িয়ে সমগ্রের কথা বলে। ফ্রিডার আরও এক আত্মপ্রতিকৃতি, যেখানে দুই পাশে দুই পশু।
যা ফ্রিডার অন্য অনেক ছবিতেই রূপকার্থে লোভ লালসাকে প্রকাশিত করেছে; আমাদের এই
বিপন্ন সময়ে একাকীত্বের ভেতর জমতে থাকা চাহিদাগুলোকে এমন শৈল্পিকভাবে প্রকাশ করেছে
অসামান্য দক্ষতায়। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি এই
শিল্পীর ছবির সামনে… কিন্তু ফ্রিডা কি শুধু নিজের কথাই বলেছিলেন? মেক্সিকান এই মেয়ের বেঁচে
থাকা বিশ্বের অন্য যে কোনো প্রান্তে বেঁচে থাকা মানুষের থেকে কি খুব আলাদা?
ফ্রিডার স্থানীয় শিল্পের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ স্পষ্ট।
যে শিল্পী বেঁচে আছেন নিজের মধ্যে, নিজেকে খোঁজার মধ্য দিয়ে তিনি একাত্ম হয়ে
যাচ্ছেন মেক্সিকান জাতির ইতিহাস সংস্কৃতির সঙ্গেও। ফ্রিডার জীবন, যেখানে অসুস্থতা
জীবনের দীর্ঘতম সময় বিচলিত করে রেখেছে তাঁকে; কিন্তু যত বেশি আঘাত পেয়েছেন তত বেশি
নিজেকে যেন জানতে পেরেছেন। সময়ের অস্থিরতা ও রিয়ালিটির দ্বৈততা সোজাসুজি তুলে
ধরেছেন।
ফ্রিডার আত্মপ্রতিকৃতির কাজে কোনো চমক নেই। সোজাসুজি যেন
আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন শিল্পী নিজে, আর তাকিয়ে থাকতে থাকতে আয়নাটাই
আস্তে ধীরে হয়ে উঠেছে ক্যানভাস। যেখানে কোনো বহির্বিশ্ব নেই। আত্মস্থ শিল্পীর
নিজের ভেতরেই এক মগ্নডুব। ভাঙা শিরদাঁড়াও সেখানে অনেক বেশি দৃঢ় যেন, তীব্র ব্যথা ও
তার ছায়া এমন নিপুণ অথচ সরলভাবে এঁকেছেন যেন বলতে চাওয়া – “true science and true art have always
existed and will always exist just as other form of human activities”.
ফ্রিডার আত্মপ্রতিকৃতিতে কখনও মাথার জংলা কাঁটা ঝোপ ও
গলার কাছে পাখি, যেন কিছু বলতে চাওয়ার বা জীবনের গানটি গাইতে চাওয়ার দুর্নিবার
ইচ্ছার প্রকাশ। আবার অন্য ছবিতে চেয়ারে বসে আছেন, তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন
অচেনা কোনো মুহূর্তের দিকে। যেখানে নিজেকে আবিষ্কারের হাতছানি। অন্য ক্যানভাসে
প্রেমিকের সঙ্গে নিজেকে অর্ধেক জুড়ে দিয়ে প্রকাশিত করেছেন; খুঁজে দেখছেন, যা বলে দিচ্ছে
ভালোবাসার কথা। রিকার্ডোর সঙ্গে তাঁর যৌথতার কথা।
ফ্রিডা আত্মপ্রতিকৃতি ছাড়াও পোর্ট্রেট এঁকেছেন, কিন্তু
তাঁর নিজেকে খোঁজার যে নিরন্তর প্রয়াস তা অনেক বেশি প্রভাবিত করে। ভাবায়। স্তব্ধ
দাঁড় করিয়ে রাখে ছবির সামনে। ক্যানভাসগুলো আস্তে আস্তে পালটে রূপ নেয় আয়নার। দেখতে
পাই নিজেকে। সময় কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। দেশ কাল সীমানার গন্ডি ছাড়িয়ে
ক্যানভাসগুলো হয়ে যায় প্রতিটি মেয়েরই আত্মপ্রতিকৃতি। এর শেষ খুঁজে পাওয়া যাবে
কোথায় তা জানা না গেলেও এই প্রতিকৃতিগুলো থেকেই বা ফ্রিডার হাতে হাত রেখেই
অধিবিদ্যার চর্চা শিল্পের চূড়ান্ত নির্মাণকে খুঁজতে বাধ্য করে। ফ্রিডার ছবির
নিজস্বতার জায়গায় তিনি কতটা সৎ ছিলেন তা শিল্পীর ওপর আরোপিত উপাদানগুলির প্রতি
ঔদাসীন্যপূর্ণ প্রকাশ থেকে ধরা পড়ে।
***
শিল্পীর এই নির্বাচন, প্রধান পাঁচজন শিল্পীর প্রতিকৃতিকে
বিশ্লেষণ, সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত। পাঁচজন এমন শিল্পী যাঁদের জীবনে শিল্পসৃষ্টি
জীবনের সকল বাস্তব অনুভূতিকে প্রকাশিত করেছে যেমন, তেমনি এই পাঁচজন শিল্পীর শিল্প
বিশ্লেষণের অনুসঙ্গে আসা অন্যান্য শিল্পীর প্রতিকৃতির অধ্যয়ন সীমানা অতিক্রম করে
নতুন নতুন জগতের সন্ধান দিয়েছে একই সঙ্গে। মানুষের মুখ দেখাচ্ছে সভ্যতার মুখ।
মোনালিসা থেকে ফ্রিডা কলহোর পথ চলাটা ছবিতে ধরা পড়েছে স্পষ্ট। আর এখানেই শিল্পে
পোর্ট্রেটের গুরুত্ব। শিল্পীর জীবনে প্রতিকৃতি চর্চার প্রতি ভালোবাসা এই কারণেই
খুব সহজাত।
রিয়াল থেকে
যাত্রা শুরু করে ঘুড়ি হাওয়া ভেদ করে, ইমেজারি রিয়ালের হাত ধরে আরও ওপরে উঠে
গিয়েছে। অনেক ওপরে। যেখানে ঘুড়িকে উড়তে দেখলে মাথায় জন্ম নেউ সুপার রিয়ালিজম। আর
যত সময় এগিয়ে যাচ্ছে, তত বেশি ঘুড়ি মেঘের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। যেখানে স্তব্ধ ঘুড়িকে
দেখছি। অনেক প্রশ্ন জাগছে মনে, প্রকাশিত হচ্ছে সে সবই শিল্পে। কিন্তু ঘুড়িটা কি
আদৌ উড়ছে? ঘুড়িটা কি স্তব্ধ? এত উঁচুতে চোখও তো যায় না ঠিকমতো! মুখগুলো কেবলই কি ভাঙাচোরা, সিন্থেটিক, বিপন্নতার ফাটলে কোনো
এক চৌখুপে আটকে পড়া ভাবলেশহীন, অভিব্যক্তিহীন, মেদ মাংসহীন খোলসের নামান্তর হয়ে
উঠছে! পথ হাঁটছি একটা টানেল ভিসনে। রিয়ালিটি পাড়ি দিচ্ছে হাইপার রিয়ালিটিকে ছুঁয়ে
দেখতে। মুখগুলোই সেখানে মুখ্য। প্রতিকৃতি – একজনকেই আঁকলেই ধরে ফেলা যাবে সময়কে,
মুখের রেখার ত্রিকোণমিতি যেখানে ধরে রাখবে
সংস্কৃতিকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন