অন্তর্গত অধিচেতনোদ্ভূত শব্দ, বাক্য, শিল্পবোধ, লেখ
সমুদ্রের ঢেউয়ের উপর অন্য পরবর্তী ঢেউ এসে পড়ে। উৎসারিত ঝর্নার জলের উপর জল আরো জল এই রকম অশেষ জলের প্রতিনিয়ত পাতন, তারপর দ্রুত প্রস্থান অচিহ্নিত, অনির্ণীত, অপরিকল্পিত অলক্ষ্যের অভিমুখে। স্রোতরেখা আপনা আপনিই সৃষ্টি হয়ে যায়।
চলন্ত, জিজীবিষু জীবনের অধিচেতনের উৎসস্থল থেকে উপলব্ধ স্বতন্ত্র বোধের
অভিমুখে আজীবন নিজস্ব কবিতার পথ তৈরি করে নিয়েছেন কবি স্বদেশ সেন। নিজেকেই সতত
আবিষ্কার পুনরাবিষ্কারের প্রকরণে মগ্ন থেকে নিজেকে নিজের সৃষ্টিকে গড়া, ভাঙা, পুনর্বার
গড়ে তোলা এক অনবরত পরিবর্তনের অভিলাষ, একই সঙ্গে নতুনের জন্য আকুতি, কাক্ষ্মা জায়মান পরিলক্ষিত হতো স্বদেশ
সেনের কবিতার ধারাবাহিক পাঠক্রমে। নতুন, নতনতর, নতুনতম এই নতুনের জন্য তিনি
অপেক্ষায় থেকেছেন--
"জন্ম-পংক্তি থেকে
একটা লাইন পড়ো
সারা সৃষ্টিতে এই প্রথম
একবার কাজ
পড়ো এমন করে, এমন অসাধারণ
ভাবে পড়ো
যা মৃত্যুচিৎকার থেকে বড়ো ও সমানে ছড়িয়ে যায়"।
চিরাচরিত কবিতার পথ থেকে সরে এসে প্রচলনকে অতিক্রম করে এক অন্য ধরনের বলা খুব
চোখে পড়ে। সৃষ্টির স্বর মৃত্যুচিৎকার থেকে বড় হয়ে উঠুক, এই সুগভীর মন্ত্র নিবেদিত
স্বর তাঁর উচ্চারণে।
'নতুনের কোনো দুঃখ নেই'। কবিতার পরিচিত খোলস তাঁর অপছন্দ। তিনি নতুনতর রূপের
রূপায়নে অগ্রসরমান সর্বদা।
সার্থক কবিতা রচনার প্রেক্ষিতে যা যা প্রয়োজন, কবির অনুপুঙ্খ অনুসন্ধান
সেইদিকে। শব্দচয়ন, বাক্যসৃষ্টি, ইচ্ছানুরূপ বা স্বতন্ত্র কবিতার গূঢ়ৈষণায় কবি
বিলীন থাকেন। কাঙ্ক্ষার অনুরূপ কবিতা সৃষ্টি না হলে তখন কবির অবস্থা ছবি আঁকা আর
ছিঁড়ে ফেলার মতো। স্বদেশ সেন 'নতুন জিভের মতো অল্পলাল ভাষাটা'র আকাঙ্ক্ষায়
প্রতীক্ষা করেছেন বার বার। তাঁর বিশ্বাস--
"যারা যারা চুপ করে
আলো দিয়ে যায় ময়দানবের মতো
ওই সব আমার সাজমহল দূরে, দুঃখে, তারায়"
যে কোনো শিল্পবোধ সম্পন্ন কবি নিজস্ব খন্ড জীবনের বিবিধ অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির
নিরিখে সংরচিত ও মগ্নচেতনা প্রসূত কবিতার আকৃতি, স্বরূপের সংরচনায় আবিষ্ট থাকেন।
স্বদেশ এই ভাবনার প্রসঙ্গে লিখেছেন--
"কাছে এসো রচনা
দু'একটা
কোনোখানে মুখে রোদ..."
নৈঃশব্দের সামীপ্যে নিহিত আর্তনাদও কত মৃদু ও অনুচ্চকিত স্বদেশ সেনের কবিতায়
বিবৃত। সময় ও কালের চিরাচরিত যেন ঘুরে ফিরে আসে, তার আভাষ পাই--
"অলীক, আসল
অনড় চমক যেন
ওঠে পড়ে, থমকে যায়"।
আবার
"দূরত্বেরও মৃত্যু হবে"।
ধারাহীন অথচ ভাবনার ধাবমান ধারাস্রোত তাঁর কবিতায় অন্য অভিরূপে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রতিভাত। শব্দের শিল্পীত উপস্থাপনায়
নির্ভার কবিতাগুলি রহস্যময়, স্থির। জিজ্ঞাসার
সহজতর অনুবৃত্তিসহ অনন্ত উন্মোচনের প্রতিশ্রুতি চিহ্ন নিয়ে তাঁর কবিতা রচিত--
"তুমি কেন এলে
শ্যামাপোকা
...তোমাকে ডাকেনি কেউ
তোমাকে বাঁধেনি কোনো বেড়ি
বেগুনী পারের মায়া?
তুমি কি মুষল জন্ম যা কখনো
ফেরানো যাবে না?
শ্যামাপোকা কেন এলে?"
ক্ষণজীবী পতঙ্গ শ্রেণীর এক প্রাণীর প্রতি কবিতার মাধ্যমে তাঁর জিজ্ঞাসা। এই
জিজ্ঞাসার তীর যদি আমাদের অভিমুখে ফিরিয়ে দিই? কে এই পৃথিবীতে অমরত্ব দাবি করতে
পারে! অসংখ্য উন্মোচনের সম্ভাবনা নিয়ে শ্যামাপোকা হাজির। হাজির করেছেন কবি।
স্বদেশ সেনের সঙ্গে বেশ কয়েকটা রবিবারের সকাল ও অফিস ছুটির পর বেশ কিছু বিকেল
তাঁরর সান্নিধ্য পেতে তাঁর বাড়ি চলে যেতাম। সহজে নিজের অনুভূতি জানাতেন না, চুপচাপ থাকতেন। কিন্তু কিছু ভাবনা
তিনি ধীরে ধীরে মেলে ধরতেন। জানা যেত তাঁর ভালো লাগা মন্দ লাগাগুলি। শক্তিমান কবি
তিনি। অথচ একটি বিশেষ ব্র্যাকেটে তাঁর আলোকিত হয়ে ওঠার স্বাভাবিকতা তেমন হয়নি।
প্রচ্ছন্ন এক মৃদু শূন্যতায় আমার মন ভারি
হতো। ভালো লাগার কবির উল্লেখের পরিবর্তে ভালো লাগা কবিতার কথা তাঁর কাছে বেশি শুনেছি। যদিও
কয়েকজন কবি তাঁর পছন্দের ভেতরে প্রবেশ করেছেন। এঁদের কথাও তিনি বলেছেন আমাকে। 'কবিস্বর' পত্রিকায় তাঁর লেখা একটি
প্রবন্ধে এর কিঞ্চিৎ প্রসঙ্গ আছে।
দুর্নিবার জায়মান সজীবতায় ঋদ্ধ ও শুদ্ধ তাঁর অনেকগুলি কবিতা "অম-অমলিন
হতে চাই / চোখের জলের একা মেঘগুলি"। যাপনের সমস্ত গরল পান করেও
কবি স্বদেশ সেন স্বচ্ছ জীবনপাত্র যত্নে
সংরক্ষিত রেখেছিলেন হৃদি অভ্যন্তরে। পার্থিব রূঢ়তা, শুষ্কতার ব্যাপকতার ভেতরেও
তাঁর সন্ধিৎসু চেতনা তাঁকে অনবরত উত্তম ও কাঙ্ক্ষিত কবিতা রচনার উপজীব্যের
অন্বেষণ, অনুসন্ধানে নিমিজ্জিত রেখেছিল--
"মরুভূমি সংলগ্ন কূয়া
-- তার পাশে যে বসে
অনেক সামলানো জল, নাম জীবন,
যা সমূহ সম্পূর্ণ বিন্দু
একদিন আমাকে এই যা বলেছিলো আমার গাছ"
তাঁর গাছের অনুসন্ধানে আমরা সাধারণ পাঠক ব্যস্ত আছি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন