আমার কুয়াশারা
আমার শহরে যে একটা গুপ্ত দরজা আছে, জানা ছিল না। প্রাচীন ছিদাম মুদির গলি, রামাকান্ত মিস্ত্রির গলি, ছকু খানসামার গলিগুলোতে রান্নার গন্ধ নেওয়া অথবা দূর থেকে ভেসে আসা রেডিওর গান শুনতে শুনতে হেঁটে যেতাম বল্গাহীন। গঙ্গার শীতল হাওয়া ছুঁয়ে থাকা সেসব গলি কত যে রহস্য রেখেছে মহার্ঘ নীলাম্বরী জড়িয়ে! ইট খসে পড়া পাঁচিল, রংচটা দেওয়ালে শ্যাওলার প্রাচীনত্বের ঘ্রাণ বিবশ করত আমায়। দীর্ঘকাল ড্রাগ নিতে অভ্যস্ত যুবককে রিহ্যাবিলিটেশনের কারণে যখন আটকে রাখা হয় মাদক ছাড়াই, তখন তার যে অবস্থা হয়, আমিও তেমনি ছটফট করি গলিগুলোর মাদকতাময় গন্ধ না পেলে। সন্ধ্যায় গঙ্গার হাওয়া আর চিনেবাদামে ঢিলেঢালা হাঁটতে হাঁটতে সামনেই যে বড় বাড়িটা পড়ে, দেখলেই বোঝা যা্ বহু বহুদিন একা দাঁড়িয়ে আছে কিছু বলবে বলে। বাড়িটার পাশে ঘাসে রুমাল পেতে বসি। সূর্য তখন লাজুক বউয়ের মতো ঘোমটা টেনেছে। একটু একটু করে নতুন হয়ে উঠতে থাকে পুরনো বাড়িটা। রেলিঙে নতুন পালিশ। জানালার কাচে রঙিন মিনাকারী। সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে বেজে ওঠে সান্ধ্যকালীন শঙ্খ। নাচঘরে আজ আলো নেই। সঙ্গীত নেই। নেই বেলোয়ারী চুড়ির ঠমক, সুরার মত্ত মুজরা। সেখানে কোনো গোপন পরামর্শ চলছে, শহরকে বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাওয়ার। ওরা একমত হতে পারছে না কিছুতেই। অস্থিরতায় মাথা নাড়ছে ঘন ঘন। বোঝাই যাচ্ছে, ওদের হাতে সময় বড় কম। বাড়িটার মায়াজাল ওরা বুঝি টের পায় নাভির গভীরে। তাড়াহুড়ো বেড়ে যায়। ফুরফুরে জ্যোৎস্না ফিরে যায়। কোথা থেকে একরাশ কুয়াশা এসে জড়িয়ে ধরে রাত্রিকে। বাড়িটা গা এলিয়ে দেয়। রঙ হারিয়ে, রেলিঙের পালিশ হারিয়ে মরে যেতে থাকে একটু একটু করে। লাল টুকটুকে বেনারসি, কপালে সিঁদুরের টিপ দেবী সিদ্ধেশ্বরীকে, কেউ কেউ দেখে ফেল্ সাবেকী বাড়িটাকে একা ফেলে চলে যেতে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন