রমাকান্ত নামা—গন্ধবিলাস
ঘর চাই একটা, জীবন ধারণের। যেখানে একান্ততার নিবাস। ঘরের মধ্যে আর কী চাই? সুন্দর স্বচ্ছদ একটা পালঙ্ক।
লাগাম ছাড়া ঘোড়া হতে পুরুষদের ভালো লাগে। চরিত্র নিয়ে টানাটানি যতই কর না কেন -- মন বিশ্লেষণে দেখবে, পুরুষদের গভীরে চরিত্রহীনতার বীজ জমা থাকে। সে বীজ উর্বর ভূমিতে না পড়লেই হলো। কিন্তু এ ভাবে কি আর জীবন চলে? পেট নামের এক হারামি বস্তু শরীরে জোড়া থাকে। ওটার কাজ হলো কুঁই কুঁই করে সময়ে অসময়ে জানান দেওয়া। ওটাই কিন্তু মানুষকে একটু স্থিরতা দিয়েছে। পেটে কিছু দিতেই হবে আর সেই জন্যে রসদ যোগাতেই হবে। তাই কর্ম কর, অন্তত পেট পূরণের কর্মটুকু!
এবার নচ্ছার মনের কথা ধরা যাক -- পুরুষ বা নারী কেউ কি একক ভাবে সম্পূর্ণ? নৈব নৈব চ! কদাপি নহে! নারী পুরুষের বিচ্ছেদে পৃথিবী জনশূন্য হতে পারে এ কথা রমাকান্তর বিশ্বাস করেন। তিনি জানেন, এ প্রকৃতিই সাজিয়েছে লালি-পপ -- সেই পূর্ণবয়স্ক হবার আগে থেকেই। রং-বৌছার চোখ ধরে রাখে এই আকাশ চাঁদ সূর্য তারা ফুল প্রজাপতি, সব সব; জীবনের প্রাথমিক জালফাঁস তো এভাবেই তৈরি হয়। আসলে মন বেষ্টনে প্রকৃতি, প্রেম ও শরীর উদ্গার আগেভাগেই নরনারীকে মাখিয়ে রেখেছে। পুরুষ এবার স্বপ্নের রঙিন ছাতা উড়িয়ে ফুরফুরে হাওয়ায় ঘুরে বেড়ায়। আর দেখে লাবণ্য, বসন্ত হওয়া ছাড়ে, আকাশে বিছিয়ে যায় ফুল পাপড়ি, আহা আহা, মন-মানস পুলকিত জলে যেন টইটম্বুর! শুরুতে একটু উদাসীনতা থাকে, চুলে বাতাস ঢেউ খেলিয়ে যায়, এলোমেলো সৌন্দর্যের মাঝেই প্রকৃতি ভালোবাসা খেলে যায়। তখনও দৈহিক চাহিদার উন্মেষ ঘটেনি, রমাকান্ত তাঁর স্ফূরণ চোখে দেখেন সব রঙের খেলা।
ঋতুনকে তখন তিনি চেনেন না, কিন্তু তার গন্ধ পান, তার চুলের গন্ধ, রঙ পোশাকের গন্ধ। তার সাথে প্রায়ই দেখা হয়, কিন্তু কথা হয় না। একই পাড়ায় ঋতুনের বাস, সেটা রমাকান্ত জেনেছেন। বসন্ত কাল চলছিল। ঋতু আজকাল ঋতুমার হয়ে গেছে। প্রকৃতি আজকাল ঋতুছাড় হয়ে গেছে, তা না হলে বসন্তের শুরুতেই এমনি বৈশাখী ঝড় হবে কেন? আম তখন বোলের মধ্যে বন্ধ। রমাকান্তর তখন আম কুড়োবার কথা খুব করে মনে আসছিল। তিনি বাড়ির দিকে ফিরছিলেন। চারদিকে অস্পষ্ট অন্ধকার। ধুলোর আস্তরণ তাঁর চোখের সামনে। কান্নার একটা ক্ষীণ আওয়াজ তাঁর কানে এসে পৌঁছল। কী ব্যাপার, কেউ কাঁদছে না! কোনো মেয়েলী কান্নার আওয়াজ! তিনি তাকালেন চারদিকে, রাস্তার ধারের আম গাছের পাশটাতে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গেলেন রমাকান্ত, সামনেই ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে মেয়েটি, সে আর কেউ নয়, ঋতুন!
-- কী হলো তোমার? রমাকান্তর বিস্মিত প্রশ্ন ছিল।
কাঁদতে কাঁদতে ঋতুন তাকিয়ে ছিল রমাকান্তর দিকে, বলেছিল, আমি ঘরে যেতে পারিনি, আমার মাথায় ডাল এসে পড়ল--
-- ডাল! চকিত হলেন রমাকান্ত, একটা অতি পাতলা শুকনো আম গাছের ডাল পাশেই পড়ে থাকতে দেখলেন তিনি। কোথায় দেখি? রমাকান্ত ঋতুনের মাথায় আঘাত খুঁজতে লেগে গেলেন। এলোমেলো খোলা চুলের সুবাস তাঁর নাকে এসে ঠেকছিল। মাথা হাতড়ে দেখলেন, তেমন কিছু নয়, এক জায়গায় সামান্য আঁচড়ে গেছে বটেইয়! বছর পনেরর ঋতুন তখনও কেঁদে চলেছে।
-- কেঁদো না! বেশি লাগেনি। — রমাকান্ত সান্ত্বনা
দিতে চাইলেন।
-- আমার চোখে ধুলো ঢুকে গেছে। -- করুণ স্বরে ঋতুন বলে উঠেছিল।
-- কৈ দেখি দেখি! রমাকান্ত সেই পরিস্থিতিতে নিঃসঙ্কোচে ঋতুনের চোখের পাতা খুলে ধূলিকণা খোঁজার চেষ্টা করলেন। কিছু না দেখতে পেয়ে তিনি মুখ দিয়ে ভাপ দেবার চেষ্টা করেছিলেন।
ব্যাস, এ ঘটনার পর থেকেই ঋতুন ও রমাকান্ত প্রেমিক প্রেমিকা বনে গেলেন। তারপর সময় সময়ের মতো চলতে লাগল। অনেক স্বপ্ন মেখে রমাকান্ত ও ঋতুন এসে একই কলেজে ভর্তি হলো। তখনও ওরা প্রেমিক যুগল।
বয়স বিশ পার করল রমাকান্ত। চরিত্রবান প্রেমিক তার একমাত্র প্রেমিকা নিয়েই আগামীর ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেন। ঠিক এমনি সময় নব নায়িকা ঊর্মিমালার প্রবেশ ঘটল। ঊর্মি ছিল বড় উচ্ছল, নারীর লজ্জা তার মধ্যে কমই ছিল, আজকালের স্বভাব উন্মাদনার লক্ষণগুলি তার মধ্যে ধরা ছিল। রমাকান্তর সাদামাটা চেহারা তার কি মনে লেগে গিয়েছিল, না কি ঋতুন ও রমাকান্তর প্রেম তার মধ্যে ঈর্ষার জন্ম দিয়েছিল? ঊর্মিমালা একদিন হঠাৎই উপযাচক হয়ে রমাকান্তর সামনে এসে দাঁড়াল। তখন তার প্রসাধন লিপ্ত শরীর, তার পলাশ রঞ্জন ঠোঁট, চোখ তার কাজল লতিকা, চুল তার গন্ধ বিলাস, দেহে তার আতুর কাঁপ, উচ্ছ্বসিত হয়ে সে বলে উঠেছিল, আমি তোমার সেকশনে পড়ি রমাদা! আমায় তো একবারও দেখো না তুমি! হাসিতে উছলে পড়ছিল ঊর্মিমালা। অবশেষে রমাকান্তও হেসেছিলেন। ঊর্মি রমাকান্তর হাত ধরে বলে উঠেছিল, অনেকদিন ধরে আপনাকে দেখছি, কথা বলতে লজ্জা পাই। রমাকান্ত সেদিন ঊর্মির লজ্জার লক্ষণগুলি কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
এমনিতে খারাপ লাগছিল না, এক সুন্দরী অপ্সরা নারীর সংস্পর্শে পুরুষের জেগে ওঠা তো স্বাভাবিক! তবু প্রথম আলাপে তিনি নিজের স্থিরতা ভাঙেন নি। কিন্তু দ্বিতীয়বার নিরালায় ঊর্মি যখন রমাকান্তর শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল, তার সুন্দর বিনোদনের সংলাপগুলি তাঁর মনে কানে অনুরণন তুলে যাচ্ছিল।
রমাকান্ত ক্রমশ খোলস ছাড়ছিলেন। তাঁর পুরুষ প্রকৃতি যেন তাঁর অজান্তেই একটু একটু করে খুলে যাচ্ছিল। ঊর্মি একটু একটু করে তাঁকে কাছে টেনে নিচ্ছিল। আর ঋতুন একটু একটু করে রমাকান্তর মন থেকে সরে যাচ্ছিল। এরই মাঝে একদিন ঋতুন এসে বলেছিল, রমাদা, আমার বিয়ে ঠিক হতে চলেছে--
উত্তরে সে দিন রমাকান্ত অকপটে বলতে পেরেছিল, বিয়ে তো এক দিন
না এক দিন হবেই--
-- তুমি তা হলে আমাকে চাও না? ঋতুনের মাঝে অভিমান ভরে ছিল।
রমাকান্ত নীরব ছিল।
ঋতুন রেগে বলেছিল, তা হলে তুমি সত্যি ঊর্মিকে ভালোবাসো? ঋতুনের গলা ধরে আসছিল।
ইচ্ছেশক্তি অনেক সময়েই নিজের বশে থাকে না। রমাকান্ত তখন জানেন না, তিনি কাকে ভালোবাসেন! কিম্বা তিনি সত্যি কি কাউকে ভালবাসতে পেরেছেন? নিজের কাছে নিজে কোনোদিন এ প্রশ্ন করে দেখেননি।
এক সময় ঋতুন রমাকান্তর বুকের কাছে এসে তার দিকে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, আমি তোমাকে ভালোবাসি, রমাদা!
সেই মুহূর্তে রমাকান্ত যেন শত চেষ্টাতেও স্তব্ধতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিলেন না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল ঋতুন, বলে উঠেছিল,
তার মানে তুমি আমাকে কোনোদিন ভালোবাসো নি? এ প্রশ্নের সঙ্গে সেদিন নিষ্ফল ভালোবাসা নিয়ে ফিরে গিয়েছিল ঋতুন।
ভালোবাসার ফের বদল হতে সময় লাগে কৈ? একদিন রমাকান্তর চোখের সামনে ঊর্মিলার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের কদিন আগে ও এসে বলেছিল, রমাকান্তদা! আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সে দিন রমাকান্ত আঁতকে ওঠেননি। ঊর্মির অস্থিরতা, তার ভালোবাসার উন্মাদনা, স্থিরতা না পাবারই কথা ছিল। ঊর্মির মতো মেয়েরা গায়ে ভালোলাগা লাগিয়ে ফেরে, অন্যের ভালোবাসাকে
ঈর্ষার ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিতে চায়। স্থানকালপাত্রের কোনো ঠিকানা থাকে না। তাই রমাকান্ত ও ঋতুর প্রেম বিচ্ছেদে ঊর্মি উল্লসিত হিয়ে
উঠেছিল।
নারীর ভূষণ কি না রমাকান্ত জানেন না, তবে লজ্জা নামক বস্তুটা নারীর প্রাথমিক আবরণ বলা যেতে পারে। নিমীলিত চক্ষু মাটির দিকে নিবদ্ধ রেখে মনের মধ্যে এক তাল ভাবনা জড়ো করে রাখা লাজুক নারীর এক সান্ত্বনা বটে! ঊর্মির মাঝে সেটুকু ছিল না, সে শুরু থেকেই ছিল নির্লজ্জ, উল্লসিত, তার শরীর উষ্মায় অন্তর কামনার অস্থিরতা রমাকান্ত লক্ষ্য করেছিলেন।
-- তুমি কেন এত শান্ত? প্রশ্ন করেছিল ঊর্মিলা। চুম্বন প্রক্রিয়ার প্রথম পাঠ ঊর্মিমালাই রমাকান্তকে শিখিয়ে ছিল। ঊর্মির চুম্বনে আঠা ছিল, সে চুম্বনের ঠোঁট সরাতে সময় লেগে যেত। রমাকান্তর মন আস্তে আস্তে গলতে শুরু করত।
রমাকান্ত শুধু ঊর্মির শরীর পাঠ করে গেছেন। তার নারী রহস্য ভেদ করতে পারেন নি। প্রতিদিনের নিত্য নিয়মের ভেতর, লিপ্সা ভাবনার ভেতরে তাঁর দিন গুজার চলছিল। তাঁর সামনে ভালোবাসার এক অথৈ সাগর ঢেউয়ের উন্মাদনায় দুলে চলেছিল। অতলে না তলিয়েও রমাকান্ত ভাবেন, কী আছে এই পৃথিবীতে? অগাধ ভা্লোবাসার বীজ ছড়ানো যত্রতত্র। শ্বাস রুদ্ধ ভ্রূণের বিক্ষিপ্ততা আকাশে বাতাসে। এক উৎক্ষেপ আনন্দে নেচে ওঠা যৌবন, এক জাগায় এসে স্থির হতেই হয় তাকে। যৌবনের অভিজ্ঞতা ঘেঁটে একদিন বিয়ে করে পুরুষ, নারীসঙ্গের অভিজ্ঞতা নিয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর ঘর, একটা ঘর চাই। মনের আদলে সেখানেও থেকে যায় একটা পালঙ্কের কামনা।
ফুটপাতগুলি ক্রমশ ভরে যায়। সেখানেও বিছিয়ে পড়ে সংসার। একান্ততা ছিন্ন করে আত্মচীৎকারে মায়েরা জন্ম দেন তার সন্তানদের। নবজাত শিশুদের মাথার ওপর আকাশ উড়তে থাকে। তবু ক্ষণমাত্রায় হলেও রাতের আলো-আঁধারী আকাশে মৃত চন্দ্রালোকে ফুটে ওঠে চাঁদ তারা ফুলের বিস্তৃত বাগান।
বাস্তবে পুরুষ ও নারীর ছায়ার মাঝেই মিশে থাকে জাগতিক খেলা। ঘরের জালঘেরে যতই আমরা সৌষ্ঠব ধরে রাখতে চাই না কেন, আমাদের ফানুস মন যত্রতত্র উড়ে বেড়াতে চায়--আতুর-রং ভাবনাগুলি থেকে আবার কখনো ক্ষিপ্ততা ভেঙে দিতে চায় ঘরের শলাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন