শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়
মুখাবয়ব : বহমান সময়ের ভাষ্য এবং রিয়ালিটির আত্মদর্শন
ইমেজারী রিয়াল ও জাতির ইতিহাস নিয়ে যখন একটা সময় সামনে
উঠে আসে, তখন সময়ের এই আবহ ধীরে ধীরে
বিলম্বিতের দিকে ঝুঁকে পড়ে, অর্থাৎ নিরবিচ্ছিন্ন সাউন্ড ট্র্যাকের ভেতর যেন শ্লথ এক সুরমূর্ছনা।
আমরা সচরাচর কথা বলে থাকি শিল্পের সেইসব দিকগুলো নিয়ে, যা ফর্মের ভাঙাগড়াকে তুলে
আনে, তুলে আনে শিল্পীর জীবনের ছবিকে, পরিস্ফূট করে যন্ত্রণাকে। এইভাবেই ভাবনার
জগতগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। আবার টানটান সুতোর টানে যখন হাওয়া ভেদ করে সটান উপরে
উঠে যায়, তখন নিচে পড়ে থাকে একটা সুতোর আবছা রেখা। মাঞ্জাহীন না মাঞ্জার দাপট, তা মাটিতে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সেখানেই অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে অনিবার্যভাবে হাওয়ায় ভর
করার, রিয়ালিটিকে নতুন করে খুঁজে দেখার।
শিল্পী তাঁর শিল্পকর্ম করেন নিজের বেঁচে থাকার তাগিদ
থেকে। নিজস্ব যন্ত্রণার কথা বলা সেখানে মুখ্য; আবার সেখানেই আস্তে ধীরে মিশে যায় ইতিহাস, শিল্পীর
অভিজ্ঞতা, বোধ ও প্রকাশভঙ্গিমা। সংস্কৃতির পরিশিলীত ইজমগুলো আঙ্গিক ভেদে ধরা পড়ে
শিল্পীর তুলির টানে। সেখানে রিয়াল ওয়ার্ল্ড স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ইমেজারী রিয়ালের
মধ্য দিয়ে যাত্রার পথ খুঁজে নেয় অ্যাবস্ট্রাকশনের দিকে।
বিংশ শতকে শিল্পের প্রধান স্বচ্ছন্দতা হিসেবে উঠে এসেছে
দৃঢ়তা (Boldness) ও আত্মবিশ্বাস (Self
Confidence), যেখানে রঙ ও ফর্মের জোরালো ধাক্কা শিল্পকে বাস্তব
জগতের সেই সকল সম্পর্কগুলোর মধ্যে নিয়ে আসে, যেখানে খুব স্পষ্ট ভাবে যুক্ত হয়
শিল্পীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সক্রিয়তা। আর সময়ের বদলে যাওয়া সব সময়ই অনেক বিস্তৃত ভাবে
ধরা পড়ে যায় পোর্ট্রেটের মধ্যে দিয়ে। একটা মুখ যাকে আমি
দেখছি; তার সমস্ত রেখা, ছন্দ, দ্যোতনা যখন প্রকাশ পাচ্ছে
তুলির টানে এবং নিজস্বতার গুণে হয়ে উঠছে সময়ের ও যুগের প্রতিনিধি, তখন সেখান থেকে
মূর্ত জগত রিয়ালিটির সীমানা ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে অ্যাবস্ট্রাকশনের দিকে। রিয়ালিটি অতিক্রম করছে ইমেজারী রিয়ালিটিকে এবং একবিংশ শতকের একটা
টালমাটাল স্তব্ধ সময়ে বসে সকল মুখাবয়ব ছুঁতে চাইছে হাইপার রিয়ালিটিকে।
ইতিহাসের প্রধান সাক্ষ্য বহন করে চলেছে মানুষের মুখ। যন্ত্রণা, কষ্ট, আনন্দ,
সময়ের তীব্র কাঙ্ক্ষাগুলো প্রকাশিত হয়েছে
সকল শিল্পীর নানান
প্রতিকৃতির মধ্য দিয়ে। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ নবজাগরণের মুখ। যেখানে
মৃদু হাসি, স্নিগ্ধ চোখ, নরম অবয়বে ধরা রয়েছে সম্ভাবনার কথা; ব্যালান্স ও রিদম যে
মুখের মুখ্য সম্পদ।
নবজাগরণের সময়কালের সকল সম্ভাবনাময়
ইতিহাসের কথাই তো আসলে ফুটে উঠেছে এই
ছবির হাত ধরে।
নবজাগরণ পরবর্তীকালে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, মানুষের
অগ্রগতির পথ হাঁটার মধ্য দিয়ে বর্তমান সময়ে
এসে মানুষ যখন দাঁড়িয়েছে, তখন পরিবর্তনগুলির নিপুন স্বচ্ছতায় ধরা পড়ে শিল্পীর মুখাবয়বে। ইতিমধ্যে দুটো বিশ্বযুদ্ধ ঘটে গিয়েছে, কমিউনিজম ও ক্যাপিটালিজমের টানাপোড়েনের
রক্তক্ষয়ী ইতিহাস দীর্ঘায়িত হয়েছে ক্রমেই; কোণঠাসা সাম্যবাদ এবং জমা ক্ষোভ, আক্রোশ,
যন্ত্রণার পাশাপাশি ক্যাপিটালিজমের দাপটে অর্থনৈতিক বৈষম্য, বাজার অর্থনীতির
একচেটিয়া বিশ্বায়ন ও বেসরকারীকরণের ফলে মানুষের জীবনযাত্রা, বেঁচে থাকা যখন পাল্টে
যাচ্ছে তখন সেই সমস্ত যন্ত্রণা নিরাপত্তাহীনতা অভাবের পাশাপাশি ভালোবাসার অনুভূতিগুলোও প্রকাশিত হয়েছে পোর্ট্রেটে। আমরা কথা বলছি এই রকমই
বিংশ শতকের পাঁচজন শিল্পীর আঁকা পোর্ট্রেট নিয়ে, যা তুলে
ধরেছে সময়কে, তার জাদুকরী বিন্যাসকে। পাঁচজন শিল্পীর আঁকা পোর্ট্রেটের রেখাকে খুঁজে
দেখার মধ্য দিয়ে আসলে সময়ের পরিবর্তনকে ছুঁতে চাওয়ার চেষ্টা।
রিয়ালকে অস্বীকার করার চেষ্টার থেকেও শিল্পীর অনেক বেশি
তাগিদ থাকে রিয়াল ফেনোমেনাকে অতিক্রম করে মননের নতুন দিকগুলোকে তুলে ধরার লক্ষ্যে।
অস্বীকার করার তীব্রতা পরিচালিত করে শিল্পীকে ক্যানভাসে সময়ের বা আবহমানের অসহায়তাগুলোকে ব্যক্ত করতে। অস্বীকার তখনই আসে যখন
মুক্ত সৃজনশীল মনের ওপর বাধা নিষেধ আরোপিত হতে থাকে নানান দিক হতে;
কখনও তা সমাজ ও রাজনীতি আবার কখনো বা বিশ্বাসবোধকেও নির্দেশ করে।
***
আলোচনার শুরুটা করছি লুসিয়ানকে দিয়ে। লুসিয়ানের জীবন ও তাঁর শিল্পবোধের ইতিহাসের সঙ্গে
জড়িয়ে আছে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের নাম। ছোট থাকতে লুসিয়ান দাদু ফ্রয়েডের কাছে ইংল্যান্ডে চলে আসেন।
সেখানে মনস্তাত্ত্বিক নানান আলোচনা ও
পর্যালোচনা তাঁকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে লুসিয়ানের বাবা ছিলেন স্থপতি, ফলে শিল্পজগতের
সঙ্গেও তাঁর পরিচয় হয় ছোটবেলাতেই। লুসিয়ানের কাজের সংখ্যা খুব কম হলেও শক্তিশালী ছবিগুলি ছিল
সময়ের চলনকে ধরে রাখার মূর্ত প্রতীক স্বরূপ। লুসিয়ান পরবর্তীকালে স্কুল অফ লন্ডনের একজন
উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিপন্ন সময়ে, মানুষের একাকীত্ব ও যৌন জগতের যে
সব ছবি তুলে ধরেছেন, তা শিল্পের ইতিহাসে অন্যতম স্থান করে নিয়েছে। ন্যুড আঁকার ক্ষেত্রে যে অভিনবত্ব আনেন, যেখানে নারী
বা পুরুষ শরীরের নমনীয় কোমল মনোমুগ্ধকর দৃষ্টির গোড়ায় সমূলে কুঠারাঘাতের
ভঙ্গিতে তিনি আঁকেন শরীরকে মেদ সমেত, তাদের
যাবতীয় শারীরিক জ্বালা যন্ত্রণা তথা অসুন্দরের যে রোজনামচা, জীবন সংগ্রাম তার প্রতিভূ রূপে। লুসিয়ানের ছবিতে
আলোগুলো সঞ্চারিত হয়েছে দেহের চাপ চাপ রঙের প্যাচগুলো থেকেই।তাঁর উজ্জ্বল রঙে আঁকা
ন্যুড ও মুখগুলোতে বিশ্বযুদ্ধকালের পরবর্তী সময়ের ক্লান্তি, অসাড়তা, যৌনতার ক্ষেত্রে যে শিথিলতা
তথা অবসন্নতা এসেছে, তা ফুটে উঠেছে সামাজিক প্রতিবেদনের প্রতিনিধি হিসেবে। ন্যুডের ক্ষেত্রে যেমন সকল শরীর থেকে
ঠিকরে বেরিয়েছে এই সমকালীনতার কথা, তেমনি লুসিয়ানের পোর্ট্রেটগুলি ছিল আরও
কেন্দ্রীভূত আবেগের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম স্বরূপ। ফ্রান্সিস বেকনের সঙ্গে স্কুল অফ
লন্ডনে থাকার সময় তাঁদের চিন্তা ভাবনায় যে আদান প্রদান হয়েছিল, তার গভীর বাঙ্ময়তা লুসিয়ানের ছবিতে
পরিস্ফূটিত হয়েছে।
লুসিয়ানের ছবিতে
ফ্রয়েডের মনস্তাত্ত্বিক জগতের
বিশ্লেষণগুলোর প্রভাব সুস্পষ্ট। যত দিন যাচ্ছে, লুসিয়ানের ছবির প্রাসঙ্গিকতা তত বেশি সামনে উঠে
আসছে। তাঁর প্রতিকৃতিগুলো ন্যুডের পাশাপাশি ফ্রয়েডের তত্ত্ব মেনে মুখাবয়বের
ভুলভ্রান্তির আড়ালে, মেদ মাংসের আড়ালে, মায়াবী চলনের ধারাকে ব্যাখ্যা করছে
সর্বক্ষণ। প্রতিকৃতিগুলোর বাস্তব ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে সুপাররিয়ালিস্টিক। ১৯৫৪ সালে
‘হেড অফ আ বয়’ (Head of a boy)- এক কিশোরের
প্রতিকৃতি, যেখানে অবদমিত চোখের দৃষ্টি, যেন দীর্ঘশ্বাসগুলিকে দীর্ঘায়িত করেছে আরও। সময়ের এই না বলা কথাগুলিকে
কিছু স্পেস সৃষ্টির মুন্সীয়ানায় শিল্পী ব্যক্ত করেছেন, যার নান্দনিকতা অতুলনীয় এবং
অসীম তার ব্যঞ্জনা, বাঙ্ময়তা।
লুসিয়ানের এই মুখের
পর্যালোচনার সময় যদি পিছিয়ে ১৮৮৫ সালে ভ্যান গখের ‘গর্ডিনা ডি গ্রোট’ (Gordina de Groot, Head 1885)-এর ছবিটিকে পাশাপাশি রাখা হয়,
দেখা যাবে সময় তার গতি ও ছন্দ বদলে নিয়েছে তুরীয় প্রত্যয়ে। ঘন ব্যাকগ্রাউন্ড, গভীর রঙের প্যাচে সামান্য কিছু হাল্কা রঙের ব্যবহারে ভ্যান গখের এই মুখও
ইমপ্রেসনজিমকে ছাপিয়ে গিয়েছে। ছবির সর্বত্র গখের সিগনেচার
আত্মবিশ্বাসের দাপুটে প্যাচগুলোর অবস্থান একটি প্রত্যয়ী মুখ আমাদের উপহার
দিলেও, ছবিটির গভীর অধ্যয়নে ধরা পড়ে চোখে সবুজ ও নীলের ব্যবহার কোথাও গভীরে ধীরে
জ্বলতে থাকা শিল্পীর দেখা জীবনের ক্ষয়িষ্ণুতা, অসহায়তা ও বিপন্নতার
কথা। কিন্তু এই বিপন্নতার
চরিত্র লুসিয়ানের আঁকা ছেলের মুখের থেকে অনেক আলাদা। ভ্যান গখ এই ছবিটি এঁকেছিলেন নিউএনেন (Nuenen)-এ থাকার সময় ‘দ্যা পটেটো ইটারস’ শেষ করার কিছু
দিনের মধ্যেই। ফলে ছবিতে শক্তিশালী ও প্রত্যয়ী রেখার উপস্থিতিতে বাঙ্ময়তা এক অন্য মাত্রা পেয়েছে।
গখের অন্যান্য ছবির থেকেও অনেকাংশে আলাদা হয়েছে তাই এই প্রতিকৃতিটি।
অন্যদিকে লুসিয়ানের ছেলের প্রতিকৃতিতে ঠোঁট ও নাকের কাজের
যে রিয়াল এফেক্ট, সেখানে শিল্পীমন ছাড়িয়ে গিয়েছে ইমেজারী রিয়ালকে। প্রতিকৃতি সময়ের
আবর্ত, বাঁকা রেখা, না বলা কথা, কথা না বলতে পারার যন্ত্রণা, বিপন্ন স্তব্ধ সময়ে
আটকে বাড়তে থাকা কৈশোর, যৌনচিন্তার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও প্রকাশের অক্ষমতা,
বিশ্বাস ভঙ্গ, এই সব কিছু নিয়ে এই মুখ কেমন যেন আমাদের নিজেদেরই কৈশোরের, যৌবনের
মুখের রেপ্লিকা হয়ে উঠেছে। ছবিতে তুলির চাপ চাপ রঙে সর্বত্র একটা
ছদ্মময় চলন দেখা গেলেও মুখের ভাঙচুর, প্রতিটি ব্রাশের আলাদা করে উপস্থিতি জানিয়ে
দেয় সময়ের ঘাত প্রতিঘাতের আলাদা আলাদা চলন এবং তার উপস্থিতি।
দুটো ছবির
ক্ষেত্রেই ঠোঁটের কাজে অদ্ভুত মিল! গখের ছবিতে অন্যান্য সব রঙের থেকে আলাদা হয়ে
লাল রঙের সামান্য দু’চার ছোঁয়ায় ছবিটিতে কৈশোরের প্রাণোচ্ছ্বলতার
আভাষ বিদ্যমান যদিও তা থমকে গিয়েছে
রোজকার যাপনের ভারে। অন্যদিকে লুসিয়ানের ছবির ছেলেটির ঠোঁটের থেবড়ে যাওয়া কোণে
যেন বাঁকা প্রত্যয়ী অবমাননা সময়ের প্রতি। আপার লিপের স্ফীত ইমপ্রেশনের ফলে আর অবদমিত চোখের
দৃষ্টির কেন্দ্রীভবনের দ্বারা মুখের বা পাশের বিস্তৃতি ছবিতে নিয়ম ভাঙার মাত্রাকে
যুক্ত করেছে অন্য ভাবনায়। লুসিয়ানের অন্যান্য
কাজের তুলনায় অনেক আলাদা এই ছেলের প্রতিকৃতি। পরবর্তীকালে ১৯৫৯, ১৯৮১ সালে যে সব
প্রতিকৃতি তিনি করেছেন, সেখানেও তাঁর মনের অন্তঃস্থলগুলিকে বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিভঙ্গি
থেকে ছুঁয়ে দেখার প্রচেষ্টা স্পষ্ট। দুটো আলাদা সময়ে আঁকা দুটি মুখ সম্পূর্ণ আলাদা
শৈলীর দুই চিত্রকরের হলেও কোথায় যেন একাত্ম হয়ে যায় রঙের প্রয়োগে, প্রকাশের সমতুল্যতায়, রেখাদের ছন্দবদ্ধ
প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। (ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন