অন্তরা চৌধুরী
যদি ফিরে যাই অনার্য জগতে
বুড়িকে আমার একপ্রকার বন্ধুও বলা চলে। যাকে মনের সব কথা বলা যায়, সেই তো বন্ধু! তবে সে আমার সমবয়সী নয়, এজন্যই বললাম, একপ্রকার। বুড়ির একটু বিস্তারিত পরিচয় দেওয়া দরকার। আমার কাকার constructionএর বিজনেস। কাকার কাছে বুড়ি প্রায় কুড়ি বছর
ধরে কাজ করছে। সে এক সাঁওতাল রমণী। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। বাড়ি বাঁকুড়ারই এক প্রত্যন্ত গ্রামে। কাজ করতে করতে যেদিন অনেক বেলা হয়ে যেত, সেদিন বুড়ি আর ঘরে ফিরতে পারত না। আমাদের বাড়িতেই থাকত। আমার ছোট্ট রুমে আমি খাটে শুতাম, আর বুড়ি মাটিতে বিছানা করে শুতো। এত সুন্দর বিছানাটা করত যে আমার মনে হতো, খাট ছেড়ে আমি ঐ বিছানাতেই শুই। কত রাত্রি পর্যন্ত জেগে আমরা গল্প করতাম। সেই থেকে বন্ধুত্বই শুধু নয়, কোথায় যেন একটা আত্মার টান অনুভব করতে থাকি। তখন আমি ক্লাস ইলেভেন-এ পড়ি। বয়ঃসন্ধির নানা মানসিক জটিলতা কাটিয়ে কোথায় যেন জীবনে একটু প্রেমের গন্ধ। কাউকেই ঠিক মনের কথাগুলো বলতে পারতাম
না। কিন্তু বুড়িকে অকপটে বলতাম। ও সব শুনত। আমাকে বুঝত। কী যে মানসিক শান্তি পেতাম তা বলে বোঝানোর
নয়!
তারপর কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডী পেরিয়ে, অনেক ডিগ্রী ঝুলিয়ে আজ আমাকে তথাকথিত শিক্ষিত বলা চলে। বয়সের সাথে সাথে
মানসিকতার পরিবর্তন ঘটলেও বুড়ির প্রতি সেই আত্মিক টানের কোথাও পরিবর্তন ঘটেনি। বরং
টানটা যেন আরও বেশি বেড়ে গেছে। আর বুড়িও ভারি অদ্ভুত। সে স্বামি পরিত্যক্তা। কিন্তু তাতে কোনো ক্ষোভ নেই। আজও সধবার
চিহ্ন বহন করে বেড়ায়। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে রাত্রির কোলে শান্তির ঘুম। যেদিন থেকে
বুড়ির সাথে পরিচয় হয়েছে সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ওর ভালোবাসার খামতি কোনোদিন অনুভব করিনি। বিনা
স্বার্থে একজন অনার্য অশিক্ষিত সাঁওতাল রমণী কীভাবে এত ভালোবাসতে পারে, সে তথ্য আমার আজও
অজানা। বুড়ি শুধু আমার বন্ধুই নয়, কোথাও যেন সে আমার
অভিভাবকও। কোনোদিন আমার ওপর রাগ করেনি, কোনোদিন আমাকে বকেনি। ও শুধু
ভালোবাসতেই জানে।
যেদিন বুড়ি বাড়ি যাবার বাস পায় না, সেদিন খুব আনন্দ হয়। ও রাত্রে থাকলেই আমার যে কিসের আনন্দ হয়, তা ঠিকঠাক বুঝতে আজো পারি না। কতরকম গল্প হয় রাত্রিরে শুয়ে শুয়ে। প্রত্যেকদিন জানতে
চাই ওদের জীবনযাত্রার ধরন, আচার অনুষ্ঠানের নিয়ম। বুড়ি একটার পর একটা আমার সমস্ত কৌতূহলের নিরসন করে। কী অদ্ভুত ওদের জীবনযাত্রা! আমরা এত নিজেদের আধুনিক বলে বড়াই করি, কিন্তু ওরা আজও নিজেদের প্রাচীনতাকে বজায় রেখেছে। সবচেয়ে অবাক হলাম যখন শুনলাম বুড়ি
আজ পর্যন্ত কোনোদিন ট্রেনে চাপেনি। অথচ গ্রাম-শহরের দ্বান্দ্বিকতার বিবর্তনেই ওদের জীবনযাত্রা অতিবাহিত হয়। ওরাই তো এই ভারতবর্ষের প্রকৃত দাবিদার
অনার্য সম্প্রদায়। আর্য জাতির পদপিষ্টনে আজ ওরা কোণঠাসা।
আমাদের বাড়িতে যেহেতু প্রায় দিনই থাকে সেহেতু ওদের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছে। যেদিন বাড়ি থেকে খাবার আনে সেদিন দেখি চার বাটির টিফিনকারির তিনটেতে বেশ মোটা চালের তামাটে রঙ্গের ভাত, আর একটাতে একটুখানি শাক। আমি অবাক হয়ে যাই যখন দেখি শুধু ঐটুকু শাক দিয়ে অতটা পরিমাণ ভাত কী অম্লান বদনে ওরা খায়! একমুখ হাসি। কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। ডাল মেখে আমাদের মতো ভাত ওরা খেতে পারে না। খুব গ্রীষ্মকালে ভাতে জল ঢেলে খায়। নুনের প্রয়োজনও খুব একটা ওদের নেই। একগ্রাস করে ভাত মুখে তোলে, সঙ্গে একটুকরো শাক মুখে ঠেকায়। সবাই গোল হয়ে খেতে বসে। আমরা যেমন স্কুল লাইফে খাবার ভাগ করে খেতাম, ওরাও তেমনি ভাগ করে খায়। শত অভাব সত্ত্বেও কোনোদিন কারো উচ্ছিষ্ট ওরা খায় না। সব্জীও খুব একটা খেতে দেখি না। খুব জোর আলু। বিভিন্ন রকম শাক ওদের কাছে সব থেকে প্রিয়। সে শাকও শুধু সেদ্ধ। তেলের পরিমাণ তাতে নেই বললেই চলে। এই একই খাবার ওরা তিনবেলা খেয়ে কী অমানুষিক পরিশ্রম করে! সকাল বেলায় চায়ের প্রচলন খুব কম ওদের মধ্যে। ব্রেকফাস্ট হয় গরম ভাত খেয়ে। ফিগার কনশাস্, আমাদের শিক্ষিত সমাজ যা ভাবতেও পারে না।
শরীর যদি কোনোদিন খারাপ হয় সেদিন গোলমরিচ, তেজপাতা, আদা, তুলসীপাতা দিয়ে একবাটি চা খায়। রাত্রি আটটা সাড়ে আটটার মধ্যে শুয়ে পড়লেও ওঠে কিন্তু ভোর
তিনটেয়। ঘরদোর নিকোনো, গরু, হাঁস, মুরগী, ছাগল প্রভৃতি প্রতিপালনও একই সঙ্গে চলে। তার সাথে আছে নিজেদের
অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম।
খুব ইচ্ছে ছিল বুড়িদের গ্রাম দেখার,
ওদের জীবন যাত্রার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে পরিচিত হবার। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার
করতে দ্বিধা করিনি। এর আগে হয়তো অনেকেই এই উপজাতির সংস্কৃতি নিয়ে
বিস্তর আলোচনা করেছেন। কিন্তু মানুষের সাথে মানুষের অনন্বয়ের ফলেই
তো দৃষ্টিভঙ্গীগত পরিবর্তন ঘটতে পারে!
জন্ম থেকে মৃত্যু ওদের আচার
অনুষ্ঠানগুলো ভারী অদ্ভুত। সদ্যজাত বাচ্চা হবার একুশ দিন পর যে নাড়ী কাটে সেই
দাইমা আতপচালের সঙ্গে নিমপাতা
সেদ্ধ করে একপ্রকার তেতো ভাত রান্না করে।
সেই ভাত সে নিজে গোটা পাড়া বিলি করে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই সেই ভাত খেতে
হয়। এবার সেই সন্তানের পিতা কাঠের হামানদিস্তায় ঘরের ভেতর আতপচাল পেশাই করে ভাত
রান্না করে। মধ্য রাত্রিরে যখন সবাই ঘুমিয়ে যায়,
রাতচরা পাখিরাও যখন আর ডাকে না, তখন সে ঘরের ভেতর মারাংবুরুর থানে শালপাতায় একটু ভাত দেয় ও খুড়িতে দেয় অল্প হেঁড়া। এরপর সেই ভাত ঐ সন্তানের মা ও বাবা খায়। খাবার পর সেই শালপাতা এমন জায়গায়
ফেলতে হয় যেখানে কেউ পা দেবে না। পরেরদিন গোবর ডোবায় পাতাগুলো ফেলা হয়। তারপর সেই স্থানে মাড়ুলি দেওয়া হয়।
ছেলেদের ছয়মাসে আর মেয়েদের সাতমাসে অন্নপ্রাশন হয়। সেদিনও ওই মারাংবুরুর স্থানে
পুজো হয় ও সন্তানের নামকরণ করা হয়। আমাদের যেমন অন্নপ্রাশনে মামাকে ভাত খাওয়াতে
হয়, ওদের নিয়ম সম্পূর্ণ আলাদা। সন্তানের পিতাই তাকে ভাত খাওয়ায়।
বুড়ির সহযোগিতায় সম্ভব হয়েছিল ওদের
বিয়ের অনুষ্ঠান সামনে থেকে দেখার। মেয়ের বাড়ি থেকে কখনোই বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে ছেলের
বাড়িতে যায় না। তাতে মেয়ে যদি
সারাজীবন অবিবাহিত থাকে তাও তারা যাবে না। সেটা ওদের আত্মসম্মানের ব্যাপার। ছেলের বাড়ি থেকেই সর্বপ্রথম সম্বন্ধ আসে।
বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পর মেয়ের বাড়ির লোকেরা যখন ছেলের বাড়িতে আসে তখন ঐ অনুষ্ঠানকে
গ্রামের স্থানীয় বাঙালিরা বলে ‘লসমুঞদা’ আর সাঁওতালরা বলে ‘হরকিঁদিয়াকু জমজুঁইনাকু’। এই সময় তত্ত্ব আদান প্রদান করা হয়। মেয়ের বাড়ির লোকেরা ছেলের বাড়ির লোকেদের
ধুতি দেয়।
যার বিয়ে সেই ছেলেটিকে নতুন ধুতি
পরিয়ে পায়ে আলতা ও নেলপালিশ লাগানো হয়। এরপর তাকে উঠোনের মাঝখানে বসিয়ে মেয়ের
বাড়ির লোকেরা ওর চারদিকে গোল হয়ে বসে। ছেলেটির হাতের আঙ্গুলে গোঁজা থাকে একটি
বিড়ি। সে ঐ বিড়ি হাতে নিয়ে সবাইকে প্রণাম করে ও সকলের হাতে একটি করে বিড়ি দেয়। তখন সবাই তাকে ধুতি উপহার দেয়। এরপর মেয়ের বাড়ির সকলকে হেঁড়া (মদ) দেওয়া হয়। মদ
খাওয়া হয়ে গেলে ছেলের বাবা একটি ঘটিতে উঠোনে জল নামিয়ে দেয়। এই জল নামানোর অর্থ হলো যে, প্রণাম অনুষ্ঠান শেষ।
এবার সকলকে ভাত খেতে অনুরোধ করা হচ্ছে। এই
সমস্ত অনুষ্ঠানে নারীর কোনো স্থান নেই।
খাবার পর শুরু হয় বিদায় অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে বাড়ির মেয়েরা অংশগ্রহণ করে। ছেলের মা, জ্যেঠিমা, কাকিমা, পিসিমা সকলে একসারিতে দাঁড়িয়ে যায়। সামনে দাঁড়ায়
মেয়ের বাবা, জ্যাঠা, কাকা, পিসেমশাই প্রভৃতি। এটা হলো বেয়ান বনাম বেয়াইদের খেলা। মেয়ের
বাড়ির আত্মীয়রা ছেলের বাড়ির এই সকল আত্মীয়দের প্রণাম করে। মেয়ের বাবা ছাড়া অন্য
আত্মীয়রা প্রণাম করতে এলে এই মহিলাগণ কাঁধ নাচিয়ে গান গায় –
অকয়টাকানায়না মমবালা
অকয়টাকানায়না মূলবালা
যাঁহাইয়া মুচারেইল গোচ
উনি কানাইনা মূলবালা
এর পর সকলে বেশ শক্ত করে একত্রিত হয়ে
দাঁড়ায়। যেই প্রণাম করতে আসে সেই তাকে সামনে দিক থেকে টেনে পেছন দিকে পার করে দেয়।
নারী শক্তির হাতে পুরুষ শক্তির পরাজয়। বেয়াই-বেহানের লড়াই এর মাধ্যমে তৈরি হয় আনন্দোৎসব।
এদের বিয়েতে কন্যাপণ প্রচলিত। সাধারণভাবে মেয়ের বাড়ি, ছেলের বাড়ির কাছ থেকে গরু দাবী করে। ছেলের বাড়ি তা দিতে অপারগ হলে শাড়ি দাবী করে। এই শাড়ি আবার খুব সাধারণ শাড়ি নয়। অর্ডার দিয়ে সেই শাড়ি বানাতে দিতে হয়। বস্তার মতো মোটা লাল পাড় সাদা শাড়ি। এই শাড়ি মেয়ের দিদিমাকে দিতে হয়। দিদিমা জীবিত না থাকলে মেয়ের পিসিকে দিতে হয়। এই শাড়িকে বলা হয় দোয়াল।
বিয়ের নিয়মটাও ভারী অদ্ভুত। যে
ঘটকালি করে তার হাতে থাকে হ্যারিকেন ও মাথায় থাকে ডালা। হ্যারিকেন
না থাকলে জরিমানা রূপে টাকা দিতে হয়। সেই ডালাতে থাকে মেয়ের জন্য হলুদ দিয়ে
রাঙ্গানো শাড়ি। শাড়িতে কোনো কালো বা লাল দাগ যেন না
থাকে। দাগ আছে কিনা সেটা পাঁচজন মিলে পর্যবেক্ষণ করে। দাগ থাকলে তা ফেরৎ পাঠানো হয়।
বিয়ের পিঁড়িতে বসার আগে বরকে তার শালী বা
শাশুড়িরা স্নান করায়। এইসময় সে বাড়ি থেকে গামছাতে বেঁধে
গুড় ও মুড়ি নিয়ে আসে। শালপাতার ঠোঙ্গায় করে মেয়ের বাড়ির সকলকে সেই মুড়ি দেয়। এই সময় বলা হয় – জামাই লসমুঞদা করতে গিয়েছিল, ওখান থেকে পাঠিয়েছে। মেয়েটিও তার বান্ধবীদের এই
মুড়ি খাওয়ায়।
স্নানের সময় বরের পরনে থাকে একটা
ছেঁড়া গামছা, মাথায় পাগড়ী। একটা ভাঙ্গা ছাতা বরের মাথায় ধরা হয়। একটি ভাঙ্গা
ঝুড়িতে ধানের গুঁড়ো নিয়ে একটি সেলাই করা শালপাতা ঢাকা দেওয়া হয়। তাতে একটি কাঠের
পিড়া থাকে। মেয়ের দিদিমা একটি তালপাতার চশমা চোখে দিয়ে কাঁকালে ঐ ঝুড়িটি নিয়ে একটি
লাঠি হাতে নিয়ে নতুন বরকে খুঁজে বেড়ায়। এই সময় উপস্থিত বাকি সকলে ‘ওঁয়া ওঁয়া’ করে বাচ্চা ছেলেচমতো কাঁদে। এই কান্নার অর্থ হলো যে - তোমার ছেলেকে স্নান করাতে এত দেরি করে ফেললে! আর কখন দুধ খাওয়াবে! এরপর ঐ পিড়াতে বরকে বসানো হয়। তখন সবাই মিলে বরকে
তেল, সাবান মাখিয়ে বাটিতে করে জল ঢেলে দেয়। এরপর মহিলারা আড়াল করে দাঁড়ায়, আর বরের
ঘরের লোকেরা এইসময় বরকে হলুদ রঙের নতুন ধুতি পরিয়ে দেয় এবং আগের পরনের ধুতি পায়ে করে ছিঁড়ে দেয়। বর জিজ্ঞাসা করে
– আমার গামছাটা কই? তখন
আবার সবাই কাঁদতে শুরু করে। এর অর্থ - সবাই আমার ছেলেকে দেখ, সে আজ নতুন করে জামাই হয়ে গেল। ছেলের জামাইবাবু, দাদু
অথবা পিসেমশাই একটি লম্বা সাদা কাপড় দিয়ে মাথায় পাগড়ী বেঁধে দেয়। একে বলে পাটকা।
ঘটকের হাতে যে ডালাটি থাকে, তাতে নববধূ উবু হয়ে বসে
থাকে। মেয়ের বাড়ি থেকে যদি দাবী করা হয় যে, তাদের হাতেই সিঁদুর দান হবে, তখন ছেলের বাড়ি থেকে যে পাঁচজন বউ তুলতে গিয়েছিল, তাদেরকে মদ খাইয়ে দেওয়া হয় এবং ওদের সাদা ধুতি ও জামাতে এবং হাতে হলুদ মেখে ছাপ
দেওয়া হয়। তখন তারা হয়ে যায় দাগী। এর অর্থ ওদের হার স্বীকার।
এরপর শুরু হয় বিয়ে। নতুন জামাইকে তার
জামাইবাবু কাঁধে নেয়। আর মেয়েকে কাঁধে নেয় তার দাদা বা ভাই। মাঝখানে একটি কাপড়
আড়াল করা হয়। ছেলের বাড়ির তিনজনের হাতে থাকে মশাল। যারা কাঁধে নিয়েছে তাদের ডান
হাতে থাকে একটি জল ভর্তি ঘটি। তাতে থাকে আমডাল। বর এবং বধূকে কাঁধে নেওয়া অবস্থাতেই
একে অপরের মাথায় এই আমডালে করে জল দিয়ে পরস্পরকে অভিবাদন করে। এই অবস্থাতেই মেয়ের
দাদাকে নতুন জামাই ধুতি দেয়। একে অপরকে জোর করে পান খাওয়ায়। দুজনের একজন পান খেতে
অস্বীকার করলে অপরপক্ষ তার হাতে পান গুঁজে দিয়ে তাকে নমস্কার করে এবং বর-বধূকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দেয়।
এরপর কন্যাকে ছাদনাতলায় নিয়ে আসা হয়।
মেয়ের ঘরের লোক মেয়েকে তুললে সে সহজেই ঘোমটা ছেড়ে দেয়। কিন্তু ছেলের বাড়ির লোক তাকে তুললে সে কিছুতেই ঘোমটা ছাড়ে না। (ছবি ১)। তার ধারণা বিয়ের ঐ একদিনই তার
শ্বশুরবাড়ির লোক তাকে কোলে তুলেছে, আর তো কোনোদিন তুলবে না! তাই তাদের ভারী লাগলেও তার কিছু এসে যায় না। এইসময় বেগতিক দেখে বর জোর করে নববধূর নাক টিপে থাকে। তখন
নিঃশ্বাস নিতে না পেরে তাকে ঘোমটা খুলতেই হয়। তখন হয় সিঁদুর দান। বুড়ো আঙ্গুল ও মাঝের আঙ্গুলে করে তিনবার সিঁথিতে সিঁদুর
ছোঁয়ানোর পর পুরো সিঁদুরটাই তার মাথায় ঢেলে দেওয়া হয়।
কন্যা বিদায়ের সময়, বিয়ের আগে মেয়েটি যে শাড়ি পরেছিল, সেটাতে করে শ্বশুরবাড়িতে গুড় মুড়ি বেঁধে নিয়ে যায়। এই সময় একটা গান গাওয়া হয় -
‘সঙছাড়ানি, গোছাজনুড়ি
এমাকতেন মাগো গাতে কুড়ি’।
এর অর্থ – এ মা আঁচলে মুড়ি আমার, আমার বান্ধবীদের সকলকে বিতরণ কর।
শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সবাইকে সেই মুড়ি
দেওয়া হয়। নতুন বউ যখন আসে তখন ওদের কুলিতে তালাই পেতে নবদম্পতিকে বসানো হয়। একটি থালাতে রাখা হয় প্রদীপ, দু’ বাটি গুড় ও জল। এইসময় ছেলের মা তার পুত্র ও পুত্রবধূর পা নিজের আঁচল দিয়ে সযত্নে মুছিয়ে দেয় ও এবং তাদের পায়ের ধূলো আঁচলে করে ঘরে নিয়ে আসে। এই মেয়েলি আচারটির অর্থ মা লক্ষ্মীকে ঘরে আনা। এবার এই নবদম্পতির পা ধুইয়ে দেওয়া হয়। এরপর ছেলের মা তার ছেলেকে তার হাঁটুতে বসায়। প্রদীপের তাপ নিয়ে ছেলের দুই হাঁটুতে, বুকে, দুই গালে ও কপালে দেওয়া হয়। তারপর গুড় ও জল খাওয়ানোর পর মুখ ধুইয়ে দেয়, স্নেহবশতঃ মুখচুম্বন করে। ছেলে তার মাকে প্রণাম করে। একই পদ্ধতি করা হয় নববধূর সাথেও। এরপর গোটা পাড়ার লোক নবদম্পতিকে গুড়জল
খাওয়ায়।
এবার ঘরে ঢোকার পালা। মেয়ের দাদা, পাতা সহ
একটা লম্বা ভেরেণ্ডা ডালকে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই পাতার ভেতরে থাকে আঙার ও শালপাতা। দরজায় ঢোকার সময় ছেলের মা ঐ আঙার ও শালপাতা
নিয়ে গিয়ে রাখে ওদের পায়ের কাছে। ছেলের মা ঐ আঙারকে ভেরেণ্ডার ডাল দিয়ে ডান হাতে
তিনবার ঘোরায় ও বাম হাতে প্রণাম করে। এই ভেরেণ্ডা ডালকে বলে চুমাড়া। এবার এই আঙার
ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।
এবার বরণ করার পালা। বরণ ডালাতে থাকে
চালগুঁড়ির ডেলা, হলুদ, গোবর, মুরগীর ডিম। থাকে একটা নতুন লোহা। লোহাটি সিঁদুরে ঠেকিয়ে বউ-এর হাতে ঠেকানো হয়। এবার থালার ডিমটি বাইরে দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। ঘরের ভেতর দিকে ছোঁড়া
হয় গোবর। আর আতপ চালের ডেলাটাও বাইরের দিকে ছোঁড়া হয়। এবার হলুদ নিয়ে শাশুড়ী ও বউ একে অপরের গালে ছুঁইয়ে দেয়। ছেলেও এই একই প্রথা
করে। ঘর ঢোকার সময় বউ-এর আঁচলের সঙ্গে বরের চাদর বেঁধে দেওয়া হয়। এবার ছেলের দিদি ছাদনা তলাতে তিনবার জল দেয় ও বর-বধূকে তিনবার ঘোরায়।
পরবর্তী অনুষ্ঠান যৌতুক। (ছবি ২)। একটি সাদা কাপড় পেতে এদের বসানো হয়। শালপাতায় দেওয়া হয় গুড়-ভাত। আতপচালের সঙ্গে গুড় দিয়ে সেদ্ধ করে এই ভাত করা হয়। এটা ওদেরকে প্রসাদ হিসেবে খাওয়ানো হয়। একটা ঘটিতে জল নিয়ে ওদের হাত ধোয়ানো হয়। যৌতুকের থালাতে থাকে ধান ও দূর্বা ঘাস। বউ-এর পাশে বসে ছেলের দিদি ও ছেলের মা। আর ছেলের পাশে থাকে তার বন্ধু। বর বধূর মাঝখানে পোঁতা থাকে একত্রে একটি শাল
ও মোলের ডাল। কাঠের চিরুনি গোঁজা থাকে এই ডালে। শালপাতাতে সিঁদুর নিয়ে শাশুড়ী ও বউ একে অপরকে দিয়ে ঐ ডালে গুঁজে
দেয়। ওদের সামনে রাখা থাকে একসের ধান ও খোলাতে
থাকে জল। এবার যে যৌতুক দিতে আসে সে ঐ থালাটি নিয়ে ঐ ধানকে তিনবার ঘোরায়, আর বর ও বধূর মাথার ওপর তিনবার ঘোরায়। এবার যে যা টাকা পয়সা বা গয়না দেয় সেটি একজন পড়াশোনা জানা ব্যক্তি লিখে রাখে। এই অনুষ্ঠান হয়ে গেলে নতুন বউ জল দিয়ে সকলের পা ধুইয়ে দেয়। এবার যে শাড়িটা পরে বিয়ে হয়েছিল সেই শাড়িটা ছেলের দিদি কেচে এনে মাথায়
নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই সময় গ্রামের মোড়ল নবদম্পতিকে ঐ কাপড় নামাতে বলে। সেইসময় দিদি একটি ছাগল দাবী করে। সেই দাবী ভাইকে অবশ্যই মেটাতে হয়। সম্মত হলে ছাগলের বিষ্ঠা দিদির হাতে দেওয়া
হয়। অর্থাৎ দিদি তুমি আপাতত এই বিষ্ঠা নিয়ে
সন্তুষ্ট থাক। অতি শীঘ্রই তোমার দাবী মেটানো হবে। ভাই দিতে অপারগ হলে দিদি তখন শাড়ি দাবী করে।
ঘরে ঢোকার পর ছেলের দিদি ঘরের দরজা
লাগিয়ে দেয়। নববধূ দরজা খোলার জন্য অনুরোধ করে। এই সময় একটি গান গাওয়া হয়।
এই বিয়ের তিনদিন পরে বর-বধূ মেয়ের
বাড়িতে ফিরে আসে। সেইসময় খিচুড়ির সঙ্গে মাংস একসাথে রান্না করে সকলকে শালপাতায় করে খাওয়ানো হয়।
এতক্ষণ অনার্য জগতে বিবাহ অনুষ্ঠানের
গল্প বলতে বলতে মনে হলো, সত্যি অনার্য সভ্যতায় সেই প্রাচীন
দোব্রু পান্নার জগতে ফিরে গেছি। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিল খুব কমই। কিছু কিছু
আচার অনুষ্ঠান আমাদের মতো আধুনিক শিক্ষিত মানুষের হাসির উদ্রেক করে।
কিন্তু এই সংস্কার ওরা আজো পরম সযত্নে লালন করে যাচ্ছে। এই আলোচনার বাইরেও থেকে
গেল ওদের আরো কিছু উৎসব অনুষ্ঠানের কাহিনী। থেকে গেল আমার অসম বয়সী সঙ্গী বুড়ির কিছু কথকতা। সুযোগ পেলে সে কাহিনীর আলোচনা অন্য একদিন করা
যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন