অমর্ত্য
মুখোপাধ্যায়
আগ্নেয়
সর্বত্র ব্যাপ্ত
শীত। শরীর ছাড়াও মন, এমনকি বিবেক
সরীসৃপের মতো গর্তে,
গূঢ় অন্ধকারে, কুণ্ডলী পাকিয়ে। অতিরেক
সবার সম্বল, তাই
বাছা নাগরিকদের বিদ্যত্সমাজে কোলাহল,
কখনো উগ্র আর কখনো
স্তিমিত; দ্রুত স্বস্থান বদল,
দেখাচ্ছে নতমুখ ফণী,
তার অপহৃত স্বাভাবিক প্রবণতা — বিপন্ন ছোবল।
নিজের ফণার নিচে
গুপ্ত দংস্ট্রার মধ্যে বিষ কেউ লুকিয়েছে কিনা,
সংবাদপত্র আর
বৈদ্যুতিন চ্যানেল, কিম্বা পথে ‘কলরব’ থেকে তা শুদ্ধ জানি না।
বিশ্লেষণ বৈদগ্ধের
পণ্ডিতের প্রবন্ধেও, গরম হাওয়ার সাথে রক্ত চলাচল
আবার কখন আসবে নাড়ির
গতির সঙ্গে স্বতঃ স্বাভাবিক,
লেখা নেই; এমনকি বলা
নেই সেসব জানার চেষ্টা স্মিত
গণতন্ত্রে ঠিক
স্বাভাবিক কিনা।
মোটামুটি বার্তা
একই, আমরা কেউই সঙ্গে আর শীতকাড়া উত্তাপ রাখি না।
এরই মধ্যে যদি কেউ
ভুল করে সিয়াচেনে সৈনিকের বুখারির মতো,
বুকের ভিতরে একটু
আংরা জ্বলা রেখে দেয়, লক্ষ্য স্থির, উপলক্ষ বিনা,
উদারনীতিতে হবে
সর্বাদিসম্মত? কেউ তার কোনো মূল্য দিই না?
স্বাধীনতাস্মৃতি
আমতা বন্দরে কাল
মেটেবাঁধ ভাঙলো দামোদর,
তার জলে একরাতে পেটও
বাঁধালো কাণা নদী;
গোভাগাড়, এমনকি উঁচু
রামচন্দ্রবাটির পথ ঢেকে
নামালো কি ঢল!
কাছেপিঠে স্কুল থেকে
আসে ক’টা প্রভাতফেরির দল,
পথ নেই তার;
পথই করে নিতে তাই
তিনটি বালক দ্রুত ছাড়াচ্ছে বাকল,
পলকের দ্রুততায়
এখনই নামাবে ভেলা,
সারাবেলা
চষে ফেলতে হবে পুরো
গাঙুরের জল,
নেতা ধোপানির ঘাট,
চাই তার তল।
স্টেশন চত্বর,
হাওয়ায় বাহিত সত্বর,
সুহৃদ সংঘের ছাদে
তিনটি মাইকে
‘বাঁধ ভেঙে দাও...
ভাঙো’, বাজলো শেষ মুহূর্ত অবধি,
এই বার সেক্রেটারির,
মানে আমার বাবা্র, গলা—
‘স্বাধীনতা মানে
বাধা, সব প্রতিকূলতা ভাঙা’।
শুনে ‘খিক্’
হাসলেন চিন্তামণি
স্কুলের মৌলবি,
আমাদের ইতিহাস স্যার,
ওঁর একটু বদরোগ
বেফাঁস হাসার।
সঙ্গে হাসলো কেন
ক্লাবের দেওয়ালে ক্যালেণ্ডার,
ক্লিপ খুলে দুলে
উঠে?—
আজ কিন্তু ওই পনেরোই...
শালঘেরি
দ্বৈতবাহিনীর
ইউনিফর্ম পরা গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে
উঠতে উঠতে চাঁদটা
বিভ্রান্ত হয়েছে?
তিথিও ভুলেছে?
খটখট গুলির শব্দে?
আষাঢ়ি পূর্ণিমা, তবু
আজ রাত স্বচ্ছ, কোনো মেঘ নেই।
আজই রাত্রে, কিম্বা
বহু দিন পরে কোনো এক সূর্যখর দিনে,
কিছু একটা ঘটবেই!
শুধু আপাততঃ
স্টেলমেট হয়ে আছে
রাষ্ট্রনীতি, পরিবেশ, স্বরাষ্ট্র দফতর।
পরিবেশ বলছে এই
ফরেস্ট কভার,
সতেরো পারসেন্টের
দেশে ভীষণ দরকার।
স্বরাষ্ট্র বলছে —
কিন্তু সন্ত্রাসী দূর করতে হলে
জঙ্গল কমাতে হবে, আর
তার সাথে কিছুমিছু জঙ্গলমহলি।
বাজার অর্থনীতি বলছে — দূর কিছু করতেই হবে না।
‘কর্ডন’ থাকতে দাও,
যেমনটি আছে এই
‘পরিবর্তন’-এর
পূর্বাপর।
‘ওরাই’ ‘এনসারক্ল্ড’
হলে বাঁচতে গিয়ে নিজেরাই জংগল কাটবে।
বেরিয়ে আসবে আর তার
পর...।
ফলেই আটকেছে সব গূঢ়
পলিসির চালমাত—
দ্বৈতবাহিনীর উর্দিতে
উদ্ভিদ, মানুষ, কাঁটা, অশান্ত জঙ্গল,
জঙ্গলের বিভ্রান্ত
দ্বিপদ; আর তারও চেয়ে দিশাহারা পূর্ণিমার
জংলা, ত্রিশঙ্কু চাঁদ—
উঠবে কি উঠবে না তা
ঠাহর করতে পারছে না —
পন্থা বলতে পারবেন
সমরেশ বসু?
পারবে কি আপনার ‘চেকো
ক্যারকাটা’?
‘শানা বাউরী’ যে
বৌয়ের বেআব্রুতে কাঁটা?
কোন্ মন্ত্রে নতুন, জটিল ফাঁদ
যাবে আজ কাটা?
প্রেমপত্র
আমার বিটল্স আর তোমার ওই ওয়ান ডিরেকশন?
ঠিক কতটা দূরের?
কতটা তফাতে ঠিক লেনন,
হোরান?
কিম্বা ধরো মালিক, ম্যাডোনা, ম্যাকার্ট্নি?
সুরের বা অসুরের?
ঠিক কতটা আলাদা —
সফিয়া লরেনকে নিয়ে পাগল হওয়া;
জেনিফার লরেন্সে মজা;
সুচিত্রায় মাধুরীতে ফিদা;
কাহারো হোসেইনি আর কাহারো কনরাড,
কারোর নৌশাদ, আর কারো
রহমান,
কারোর ‘নায়ক’ আর কারোর ‘আবহমান’?
আমার ষাটোর্ধ্ব আমি কমবেশি জানি।
তোমার বাঈশটা ঠিক কীরকম?
নীলরঙ আঁটো জিন্স, ঢিলে সাদা টপ,
হর্স টেল, আইপ্যাডে, ভিন্ন চিরন্তনী,
আমার ষাটোর্ধ্ব তুমি না জানতে চাইতেই পারো
তোমার বাঈশটা ঠিক কীরকম?
দুগ্গিকে
আশ্বিনে প্রতিবার
আসে মুসাফির,
পাঁচজনে, একসাথে
বহুদূর থেকে;
কৈলাস, মানসরোবরে শীতে
কেঁপে;
পথ কী কঠিন আর খাদ
কী গভীর!
এতখানি পথশ্রম পারে
না অনেকে।
আসার কারণ কলরব ভালোবাসে!
বাঙালি তাদের কোনো দেয়
না তো ঘর!
বাংলায় দুর্গার
মন্দির নেই;
যে যে কটা আছে সব কালী,
চণ্ডীর।
নিত্যপূজার মেয়ে
পায়নি তো বর!
পাঁচদিন থেকে যায়
মণ্ডপেতেই,
ক্লাবের হুজুগে কিবা
গাঁয়ের মাঠেই।
ছিরি দেখে মনে হয়
সার্কাস দল!
মহিষ, ময়ূর, হাঁস,
সিংহ, পেঁচা;
এমনকি হাজির এক
স্বদেশী ইঁদুর।
তাও হবে সমাদর,
যত্নের ছল;
কারণ তাদের ঘিরে বহু
কেনাবেচা;
সে কারণে বহুতর মিছে
উপচার;
‘বেশ্যামাটি’র থেকে ‘সতী’র সিঁদুর।
ব্যাপারটা নয় খুব
বেশি সিরিয়াস;
পাঁচদিন পরে ছোঁবে
গঙ্গার জল;
এর মাঝে নানাবিধ
আজগুবি থিম;
সবই নকল বলে’ দেবে
ইতিহাস;
ফার্স্ট, লাস্ট গুণে
কাত ভক্তসকল;
কানখাড়া মহিষের
উদগ্রীব শিং।
কে না জানে তারা সব
কালে-অনুচিত,
গাঁয়ের বাউল, ওঝা,
সাঁওতালী বৌ,
এথ্নিক সাজগোজ,
দেশি কালচার,
কেমন মিশিয়ে, আর
ভিন্ন, সহিত,
মালদার গম্ভীরা,
পুরুলিয়া ছৌ,
পাঁচদিনই সৃষ্টি,
কৃষ্টি, বাহার।
আমি দেখি তুমি সরু
আলপথে আসো;
মাঠঘাট ডোবা, পায়ে পথহাঁটা
ব্যথা,
রাস্তায় দেবীপক্ষের
ফালি চাঁদ,
আনমনে কথা বল,
অনুচ্চে হাসো,
বাপ-মা বুঝবে ঠিক দুঃখের
কথা,
টেরই পাওনা পাতা
সামনেই ফাঁদ।
প্রথম কবিতাটা ভালো লাগলো খুব। বাকি গুলো পড়ব কালকে
উত্তরমুছুন