অন্তহীন শকটের চাকার নিচে
(১)
এক একটা দিন চলে যায় নিস্তরঙ্গ, ঠিক ঘটনাহীন নয়, কিন্তু সেই সব ঘটনাসকল সব পূর্বেই ঘটে গেছে যেন। রোদের তেজ বাড়ার সাথে সাথে ঘুমভাঙা, প্রাতঃকৃত্য, খবরের কাগজ, যন্ত্র-বাক্সের ছলাকলা, ঘরোয়া কথা। এসব বহু বহু বছর যাবত একই সুরে একটানা বেজে চলেছে। আজকের সকালটিও তেমন সব প্রাত্যহিক ঘটনা ঘটাবার জন্য একটু একটু করে জেগে উঠল। ভোরের নরম আলোয় আয়নায় চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম, নিজেকে আগন্তুক মনে হচ্ছে, যেন অনেক বয়স বেড়ে গেছে, চামড়া কোঁচকানো, ভাজগুলো দৃশ্যমান। পঞ্চবিংশতিকালে নিজের এমন অবয়ব দেখে ভয়গুলো দানা বাঁধতে শুরু করে, চোখে ভেসে ওঠে লাল-নীল অদৃশ্য আলোর ফুটকি। নিজেকে লুকোবার জন্য অগাস্টের গরমে গায়ে চাপালাম সাদা-কালো প্রিন্টের ফুলহাতা জামা। কালো ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে ঘোমটার মতো করে টেনে রাখলাম মুখের ওপর, পায়ে ফিনফিনে সকস্ আর জুতো। বাড়ির লোকেরা নিজ নিজ গন্তব্যে বেরিয়ে পড়লে একবারও পেছনে না ফিরে সর্পিল গতিতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করি। বুঝলাম, গায়ে একদম শক্তি নেই, পা দুটো জুতোর চাপে দমবন্ধ হয়ে মরছে। নিচতলার সাদা চুল নারী পেছন থেকে ডাকলে কোনো সাড়া না দিয়েই গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে জোড়ে হাঁটতে থাকি। চারপাশে কী হচ্ছে, কারা সব চলেছে, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল একটা সরু টানেল ধরে চলেছি যার শেষ প্রান্তে পৌঁছুতে হলে কেটে যাবে কয়েক সৌর বছর। তবু টানেলের শেষ মাথা কোনোদিন দেখা যাবে কি!
কোথায় যাচ্ছ? বন্ধুর ডাক শুনে মুখের উপরে ওড়নাটা বড় করে টেনে দিলাম। বন্ধুটি দ্রুত হেঁটে আমায় ধরে ফেলল। কী ব্যাপার দৌড়াচ্ছ কেন? আর এত বড় নেকাব কেন? ব্যাপার কী? তোমার নাস্তিক্যবাদে ভাঙন ধরল নাকি? ওর দিকে না তাকিয়ে ওড়নাটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কথা বলতে গিয়ে টের পেলাম গলা দিয়ে বুড়ো মানুষের মতো ঘড়ঘড় শব্দ বের হচ্ছে। অনেক কষ্টে কাজ আছে বলে সামনে সারি করে দাঁড়ানো রিকশার একটাতে চড়ে বসলাম। পেছন ফিরে বন্ধুটিকে দেখবার সাহস হলো না। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। নিজের এমন আকস্মিক পরিবর্তনে অজানা, অচেনা শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে, স্নায়ুগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, সারা শরীর উষ্ণ হয়ে আছে। রিকশার হুট আঁটকে শক্ত করে দু’পাশের ঝুলে থাকা সোনালি রেক্সিনের হাতল ধরলাম, গায়ের জোর কমে গেছে আর গলার ভেতরে খসখসে অনুভূতি। কই যাইবেন? রিকশাওয়ালার প্রশ্নে চমকে উঠলাম। তাই তো, কোথায় যাব? সেটা তো ঠিক করি নি! আর নিজের এই পরিবর্তিত অবস্থায় কারো কাছে যাবার তো প্রশ্নই আসে না! হঠাৎ ভয়ানক শ্বাসকষ্ট আরম্ভ হলো, গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সি রিকশাওয়ালাটি রিকশা দাঁড় করিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে বিস্ময় না বিরক্তি, বুঝতে পারলাম না। রিকশাওয়ালার চোখ থেকে বাঁচবার জন্য বামে চেপে বসলাম, জর্জেটের কালো ওড়না দিয়ে এবার পুরো মুখ ঢেকে দিয়ে বললাম সিবিলি। সারা পথ ওড়নার ভেতর হতে চেনামুখ খুঁজতে খুঁজতে চলা। নিজের পরিবর্তনটা কেমন কী বুঝতে পারলাম না। শুধু একটা অসহ্য অস্বস্তিকর অনুভূতি সারা শরীরে, চামড়ার মধ্যে কে যেন সুঁই ফুঁটিয়ে দিয়েছে। সাত মসজিদ রোডের পথে পথে ভাসমান রেস্তরাঁ, পিজা-প্যালেসগুলো দাঁড়িয়ে আছে। তরুণরা হৈ হৈ করতে করতে যাচ্ছে। গাড়ি ছুটছে, রিকশার টুংটাং। এখনও অনেক অফিস যাত্রি সারি করে বাস স্ট্যান্ডগুলোতে দাঁড়িয়ে। তাদের চোখে-মুখে বিরক্তি, বিস্ময়, আনন্দ, বেদনা। সাদা ফুলহাতা শার্ট, সিগারেটের ছাইরঙ্গা প্যান্ট পড়ে দাঁড়ানো ছেলেটি সরাসরি আমার রিকশার দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে নিজেকে লুকানোর জন্য জড়োসড়ো হয়ে বসলাম।
(২)
দীর্ঘদিন এই শহর ছেড়ে কোথাও যাই নি। প্রতিদিন এখানকার ব্যস্ততম এভিনিউ দিয়ে এমনভাবে হেঁটে গেছি যেন বাড়ি ফেরা ভীষণ জরুরি। দিনগুলো একটার গায়ে আরেকটা আটকে গেছে, কোনোদিন আর তাদেরকে আলাদা করে চেনা যাবে না, এমনকি মনে করতেও পারব না বছরের শুরুর দিনগুলোর কথা, কেমন করে কেটেছে সময়? তার আগের সময়? সব দিনকেই একরকম মনে হয়। তলহীন, অস্বচ্ছ, গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে। একটু একটু করে গুটিয়ে নিয়েছি নাটাইয়ের সুতো। এখন সুতোকাটা ঘুড়ি শূন্য মাঠে পড়ে আছে অথচ অনুসন্ধিৎসু বালক-বালিকারা সে ঘুড়ির সন্ধান জানে না।
নিয়মমতো সপ্তাহের কয়েকটি দিন অতিচেনা এই শহর ছেড়ে কাছের শহরতলিতে যাই, সেখানের ছাপাখানায় কাজ করতে করতে বেলা গড়িয়ে গেলে বুভুক্ষের মতো ছেড়ে যাওয়া শহরের চারকোণা ঘরে ফিরে আসি। এই ঘরের বাসিন্দারা নিঃশব্দে চলাচল করে। তাদের কথা বলার স্টাইল মৃত শহরের কথা মনে করিয়ে দেয়, যে শহরের বাসিন্দারা শ্রবণ শক্তি হারিয়েছে বহুকাল কিন্তু কথা বলার পুরনো অভ্যাসটা রয়ে গেছে আজও। সপ্তাহের অলোকোজ্জ্বল দিনগুলোয় তিনতলার চৌকো ঘরে থাকাটা অসম্ভব হয়ে ওঠে, শুয়ে শুয়ে কড়িকাঠ গোনা আর মানবতত্ত্ব পাঠ শরীরে অস্থিরতা এনে দেয়। চারকোণা বাক্সগুলো গুতোগুতি করেও কোনো সুখপ্রদ দৃশ্য দেখা যায় না, শোনা যায় না কোনো মনোরম সঙ্গীত। প্রতিদিনের খবরের কাগজ পুরনো বছরের খবর ছাপতে থাকে আর বাইরের গা জ্বলে যাওয়া উত্তাপ হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। এমন দিনগুলোতে আলমারির দেরাজ, বালিশের তল, চৌকোণা ঘরের বাসিন্দাদের পকেট হাতড়ে হাতড়ে কিছু পয়সা পেয়ে গেলে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসি, বহু বছরের পুরনো ভেঙে যাওয়া সড়ক ধরে হাঁটতে শুরু করি। এক সময়ে লক্ষ্য করি ক্ষয়ে যাওয়া রংওঠা কোনো গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ভেতর হতে ডাক আসার পর নিজ ঘরের সাদৃশ্য আরেকটা চৌকোণা ঘরে প্রবেশ করি। সেখানে বাদামী পোশাক পড়া বন্ধু ঐ সব কথা বলতে শুরু করে যা সে বহুদিন আগেই আমাকে বলেছে, তবুও নতুন করে আবার সে কথাগুলোই সে শোনাতে চায়। আমিও তাকে শহরতলির গল্প বলি, বনসাইগুলো দিন দিন আরও ছোট হয়ে উঠছে সে কথা বলি। বন্ধুটি অস্থির হয়ে ঘরের অন্য কক্ষে যাতায়াত শুরু করলে বুঝতে পারি মধ্যাহ্ন উতরে গেছে বহু আগেই। ঝকঝকে রোদ ঝলসানো ব্যস্ত দিনের কোনো কোনোটি আচমকা বুকের ভেতর তরল অনুভূতি তৈরি করে, তখন স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে আসা ফলবান বৃক্ষের কথা মনে পড়ে, লেকের জলে রাজহাঁসের সারিবেঁধে ডুব সাঁতার কাটার কথা মনে পড়ে। সে সমযে রিকশা নিযে চলে যাই শহরের কেন্দ্রে। অযুত-নিযুত মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, খুঁজে-ফিরি নতুন চাহনি কিন্তু বরাববরের মতো ক্লান্ত লাগে, পুরনো জমে যাওয়া সেসব চোখের ভাষা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায চেনা চৌকোণা ঘরে।
(৩)
রিকশাওয়ালাকে দ্রুত চালাতে বললে সে বারবার রিকশার চেন ফেলে দেয়, ধৈর্য্য থাকে না। এক সময় রিকশা ছেড়ে উদ্যানের সবুজ ঘাসে গিয়ে বসি, মাথার উপর চক্রাকারে কাক । চাওয়ালারা ঘুরতে থাকে উদ্যানে আগত মানুষের মাঝে। দূরে একজোড়া জুটি ঘনিষ্ঠ হযে ওঠে আর তরুণদের একটা দল কলরব করতে করতে চলে যায়। এইসব উৎফুল্লতাকে ছবির মতো মনে হয়। নিজের কোঁচকানো চামড়া, অমসৃণ হাত, আঙুল চোখে পড়ে। বহু লোক চলে যায। কেউ লক্ষ্য করে না। একজন বয়স্ক তরুণী উদ্যানের ঘাসে বসে আছে, এই বিষয়টা কাউকে আকৃষ্ট করে না। ক্রমশ মাঠের মধ্যে ছেলেমেয়েদের ভিড় বাড়তে শুরু করলে উদ্যানের গেট পেরিয়ে বড় রাস্তায় চলে আসি। পেছন হতে চেনা গলা ডাকতে থাকলে খোলা রাস্তায় নিজেকে লুকোবার কোনো জায়গা খুঁজে পাই না। বন্ধুটি পেছন হতে এসে হাত ধরে ফেলে, কী রে কেমন আছিস? আমাকে দেখে পিটপিট করে হাসতে থাকে। ক্রমাগত ঘামতে থাকি, গলা শুকিয়ে আসে, গলা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ বের হয়, উত্তর দিতে পারি না। বন্ধুটি টানতে টানতে ফুটপাত ঘেষে দাঁড়ানো দেওয়ালের কাছে নিয়ে গিয়ে এই সপ্তাহের ঘটে যাওয়া প্রতিটি দিনের খুঁটিনাটি বলতে থাকে। আমার ঘ্যষঘ্যাষে গলা, কোঁচকানো অবয়ব তার চোখে পড়ে না। মধ্যাহ্নে সূর্যটা সরাসরিভাবে শহরের উপর উত্তাপ ছড়াতে থাকে। পা ধরে আসে, বন্ধুর সাথে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়। চৌকোণা ঘরে ফিরে যাবার জন্য অস্থিরতা বোধ করি। নিজের পরিবর্তন অন্যেরা টের পাচ্ছে না দেখে মনে খটকা লাগে, নিজের আঙুলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি ওগুলো বদলে গেছে।
ভেতরটা দম বন্ধ হয়ে মরতে শুরু করলে বন্ধুর হাত ছাড়িয়ে নিই। অস্থিরতার কানা উপচে পড়ছে, ভূতগ্রস্তের মতো ছুটতে থাকি। চায়ের দোকান হতে চা কিনে খাই। এলোমেলো পায়ে সাড়া শহর হেঁটে হেঁটে আয়নায় নিজেকে দেখি ফিরে ফিরে। আয়নায় বয়স্ক একজন মানুষের অবয়ব দেখতে পাই আর ভয় আমায় জড়োসড়ো করে কুণ্ডুলি পাকাতে থাকে। শহরের কেন্দ্রস্থলে বহুলোক ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছোটাছুটি করে, তাদের সাথে ভিড়ে মিশে থাকি, নিজেকে জড়োসড়ো করে ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে রাখি। ভেতরে অবিমিশ্র সব অনুভূতি হয়, প্রাত্যহিক নিরানন্দ অনুভব করি না। গাড়ির ভেঁপু, হর্ন, ট্রাফিক পুলিশের হুইসেল তীব্রভাবে কানে প্রবেশ করে। ছোটাছুটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়লে মাথা শূন্য হয়ে যায়, পূর্বাপরহীন সব ভাবনাগুলো ছেড়ে যেতে থাকে, সেইসঙ্গে সরে পড়বার টানও অনুভূত হয় যার আয়ুষ্কাল হয় ক্ষণস্থায়ী। তারপর ভিড় কাউন্টারে খুচরা পয়সা জমা দিয়ে শকটে চেপে যেতে থাকি যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই শকট আমায় পৌঁছে দেয় ফেলে যাওয়া শহরটিতে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন